স্বাদে-গন্ধে-বর্ণে মায় জিভের স্পর্শে অবিকল মুরগির মাংস। কিন্তু তা মুরগির নয়। ‘ল্যাবরেটরি গ্রোন’ বা পরীক্ষাগারে তৈরি কৃত্রিম মাংস নিয়ে হইচই আগেও হয়েছে। ইউরোপের প্রথম দেশ হিসেবে ব্রিটেন ও আমেরিকার বাজারে তা বেশ সহজলভ্য। সেই পথে এক ধাপ এগিয়ে পরীক্ষাগারে এই প্রথম বড় আকারের মাংসখণ্ড তৈরির দাবি করলেন টোকিয়ো বিশ্ববিদ্যালয়ের এক দল গবেষক। তাঁদের তৈরি সাত সেমি দীর্ঘ, চার সেমি চওড়া, কম-বেশি ২.২৫ সেমি পুরু ও প্রায় ১১ গ্রাম ওজনের মাংসখণ্ডের কথা সম্প্রতি প্রকাশিত হয়েছে ‘ট্রেন্ডস ইন বায়োটেকনোলজি’ নামের জ়ার্নালে।
এর আগে প্রাণীদেহের পেশি-কোষকে পরীক্ষাগারে রেখে, নানা পদ্ধতিতে আকারে বাড়ানো হয়েছে। তবে সেই মাংসখণ্ড বেশ ছোটই। অসংখ্য এমন টুকরোকে ভোজ্য ‘বাইন্ডার’ বা আঠালো বস্তু দিয়ে জমাট বাঁধিয়ে খাওয়ার যোগ্য করা হয়। ইদানীং কৃত্রিম মাংস তৈরিতে ‘থ্রিডি’ প্রযুক্তির সাহায্যও নেওয়া হচ্ছে। তাতে কাঁচামাল হিসেবে প্রাণীদেহের পেশির একাংশ ও ফ্যাট কোষ কাজে লাগানো হয়।
তা হলে বড় আকারের মাংসখণ্ড তৈরির ঝক্কি কেন? গবেষক দলের প্রধান, বায়োহাইব্রিড সিস্টেম ইঞ্জিনিয়ার সোজি টাকেচি জানিয়েছেন, বড় খণ্ডে প্রাকৃতিক মাংসের গঠনগত বৈশিষ্ট্য নকল করা তুলনায় সহজ। আর তা ‘টেক্সচারেও’ প্রাকৃতিক মাংসের কাছাকাছি। মাংসের বড় টুকরো চেবানো আর কিমা খাওয়া তো আর এক নয়!
এই ঘটনাকে বড় সাফল্য হিসেবে দেখছেন ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের জীব-পদার্থবিদ অ্যামি রোয়াটও। তাঁর মতে, পরীক্ষাগারে আণুবীক্ষণিক কলা-কোষ থেকে বড় মাংসখণ্ড তৈরি করা সহজ নয়। কোষগুলিকে সুস্থ ভাবে বাড়াতে নিরন্তর পুষ্টি-উপাদান ও অক্সিজেন সরবরাহ করা প্রয়োজন। জীবন্ত দেহে যে কাজ রক্ত করে থাকে।
এখানেই গুরুত্বপূর্ণ টাকেচির দলের কাজ। তাঁরা প্রাণীদেহের রক্ত সংবহন তন্ত্রের অনুরূপ একটি সংবহন তন্ত্র বা ‘সার্কুলেটরি সিস্টেম’ বানাতে পেরেছেন। যা পরীক্ষাগারে ওই কলা-কোষকে পুষ্টি, অক্সিজেন জোগাচ্ছে, যতক্ষণ না তা মনমতো আকারে বেড়ে উঠছে।
টাকেচির কথায়, “আদতে কাজটা কঠিন নয়। একটি বায়োরিয়্যাক্টরে জেলের মধ্যে প্রাণীদেহের জীবন্ত কোষটিকে রাখা হয়। পরে তার মধ্যে দিয়ে অসংখ্য অর্ধ-প্রবেশ্য (সেমি-পারমিয়েবল) ফাঁপা বায়োফাইবার অতিক্রম করানো হয়। এগুলি অনেকটা রক্তবাহের মতো কাজ করে কোষে পুষ্টি-উপাদান, অক্সিজেন সরবরাহ করে। ১১ গ্রামের ওই মাংসপিণ্ড তৈরি করতে আমাদের প্রায় হাজারটি বায়োফাইবার লেগেছিল।”
এই মুহূর্তে পরীক্ষাগারের পরিকাঠামোয় তৈরি মাংস স্বাভাবিক ভাবেই প্রাকৃতিক মাংসের চেয়ে দামি হবে, মানছেন টাকেচি। তবে সময়ের সঙ্গে প্রযুক্তিগত উন্নয়নে তা অনেকটাই কমে আসবে, আশা তাঁর। তাতে এক দিকে যেমন খাদ্য-সঙ্কটের মোকাবিলা সহজ হবে, মাংসের প্রয়োজনে পশু নিধনও থামবে।
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)