Princess Victoria Gouramma is the lost princess of Coorg dgtl
photos
‘ভাই’য়ের সঙ্গে বিয়ে দিতে চেয়েছিল রাজপরিবার, ভারতের এই রাজকন্যার ধর্ম মা ছিলেন রানি ভিক্টোরিয়া
বাকিংহাম রাজপ্রাসাদে সাদরে দিন কাটানো এই ভারতীয় রাজকন্যার নামকরণ হয়েছিল অতীত ব্রিটিশ সম্রাজ্ঞীর নামেই।
নিজস্ব প্রতিবেদন
শেষ আপডেট: ২০ মার্চ ২০২১ ১৪:১২
Share:Save:
এই খবরটি সেভ করে রাখার জন্য পাশের আইকনটি ক্লিক করুন।
০১১৭
ভারতীয় রাজপরিবারের সন্তানদের মধ্যে তিনিই প্রথম গিয়েছিলেন ব্রিটেনে। ধর্মান্তরিত হয়েছিলেন খ্রিস্টান বিশ্বাসে। ব্রিটিশ রাজপরিবার যখন আজ বর্ণবিদ্বেষের অভিযোগে ধস্ত, তখন বিস্মৃতির অতল থেকে উঁকি দিয়ে যান রাজকন্যা ভিক্টোরিয়া গৌরাম্মা। কোদাগু বা কুর্গের শেষ রাজা চিকবীর রাজেন্দ্রর মেয়ে ছিলেন তিনি। বাকিংহাম রাজপ্রাসাদে সাদরে দিন কাটানো এই ভারতীয় রাজকন্যার নামকরণ হয়েছিল অতীত ব্রিটিশ সম্রাজ্ঞীর নামেই।
০২১৭
১৮৩৪ খ্রিস্টাব্দের ২৪ এপ্রিল ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির বিরুদ্ধে যুদ্ধে পরাজিত হন কুর্গের তৎকালীন রাজা চিক্কা বীররাজেন্দ্র। সেনা আধিকারিক জেমস স্টুয়ার্ট ফ্রেজারের নির্দেশে তাঁকে সপরিবার নির্বাসনে পাঠানো হয় বারাণসীতে। সেখানেই ১৮৪১ খ্রিস্টাব্দের ফেব্রুয়ারি মাসের এক রবিবার জন্ম হয় গৌরাম্মার।
০৩১৭
তাঁর জন্মের কিছু দিন পরেই মৃত্যু হয় তাঁর মায়ের। মাতৃহীন কন্যা প্রথম থেকেই খুব কাছের ছিলেন তাঁর বাবার। রাজনৈতিক বন্দি হিসেবে ১৪ বছর নির্বাসিত জীবন কাটানোর পরে ১৮৫২ খ্রিস্টাব্দে লন্ডনে যান বীররাজেন্দ্র। সঙ্গে, ১১ বছরের গৌরাম্মা।
০৪১৭
বীররাজেন্দ্র ব্রিটিশ দরবারে নিজের হৃত সম্পত্তি ফিরে পাওয়ার দাবি জানাতে গিয়েছিলেন। সঙ্গে ছিলেন তাঁর বন্ধু উইলিয়াম জেফারসন। জেফারসনই তাঁকে পরামর্শ দিয়েছিলেন আগে গৌরাম্মার ভবিষ্যৎ সুরক্ষিত করার বিষয়টি সুনিশ্চিত করতে। তার পর হৃত সম্পদ পুনরুদ্ধারের চেষ্টা করতে।
০৫১৭
কন্যা-সহ বীররাজেন্দ্রর লন্ডন আগমনের খবর প্রকাশিত হয়েছিল ইংল্যান্ডের সংবাদপত্রে। পুরনো সেই প্রতিবেদনে গৌরাম্মাকে অত্যন্ত গৌরবর্ণা বলে বর্ণনা করা হয়েছে। বহু ইতিহাসবিদের প্রশ্ন, তা হলে কি গায়ের রঙের জন্যই রানি ভিক্টোরিয়ার প্রিয়পাত্রী হয়ে উঠতে পেরেছিলেন এই রাজকন্যা?
০৬১৭
বীররাজেন্দ্রর ইচ্ছায় ধর্মান্তরিত হন রাজকন্যা গৌরাম্মা। সেই পর্বে তাঁর গডমাদার বা ধর্মমা হয়েছিলেন রানি ভিক্টোরিয়া। তাঁর ধর্মান্তরণের খবর গুরুত্ব দিয়ে প্রকাশিত হয়েছিল তৎকালীন ব্রিটিশ সংপাদপত্রে। রানি ভিক্টোরিয়ার নামে নতুন নাম হয় রাজকন্যার। তিনি পরিচিত হন ‘রাজকুমারি ভিক্টোরিয়া গৌরাম্মা’ নামে।
০৭১৭
ব্রিটিশ সেনাবাহিনীর মেজর ড্রামন্ড এবং তাঁর স্ত্রীর কাছে থাকতেন গৌরাম্মা। তাঁদের কাছেই রপ্ত করেছিলেন পাশ্চাত্যের আদবকায়দা। রাজকীয় আচরণের পাশাপাশি তাঁর চরিত্রের অন্যতম বৈশিষ্ট ছিল হাসিখুশি প্রাণোচ্ছ্বল দিকটিও। তবে রাজপরিবারের ঘনিষ্ঠ হওয়ার সুবাদে তাঁর জীবন সবসময়েই থাকত প্রচারের আলোর আতসকাচের নীচে। মাঝে মাঝে তাতে দমবন্ধ লাগত রাজকন্যার। পরিবর্তে তিনি চাইতেন আরও কিছু নিভৃত অবসর।
০৮১৭
বিস্মৃত এই রাজকন্যার জীবনী লিখেছেন সি পি বেলিয়াপ্পা। ‘ভিক্টোরিয়া গৌরাম্মা: দ্য লস্ট প্রিন্সেস অব কুর্গ’ নামে সেই বইয়ে তিনি এনেছেন মহারাজা দলীপ সিংহের কথা। শিখ সাম্রাজ্যের শেষ মহারাজা দলীপ সিংহ-সহ আরও কয়েক জন আশ্রয় পেয়েছিলেন রানি ভিক্টোরিয়ার ছায়ায়। তাঁরা ছিলেন রানির ‘পালিত ধর্ম সন্তানসন্ততি’।
০৯১৭
১৮৫৩ সালে ১৫ বছর বয়সে ব্রিটেনে নির্বাসিত হয়েছিলেন দলীপ সিংহ। তিনিও ধর্মান্তরিত হয়েছিলেন। তবে শোনা যায়, এই সিদ্ধান্ত নিয়ে তাঁর অনুশোচনা ছিল। ১৮৮৬ খ্রিস্টাব্দে তিনি ফের ফিরে আসেন শিখ বিশ্বাসে।
১০১৭
দলীপ সিংহের সঙ্গে গৌরাম্মার বিয়ে দিতে চেয়েছিল বাকিংবাম প্রাসাদ। কিন্তু তাদের সেই চেষ্টা সফল হয়নি। কারণ দু’জনের কারওর তরফেই একে অন্যের প্রতি কোনও আকর্ষণ তৈরি হয়নি। বরং, গৌরাম্মাকে ‘নিজের বোন’ বলে পরিচয় দিতেন দলীপ সিংহ।
১১১৭
এই বিয়ের চেষ্টাকে ভাল ভাবে নেননি গৌরাম্মা। ব্রিটিশ রাজপরিবারের প্রতি তাঁর ধারণা পাল্টে যায়। মোহভঙ্গ গৌরাম্মা আসক্ত হন সেনাবাহিনীর মধ্যবয়সি আধিকারিক কর্নেল জন ক্যাম্পবেলের প্রতি। দ্বিগুণ বয়সি এই মেজরকে বিয়ে করে নতুন সংসার পাতেন গৌরাম্মা।
১২১৭
কিন্তু সেই সংসার দ্রুত তাসের ঘরের মতো ভেঙে পড়ল যখন রাজকন্যা জানতে পারেন মেজরের জুয়ায় আসক্তির কথা। স্বামী যে শুধু তাঁর সম্পত্তিতেই আগ্রহী, সে কথাও গোপন থাকল না গৌরাম্মার কাছে। ভগ্ন প্রেমের পাশাপাশি মানসিক আঘাত ক্রমশ তীব্র হচ্ছিল তাঁর প্রতি রাজপরিবারের আচরণেও। যতই তাঁকে ‘গৌরবর্ণা’ বলা হোক না কেন, ব্রিটিশ রাজপরিবারের কাছে গৌরাম্মা ছিলেন ‘বহিরাগত’-ই।
১৩১৭
অভিযোগ, রানি ভিক্টোরিয়ার আদেশে বাবার সঙ্গে দেখা করতে পারতেন না গৌরাম্মা। রানির আশঙ্কা ছিল, ‘দেশীয় রাজা’ তাঁর বুদ্ধি দিয়ে নষ্ট করে দেবে গৌরাম্মার মানসিক গঠন। এক দিকে নিজের শিকড়ের থেকে ক্রমশ দূরে চলে যাওয়া। অন্য দিকে ব্রিটিশ রাজপরিবারের কাছেও ব্রাত্য হয়ে থাকা। এই টানাপড়েনে বিদ্ধ হচ্ছিল গৌরাম্মার জীবন।
১৪১৭
১৮৬১ খ্রিস্টাব্দে জন্ম হয় গৌরাম্মার একমাত্র সন্তান এডিথের। সিঙ্গল মাদার হিসেবেই মেয়েকে বড় করতে হচ্ছিল। কারণ গৌরাম্মার সম্পত্তি ছাড়া অন্য কিছুতে বিশেষ আগ্রহী ছিলেন না তাঁর স্বামী।
১৫১৭
একাকী মা হয়েও মেয়েকে বেশি দিন বড় করা হল না গৌরাম্মার। সকলের অজান্তে তাঁর কাশির সঙ্গে রক্ত উঠছিল। এক দিন রাজরোগই কেড়ে নিল রাজকন্যাকে। ১৮৬৩ সালে নিজের ২৩ জন্মদিনের কিছু আগে মৃত্যু হয় গৌরাম্মার। তাঁর মতো শৈশবেই মাতৃহীন হয়ে পড়ে ২ বছরের এডিথ।
১৬১৭
গৌরাম্মার যে কোনও সন্তান ছিল, প্রথমে জানতেন না জীবনীকার বেলিয়াপ্পা। সংবাদপত্রে প্রকাশিত একটি নিবন্ধে তিনি লিখেছেন, তাঁর ভুল ভাঙিয়ে দেন জনৈকা অ্যান ফিলিপ্স। মেজর ক্যাম্পবেল এবং তাঁর প্রথম স্ত্রী মার্গারেট ম্যাথিউ-এর উত্তরসূরি এই অ্যান। তিনি নিজেদের পারিবারিক অ্যালবাম থেকে এডিথকে নিয়ে গৌরাম্মার ছবি পাঠান বেলিয়াপ্পাকে।
১৭১৭
গৌরাম্মার উত্তরসূরি রবার্ট ইয়ার্ডলে এখন সপরিবার থাকেন অস্ট্রেলিয়ায়। গৌরাম্মা নিজে ঘুমিয়ে আছেন লন্ডনের ব্রম্পটন সমাধিক্ষেত্রের এক মলিন কবরে। ১৫০ বছরেরও বেশি সময় পেরিয়ে এসে আজ, বিস্মৃত এই রাজকন্যার ক্ষতের সঙ্গে কোথায় যেন মিলেমিশে একাকার হয়ে যায় মেগান মার্কলের যন্ত্রণা।