Advertisement
২৩ ডিসেম্বর ২০২৪

‘বাবার কথা খুব মনে হচ্ছে, তিনিই আমার প্রথম শিক্ষক’

এ দিন নোবেল কমিটির ফোনটা যখন এসেছিল, তখন তিনি ঘুমোচ্ছিলেন। ঘুম থেকে উঠে নোবেলপ্রাপ্তির খবর শুনেছেন, আবার ঘুমিয়ে পড়েছেন উচ্ছ্বাসহীন ভাবেই।

দম্পতির বিশ্বজয়: অর্থনীতিতে নোবেল জয়ের খবর পাওয়ার পরে বস্টনের বাড়িতে অভিজিৎ বিনায়ক বন্দ্যোপাধ্যায় ও তাঁর স্ত্রী এস্থার দুফলো। সোমবার। এএফপি

দম্পতির বিশ্বজয়: অর্থনীতিতে নোবেল জয়ের খবর পাওয়ার পরে বস্টনের বাড়িতে অভিজিৎ বিনায়ক বন্দ্যোপাধ্যায় ও তাঁর স্ত্রী এস্থার দুফলো। সোমবার। এএফপি

স্বাতী ভট্টাচার্য
শেষ আপডেট: ১৫ অক্টোবর ২০১৯ ০৩:৩৪
Share: Save:

আশঙ্কা ছিল, ফোন নিশ্চয়ই ব্যস্ত থাকবে। নোবেল কমিটি যাঁকে ফোন করে, তাঁর ফোন কি আর তারপর চুপ থাকে? কিন্তু বাজল, আর মাত্র দু’বার বাজতেই তুললেন। যেমন শান্ত, সামান্য স্তিমিত স্বরে বরাবর ‘হ্যালো’ বলেন, ঠিক তেমনই বললেন। যেন তেমন কিছুই হয়নি। ভাল গান, ভাল বই নিয়ে তবু তাঁর উচ্ছ্বাস দেখা যায়। নিজের কাজ নিয়ে যখন কথা বলেন, তখন ধীরে, প্রায় নৈর্ব্যক্তিক স্বর শোনা যায় তাঁর গলায়।

এ দিন নোবেল কমিটির ফোনটা যখন এসেছিল, তখন তিনি ঘুমোচ্ছিলেন। ঘুম থেকে উঠে নোবেলপ্রাপ্তির খবর শুনেছেন, আবার ঘুমিয়ে পড়েছেন উচ্ছ্বাসহীন ভাবেই। যদিও যাঁরা তাঁকে জানেন, তাঁরা জানেন কী প্রবল প্যাশন নিয়ে কাজ করেন তিনি, তাঁর সহকর্মীরা। যার ফলে মাত্র দুই দশকে একটি নতুন পদ্ধতি প্রতিষ্ঠা পেল অর্থনীতির মূল ধারায়।

কী মনে হল খবরটা পেয়ে? বস্টনে তাঁর বাসভবন থেকে অভিজিৎ বিনায়ক বন্দ্যোপাধ্যায় বললেন, ‘‘এটা খুবই ভাল হল যে, যে পদ্ধতিতে আমরা কাজ করছি তা স্বীকৃতি পেল। প্রতিষ্ঠা পেল। যখন শুরু করেছিলাম, বারবার শুনতে হয়েছে, এটা কি অর্থনীতি? এটা করে কি কিছু শেখা যায়? কেউ বলেছেন, এত ঝামেলা করে লাভ কী? কেউ বলেছেন,

এগুলো কি খেলা হচ্ছে?’ একটু থেমে বললেন, ‘এটা একটা ক্রাউনিং মোমেন্ট (জয়ের মুহূর্ত)। এখন আমাদের রান্ডমাইজ় কন্ট্রোল ট্রায়াল অর্থনীতির একেবারে কেন্দ্রে।’’

যা তিনি উল্লেখ করলেন না তা হল এই যে, তাঁর পদ্ধতিতে যাঁরা আস্থা রাখেননি, তাঁদের মধ্যে তাঁর অতি পরিচিত, অতি ঘনিষ্ঠ সহকর্মীরাও ছিলেন। তাঁদের মধ্যে রয়েছেন বাঙালি অর্থনীতিবিদরাও। বিরোধিতা যে সর্বদা বিশেষজ্ঞ মহলে বিতর্কে আটকে ছিল, এমনও নয়। ভ্রান্ত পদ্ধতি প্রয়োগের আরোপ এসেছে, তাচ্ছিল্যের তিক্ততা বর্ষিত হয়েছে। সাক্ষ্যভিত্তিক নীতি তৈরি করার বিরুদ্ধে প্রায় জনমত তৈরি করতে নেমে পড়েছিলেন কোনও কোনও অর্থনীতিবিদ। বিশেষত ভারতে একটা সমালোচনা খুবই শোনা যেত যে, যে দেশ এত গরিব, সেখানে দারিদ্র নিরসনে কোন পদ্ধতি কার্যকর হবে তা বোঝার জন্য এত টাকা খরচ কেন? এ কি অপচয় নয়? কিন্তু অভিজিৎ ও তাঁর সহযোগীরা বারবার বুঝিয়েছেন, কী ভাবে প্রকল্প তৈরি করলে টাকাটা বাস্তবিক গরিবের কাজে লাগে, আগে তা না বুঝলে তো সবটাই অপচয়। আজ অর্থনীতির গবেষণার সিংহভাগ হচ্ছে ‘আরসিটি’ পদ্ধতিতে। গবেষকরা ফিল্ডে গিয়ে খুঁটিয়ে তথ্য সংগ্রহ এবং তার অনুপুঙ্খ বিশ্লেষণ করছেন। তত্ত্বসর্বস্ব অর্থনীতির প্রবক্তারা পিছু হটছিলেন। এ বার দুধ কা দুধ, পানি কা পানি হয়ে গেল।
এ বার কি অন্য ভাবে ভাবতে হবে অর্থনীতি নিয়ে? অভিজিৎ বললেন, ‘একটা বোতাম টিপলে অর্থনীতির সব সমস্যা দূর হয়ে যাবে, এমন চিন্তা এ বার বন্ধ করা দরকার। প্রত্যেকটা বিষয়কে আলাদা করে, তার সমস্যা চিহ্নিত করতে হবে, এবং তার সমাধান নির্দিষ্ট করতে হবে।’ বিশ্বের বহু রাষ্ট্র আজ এই পথেই দারিদ্র মুক্তি খুঁজছে। ভারতেও আঠারো-উনিশটা রাজ্যের সরকার নানা সময়ে এই উপায়ে কাজ করেছে। তার মধ্যে রয়েছে পশ্চিমবঙ্গও। এই সব হাতে-কলমে কাজ ইতিমধ্যেই প্রতিষ্ঠা করেছে তাঁদের পদ্ধতির মূল্য। ‘পরিবর্তন এসে গিয়েছে, পদ্ধতি তার মান্যতাও পেয়ে গিয়েছে অনেক আগেই। সেই জন্যই সরকারগুলো টাকা ঢালছে এই পদ্ধতিতে শিক্ষা, স্বাস্থ্য, পুষ্টির নানা প্রকল্পের আগাম মূল্যায়নে।’
বিশ্বের সেরা প্রতিষ্ঠানগুলির অর্থনীতির চর্চা যাঁরা করেন, তাঁরা জানেন যে অভিজিৎ বন্দ্যোপাধ্যায়, এস্থার দুফলো, এবং তাঁদের সহকর্মীদের নাম নোবেল পুরস্কারের প্রসঙ্গে বারবার উঠেছে। এ বছর কি পুরস্কারের ঘোষণা কিছুটা হলেও প্রত্যাশা করছিলেন? ‘একেবারেই অপ্রত্যাশিত এই খবর। আমি মনে করি, আমার চাইতে কৃতী অর্থনীতিবিদ অনেকে আছেন। তাঁরা পুরস্কার পেলে আমি খুশি হতাম।’
কার কথা মনে হচ্ছে? ‘মায়ের কথা। মা (নির্মলা বন্দ্যোপাধ্যায়) কলকাতায় আছেন, এখনও হয়তো জানেন না। আর খুব বেশি মনে হচ্ছে বাবার কথা। বাবা (দীপক বন্দ্যোপাধ্যায়) অর্থনীতিবিদ ছিলেন। তাঁর কাছে এই পুরস্কারের বিশেষ অর্থ থাকত। তিনিই আমার প্রথম শিক্ষক।’ এই প্রথম গলা ধরে এল পুত্রের, বাবার স্মৃতিতে যিনি প্রেসিডেন্সি বিশ্ববিদ্যালয়ে শুরু করেছেন বাৎসরিক স্মারক বক্তৃতা।

অন্য বিষয়গুলি:

Abhijit Vinayak Banerjee Nobel Prize Esther Duflo
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy