বাংলাদেশের স্বপ্নের সেতু। ফাইল চিত্র।
শনিবার পদ্মা সেতুর উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কণ্ঠে শোনা গেল সুকান্ত ভট্টাচার্যের কবিতার লাইন। হাসিনা বলেন, ‘‘কারও বিরুদ্ধে আমার কোনও অনুযোগ নেই। আমরা নানা প্রতিকূলতা পেরিয়ে এগিয়ে যাচ্ছি। আমরা দেশবাসীকে নিয়ে সব সমস্যা মোকাবিলা করে যাচ্ছি।’’ হাসিনা এর পর সুকান্তের কবিতাতে থেকে দুটি লাইন শোনান, ‘‘জ্বলে পুড়ে-মরে ছারখার, তবু মাথা নোয়াবার নয়। আমরা মাথা নোয়াইনি, আমরা মাথা নোয়াব না। জাতির পিতা আমাদের মাথা নোয়াতে শেখাননি।’’ ২০১০ সাল। পদ্মার উপর একটি দোতলা সেতু তৈরির পরিকল্পনার কথা ঘোষণা করে বাংলাদেশ সরকার। সেতুর নীচতলায় থাকবে রেলপথ। উপরে চার লেনের চওড়া রাস্তায় ছুটবে গাড়ি। বলা হয়, রেলপথে কলকাতা থেকে ঢাকা যেতে সময় লাগবে মাত্র ছয় থেকে সাড়ে ছয় ঘণ্টা।
২০১২ সালে দেশের জাতীয় সংসদে পদ্মা সেতু নির্মাণকে মুক্তিযুদ্ধের সঙ্গে তুলনা করেন বাংলাদেশের শেখ হাসিনা। সব ঠিকঠাক চলছিল। কিন্তু হঠাৎই ছন্দপতন। এত বড় প্রকল্প থেকে সরে গেল বিশ্বব্যাঙ্ক। কিন্তু স্বপ্নপূরণে বদ্ধপরিকর হাসিনা জানালেন, বাংলাদেশ নিজেই শেষ করবে সেতুর কাজ। অনেকে মনে করেছিলেন অসম্ভব। কিন্তু ২০১২ সালের জুলাই মাসে বাংলাদেশ মন্ত্রিসভা জানিয়ে দেয়, নিজেদের স্বপ্ন নিজেরাই পূরণ করবে তারা। কেউ কেউ অবশ্য দাবি করেছেন, বিদেশি সাহায্য নেওয়া হয়েছে। কিন্তু সেই সব দাবি-অভিযোগ নস্যাৎ করে দিয়েছে বাংলাদেশ সরকার। শনিবার ঐতিহাসিক মুহূর্তের সাক্ষী হল বাংলাদেশ। মাওয়া পয়েন্ট টোল দিয়ে নয়া ইতিহাস তৈরি করল বাংলাদেশ।
কী কী রয়েছে সেতুতে? পদ্মা সেতুকে জলের মধ্যে ধরে রেখেছে ৪০টি স্তম্ভ। প্রত্যেকটি স্তম্ভ তৈরি হয়েছে মজবুত পাইল ইস্পাত দিয়ে। জলের নীচে ১২২ মিটার পর্যন্ত গভীরে গিয়েছে এই স্তম্ভের ভিত। পৃথিবীর আর কোনও দেশে আর কোনও সেতুর স্তম্ভ এত গভীরে নেই। পদ্মা সেতুর ভূমিকম্প প্রতিরোধ ব্যবস্থা বা ‘ফ্রিকশন পেন্ডুলাম বিয়ারিং’ পৃথিবীর অন্য সব সেতুর চেয়ে অনেক বেশি। প্রায় ১০ হাজার টন। এই ক্ষমতায় এই সেতু রিখটার স্কেলে ৯ মাত্রার ভূমিকম্পেও অনায়াসে টিকে যাবে। ২০১৪ সালে পদ্মার উপর শুরু হয় সেতু নির্মাণের কাজ। চিন থেকে ঋণ ছিল। দোতলা এই পদ্মা সেতুর পিলার সংখ্যা মোট ৪২ টি। স্প্যান সংখ্যা ৪১ টি। শেষ স্প্যানটি বসানো হয় ২০২০ সালের ১০ ডিসেম্বর। সেতু নির্মাণে যুক্ত ছিলেন প্রায় ৪ হাজার মানুষ। গোটা প্রকল্পের জন্য মোট ৯১৮ হেক্টর জমি নেওয়া হয়েছিল। সব মিলিয়ে পদ্মা সেতু তৈরিতে খরচ হয়েছে প্রায় ৩০ হাজার ১৯৩ কোটি টাকা। গত ফেব্রুয়ারি মাসেই ব্যয়ের পরিমাণ ২৪ হাজার ৫৪৭ কোটি ৮১ লাখ টাকা বলে জানিয়েছিল বাংলাদেশ সরকার।
পদ্মা সেতুর ফলে যাতায়াতের অনেকটা সুবিধা হবে। কলকাতা থেকে বাসে ঢাকায় আসতে হলে কিছু দিন আগে পর্যন্ত পদ্মা পার হতে স্টিমারের প্রয়োজন হত। পদ্মা সেতু চালু হলে সড়কপথেই সরাসরি ঢাকায় পৌঁছনো যাবে। কলকাতা থেকে ঢাকার দূরত্ব অন্তত ৫০ শতাংশ কমে যাবে। আগে কলকাতা থেকে ঢাকা, ৪০০ কিলোমিটার দূরত্ব অতিক্রম করতে সময় লাগত ১০ ঘণ্টা। এখন তা মোটামুটি চার ঘণ্টায় হয়ে যাবে। আর রেলপথে পৌঁছতে সময় লাগবে মোটামুটি সাড়ে ছ’ঘণ্টা। সব ঠিক থাকলে সেপ্টেম্বরের প্রথম সপ্তাহেই শেখ হাসিনা ভারত সফরে যেতে পারেন এই পদ্মা সেতু দিয়েই।
শুধু যে কলকাতা-ঢাকার দূরত্ব কমাবে তাই নয়, পদ্মা সেতুর ফলে বঙ্গোপসাগর তীরের মংলা এবং চট্টগ্রাম বন্দরের দূরত্ব একশো কিলোমিটার কমে যাবে। সংশ্লিষ্ট বন্দর দু’টিকে ব্যবহার করার অনুমতি দিয়েছে বাংলাদেশ সরকার। ফলে উত্তর-পূর্ব রাজ্যগুলির সঙ্গে ভারতের মূল ভূখণ্ডের যোগাযোগ সুগম হবে। দুই দেশই আশা করছে, শেখ হাসিনার সফরের আগেই ভারত-বাংলাদেশ মুক্ত বাণিজ্য চুক্তির খুঁটিনাটি চূড়ান্ত হয়ে যাবে। পদ্মা সেতু দু’দেশের বাণিজ্যেও নতুন সেতুবন্ধন করবে।
‘প্রথম আলো’ জানাচ্ছে, পদ্মা সেতুর উদ্বোধনের সাক্ষী হতে শুক্রবার রাত থেকে জাজিরার নাওডোবা ও শিবচরের কাঁঠালবাড়িতে মানুষ আসতে শুরু করেছেন। দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের ২১ জেলা ছাড়াও চাঁদপুর, লক্ষ্মীপুর, কুমিল্লা, নোয়াখালী, নারায়ণগঞ্জ, মুন্সিগঞ্জ, গাজীপুর ও মানিকগঞ্জ থেকে মানুষ এসেছেন। সকাল ৮টার মধ্যে জাজিরা ও শিবচরের অন্তত চারটি ইউনিয়নের সড়ক লোকে-লোকারণ্য হয়ে যায়। গ্রামের বিভিন্ন সড়ক ধরে মানুষ সমাবেশ স্থলে আসতে থাকেন। সব মিলিয়ে, ইতিহাস তৈরি হল শনিবার।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy