তুর্কি প্রেসিডেন্ট রিচেপ তায়িপ এর্ডোয়ান। ছবি: এএফপি।
টুইটে ‘পিস স্প্রিং’ (শান্তির বসন্ত) আনার কথা বলে উত্তর-পূর্ব সিরিয়ায় কুর্দ বাহিনীর বিরুদ্ধে সেনা নামিয়ে দিয়েছেন তুর্কি প্রেসিডেন্ট রিচেপ তায়িপ এর্ডোয়ান। কুর্দ-সংখ্যাগরিষ্ঠ সিরিয়ান ডেমোক্র্যাটিক ফোর্স (এসডিএফ) পাল্টা প্রতিরোধ গড়ে তোলায় সংঘর্ষ বেধেছে। তাতে ইতিমধ্যেই ৮ জন সাধারণ নাগরিক-সহ প্রাণ গিয়েছে ১৫ জনের। আহত ৪০ জনেরও বেশি। এলোপাথাড়ি বোমা পড়ছে যত্রতত্র। ঘরছাড়া কয়েক লক্ষ। আইএসের হাতে মার খেয়ে আধমরা সিরিয়ায় ফের যুদ্ধ পরিস্থিতি।
এখনই সেনা অভিযান বন্ধ করার আর্জি জানিয়েছে ইরান। তুরস্কের এই আগ্রাসন ভাল চোখে দেখছে না ভারত, ইতালির মতো বহু দেশ। সংযত হওয়ার আর্জি জানিয়েছে আমেরিকাও। এর্ডোয়ান তবু একবগ্গাই। উল্টে তিনিই আজ ইউরোপীয় ইউনিয়নকে হুমকি দিয়ে বললেন, ‘‘আমাদের এই অভিযানকে আগ্রাসনের তকমা দেওয়া হলে, আঙ্কারা থেকে ৩৫ লক্ষ শরণার্থী এ বার সরাসরি ইউরোপেই পাঠাব।’’
উত্তর-পূর্ব সিরিয়ার একটা বড় অংশকে কুর্দদের দখলমুক্ত করতে চাইছেন এর্ডোয়ান। আইএস-দমনে মার্কিন সেনা জোটের অংশ হয়েও এই জোটের অপর শরিক কুর্দ বাহিনীকে বরাবর ‘জঙ্গি’ হিসেবেই দেখে এসেছে আঙ্কারা। আজ আঙ্কারায় নিজেদের দলীয় বৈঠকেও তিনি বলেন, ‘‘জঙ্গিদের নির্মূল করে তুরস্কের দক্ষিণ সীমান্ত তথা উত্তর-পূর্ব সিরিয়ায় শান্তি এবং স্থিতিশীলতা ফিরিয়ে আনাই এই অভিযানের লক্ষ্য।’’ সিরিয়ার আঞ্চলিক অখণ্ডতা বজায় রেখে সীমান্তে ‘সেফ জ়োন’ তৈরি করে শরণার্থীদের আশ্রয় দেওয়ার কথাও আগে বলতে শোনা গিয়েছিল এর্ডোয়ানকে। এখন তিনি জোর দিচ্ছেন ‘জঙ্গি-নিধনে’। আজ তিনি সগর্ব ঘোষণা করলেন, ‘‘ইতিমধ্যেই ১০৯ ‘কুর্দ জঙ্গিকে’ মেরে ফেলেছে তুর্কি বাহিনী। আস্তে আস্তে সব সাপ মারব।’’
গত কয়েক বছরে মার্কিন সেনা জোটের শরিক হিসেবে ‘পিপলস প্রোটেকশন গ্রুপ’ নামের এই কুর্দ বাহিনীই নাগাড়ে কোণঠাসা করে এসেছে আইএস-কে। কিন্তু তুরস্ক গোড়া থেকেই এদের রাষ্ট্রপুঞ্জ এবং আমেরিকার তালিকায় থাকা ‘নিষিদ্ধ’ জঙ্গি গোষ্ঠী ‘কুর্দিস্তান ওয়ার্কার্স পার্টি’-র অংশ বলেই মনে করে। স্বাধীন কুর্দিস্তানের দাবিতে নতুন করে ১৯৮৪ থেকে যারা বড়সড় ধাক্কা দিয়ে আসছে আঙ্কারাকে। অনেকের মতে, ঝোপ বুঝেই তাই এ বার তাই সীমান্ত পেরিয়ে কোপ মারছে তুরস্ক।
বিমান-হানা: ধোঁয়ায় ঢেকেছে তুরস্ক-সীমান্ত ঘেঁষা সিরিয়ার শহর আল আবিয়াদের আকাশ। ছবি: রয়টার্স
আর এমনটা যে হতে পারে, সেই আশঙ্কাটা তৈরি হয়েছিল গত বছর ডিসেম্বরে। আইএসের বিরুদ্ধে লড়াই ‘কার্যত শেষ’ বলে সিরিয়া থেকে সেনা সরানোর কথা ঘোষণা করেছিলেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। তখনই প্রশ্ন উঠেছিল, এ বার কুর্দদের কী হবে! টুইট করে ট্রাম্প আশ্বাস দিয়েছিলেন, কুর্দদের উপর হামলা হলে অর্থনৈতিক ভাবে গুঁড়িয়ে দেওয়া হবে তুরস্ককে। কুর্দদের নিরাপত্তা বন্দোবস্ত করতে ৩২ কিলোমিটার ‘সেফ জ়োন’ তৈরি করে দেওয়ার কথাও বলেছিলেন সে বার।
কুর্দ কথা
• কুর্দেরা দক্ষিণ-পূর্ব তুরস্ক, উত্তর-পশ্চিম সিরিয়া, উত্তর ইরাক, উত্তর-পশ্চিম ইরান ও দক্ষিণ-পশ্চিম আর্মেনিয়ার আদি বাসিন্দা।
• বর্তমানে তুরস্ক, ইরাক, সিরিয়া, ইরান ও আর্মেনিয়ার সীমান্তে প্রায় ৩ কোটি ৫০ লক্ষ কুর্দ বাস করেন।
• পশ্চিম এশিয়ার চতুর্থ বৃহত্তম জনগোষ্ঠী। কিন্তু কখনও স্বাধীন রাষ্ট্র গড়তে পারেননি কুর্দেরা।
সেই ৩২ কিলোমিটার ‘সেফ জ়োন’-এর কথা বলেই এ বার কুর্দদের উপর খড়্গহস্ত এর্ডোয়ান। বলছেন, ওখানে এত দিন ধরে তুরস্কে থাকা সিরীয় শরণার্থীদের আশ্রয় দেওয়া হবে। সূত্রের খবর, গত রবিবার এর্ডোয়ানের সঙ্গে ফোনে কথা বলে সিরিয়া থেকে হাজার দুয়েক সেনা সরিয়ে নেওয়ার কথা বলেন ট্রাম্প। আর তার পর-পরই সেনা অভিযান শুরু হয়ে যাওয়ায় এখন কুর্দ বাহিনী বলছে— আইএসের বিরুদ্ধে যুদ্ধে নিংড়ে নিয়ে এখন আমেরিকাই তাদের পিছন থেকে ছুরি মারছে। আমেরিকা অবশ্য এই অভিযোগ পুরোপুরি নস্যাৎ করে দিয়েছে। মার্কিন বিদেশসচিব মাইক পম্পেয়ো স্পষ্ট জানান, এই সেনা অভিযানের ব্যাপারে তুরস্ককে কোনও রকম সবুজ সঙ্কেত দেয়নি ওয়াশিংটন। আর ট্রাম্প আজ ফের ‘ভাতে মারার’ হুঁশিয়ারি দিয়েছেন আঙ্কারাকে। তাঁর কথায়, ‘‘অভিযানের নামে চূড়ান্ত অমানবিক উপায়ে কুর্দদের নিশ্চিহ্ন করাটা ওদের উদ্দেশ্য হলে, অর্থনৈতিক ভাবে শেষ করে দেব তুরস্ককে।’’ আমেরিকা চাইছে, সিরিয়ার শান্তি ফেরাতে হলে তার জন্য নির্দিষ্ট নীতি নেওয়া উচিত তুরস্কের।
কুর্দদের ভবিষ্যত নিয়ে সিরিয়া-তুরস্কের কথা বলে সমস্যা মেটানোর কথা বলছে রাশিয়াও। মস্কো থেকে রুশ বিদেশমন্ত্রী সের্গেই লেভেরভ আজ বলেন, ‘‘সিরিয়ায় নতুন করে অশান্তি তৈরি হোক, সেটা আমরা চাই না। সব পক্ষের সঙ্গে সুসম্পর্ক বজায় রেখে দেখা যাক কতটা কী করতে পারি।’’ দামাস্কাসের সঙ্গে কুর্দ নেতাদের আলাদা বৈঠকও চায় মস্কো।
এই পরিস্থিতিতে উত্তর-পূর্ব সিরিয়ার রাস আল-অইন এবং তাল-আবয়াদ শহরের জোরদার অভিযান চালাচ্ছে তুর্কি সেনা। একই সঙ্গে চলছে বিমান হানাও। তুরস্কের সাহায্যপ্রাপ্ত সিরিয়ার বিরোধী গোষ্ঠী ‘ফ্রি সিরিয়ান আর্মি’-ও অভিযানে যোগ দিয়েছে। তুরস্কের বিদেশ মন্ত্রকের দাবি, ইতিমধ্যেই সিরিয়ার ১৮১টি লক্ষ্যবস্তুতে আঘাত করেছে তাদের বিমান। যে কোনও মূল্যে ঘাঁটি আগলে থাকার কথা বলছে প্রায় ৪০ হাজার কুর্দ বাহিনীও। সেই অর্থে ময়দানে থেকে তাদের সাহায্য করার মতো মার্কিন বাহিনীও কিন্তু এখন সেখানে নেই।
সব মিলিয়ে যা পরিস্থিতি, তাতে আইএস না-আবার মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে! এই আশঙ্কার কথাও আমেরিকা মাথায় রাখছে বলে জানিয়েছেন পম্পেয়ো। ট্রাম্প যদিও ফাঁক পেয়ে কুর্দদেরও বিঁধতে ছাড়েননি। তাঁর কথায়, ‘‘জমি নিয়ে তুর্কি আর কুর্দদের লড়াইটা তো আজকের নয়। আইএসের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে কুর্দ বাহিনী আমাদের পাশে দাঁড়িয়েছিল ঠিকই, কিন্তু মনে রাখতে হবে, তখনও ওরা স্বার্থরক্ষার তাগিদে লড়ছিল। কই দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় তো ওরা আমাদের সঙ্গে কাঁধ মেলায়নি!’’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy