হোয়াইট হাউসে সাংবাদিক বৈঠকে নরেন্দ্র মোদী। বৃহস্পতিবার। ছবি: রয়টার্স।
প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পরে ভারতীয় সাংবাদিকদের প্রশ্নের মুখোমুখি হননি কোনও দিন। আমেরিকার মাটিতে দাঁড়িয়ে কিন্তু প্রশ্ন নিলেন এবং গণতন্ত্রের জয়গানই গাইলেন নরেন্দ্র মোদী। বললেন, ‘‘ভারতের ধমনীতে প্রবাহিত হচ্ছে গণতন্ত্র। ভারত বাঁচে গণতন্ত্রে। পূর্বসূরিরা গণতন্ত্রের বয়ানেই লিখেছিলেন সংবিধান। মোদী সরকারও গণতন্ত্রেরই উপাসক। জাতি, ধর্মের কোনও বৈষম্য সেখানে নেই।’’
আজ হোয়াইট হাউসের ইস্ট উইংয়ের মঞ্চে আমেরিকার এক সাংবাদিকের ধর্মীয় বৈষম্য সংক্রান্ত তীক্ষ্ণ প্রশ্নের উত্তরে এই রকমই দাবি করলেন মোদী। তাঁর বক্তব্য, “আমাদের সরকারে বৈষম্যের কোনও জায়গাই নেই। কোনও ভেদভাব নেই। ধর্ম জাতি, ভৌগোলিক ভিত্তিতে কোনও বৈষম্য করা হয় না। আমাদের এবং আমেরিকার রক্তেই রয়েছে গণতন্ত্র। ভারত এবং আমার সরকার সংবিধান মেনে চলে।”
গণতন্ত্রের অন্যতম স্তম্ভ সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতা নিয়ে অবশ্য আলাদা করে কিছু বলেননি প্রধানমন্ত্রী। দেশে গত ন’বছরে তাঁকে কোনও সাংবাদিক সম্মেলন করতে দেখা যায়নি। কূটনৈতিক সূত্রের খবর, এই সফরেও সাংবাদিক সম্মেলন হোক, এটা একেবারেই চায়নি সাউথ ব্লক। মোদী আমেরিকার বিমানে ওঠার একদিন আগে পর্যন্ত সেই অবস্থানেই ছিল তারা। তবে সূত্রের খবর, মোদীকে সাংবাদিক বৈঠক করানোর জন্য এ বার নাছোড়বান্দা ছিল জো বাইডেন প্রশাসন। আর তাই শেষ পর্যন্ত রাজি হতেই হল মোদীকে। শুধু হতেই হল না, তাঁর সরকারের দিকে আসা বৈষম্যের অভিযোগও সামলাতে হল।
কূটনৈতিক সূত্রের মতে, এই অভিযোগ আসবে জেনেই গোড়ায় সাংবাদিক সম্মেলনে রাজি ছিল না সাউথ ব্লক। অন্য দিকে প্রধানমন্ত্রীর উত্তরের পরে কংগ্রেসের মুখপাত্র পবন খেরার মন্তব্য, ‘‘টেলিপ্রম্পটার থাকা সত্ত্বেও এমন নিষ্প্রভ, মধ্যমেধার উত্তর! আন্তর্জাতিক মঞ্চে এমন মধ্যমেধা মানা যায় না। দেশেও কেন প্রধানমন্ত্রী সাংবাদিক সম্মেলন এড়িয়ে যান বোঝা গেল।’’
মোদীর সফরকে ঘিরে উত্তেজনা ভারতে এবং আমেরিকায় যতই উচ্চগ্রামে যাক না কেন, ডেমোক্র্যাট সরকারের উপরে এ নিয়ে চাপও কম ছিল না বলে মনে করছে কূটনৈতিক মহল। ভারতে মানবাধিকার, ধর্মনিরপেক্ষতা, সংখ্যালঘুর অধিকারের মতো বিভিন্ন বিষয় নিয়ে ধারাবাহিক ভাবে রিপোর্ট জমা দিয়েছে আমেরিকার বিভিন্ন সরকারি ও বেসরকারি সংস্থা। বিমানবন্দরে মোদীকে স্বাগত জানাতে ছিলেন না কোনও শীর্ষ নেতা। আমেরিকার কংগ্রেসে মোদীর বক্তৃতা বয়কট করেছেন দুই ডেমোক্র্যাট সদস্য। ফলে মোদীর সফর নিয়ে ঢাকঢোল বাজানোর পাশাপাশি হোয়াইট হাউসের উপরে দায়ও তৈরি হয়েছিল, নিজের দেশে সাংবাদিকদের প্রশ্নের সামনে মোদীকে দাঁড় করানোর। আর তাই শেষ পর্যন্ত যখন রাজি করানো গেল মোদীকে, কূটনৈতিক মহল জানাচ্ছে, কিছুটা স্বস্তিতে এবং বাকিটা কটাক্ষে হোয়াইট হাউসের জাতীয় নিরাপত্তা বিষয় মুখপাত্র জন কার্বিকে আজ বলতে শোনা গেল, ‘‘এটা বড় ব্যাপার!’’ আর সাংবাদিক সম্মেলনে প্রত্যাশিত ভাবেই ভারতের বৈষম্যের অভিযোগ নিয়ে প্রশ্নের মুখে পড়লেন শুধু মোদী নন, পাশে দাঁড়ানো প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনও।
বৈঠক শুরু আগেই বাইডেন তাৎপর্যপূর্ণ বার্তা দিয়ে বলেছিলেন, ‘‘আইনের চোখে সাম্য, মত প্রকাশের স্বাধীনতা, ধর্মীয় বহুত্ব এবং জনবৈচিত্র হল জাতির ইতিহাসে এমন কিছু মূল নীতি, যা চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েও নিজেকে অটুট রেখেছে, এগিয়ে নিয়ে গিয়েছে।’’ সাংবাদিক সম্মেলনে তাঁর কাছেও জানতে চাওয়া হয়, মুসলিম ও অন্য সংখ্যালঘুদের ধর্মীয় বৈষম্য, মত প্রকাশের স্বাধীনতা হরণের মতো অভিযোগ বাইডেনের দলের সদস্যরাই করছেন মোদী সরকারের বিরুদ্ধে। তা নিয়ে আমেরিকার প্রেসিডেন্ট কি কোনও কথা বলতে চান ভারতের প্রধানমন্ত্রীকে? বাইডেন কিছুটা সতর্ক, সাবধানী ভঙ্গিতে বলেন, “প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে আমার গণতন্ত্র নিয়ে ভাল আলোচনা হয়েছে। আমাদের মধ্যে খোলামেলা আলোচনা হয়ে থাকে। আমরা দু’দেশই গণতন্ত্রে বিশ্বাসী।” তারই খেই ধরে প্রধানমন্ত্রীকে বলতে শোনা যায়, “প্রেসিডেন্ট বাইডেন বলেই তো দিলেন দু’দেশেরই ডিএনএ-তে গণতন্ত্র রয়েছে।”
দেশের মাটিতে প্রধানমন্ত্রী নিয়মিত ভাবে দিনে একাধিক বক্তৃতা দিয়ে থাকেন। নিজের ‘মনের কথা’ প্রতি রবিবার রেডিয়ো অনুষ্ঠানেও বলে থাকেন। কিন্তু অন্যের প্রশ্নের জবাব দিতে তাঁর অনীহা লক্ষ করেছে রাজনৈতিক শিবির। তিনি এবং তাঁর সরকার শেষ পর্যন্ত সাংবাদিক সম্মেলনে রাজি হওয়ার পর তাৎপর্যপূর্ণ ভাবে কার্বি বলেন, “আমরা খুবই কৃতজ্ঞ যে, মোদী তাঁর এই সফরে সাংবাদিক সম্মেলনে অংশ নিচ্ছেন। আমরা মনে করি বিষয়টি গুরুত্বপূর্ণ। আমরা আহ্লাদিত যে তিনিও সেটা মনে করছেন।”
কোনও প্রধানমন্ত্রী দেশের বাইরে গেলে সাধারণ ভাবে সরব হয় না বিরোধী দল। কিন্তু এ ক্ষেত্রে আসরে নামতে দেরি করেনি কংগ্রেস। মুখপাত্র সুপ্রিয়া শ্রীনতে সকালেই টুইট করে কার্বিকে উদ্ধৃত করেন। তার পর কটাক্ষ করে লেখেন, ‘‘এটি একটি আন্তর্জাতিক গৌরব!’’ কার্বির যে উদ্ধৃতি তিনি পোস্ট করেছেন, সেখানে হোয়াইট হাউসের মুখপাত্রকে বলতে শোনা গিয়েছে, ‘‘সংবাদমাধ্যমের প্রশ্নের জবাব দেওয়া মোদীর পক্ষে বিরল ঘটনা। ন’বছর আগে প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পর থেকে আজ পর্যন্ত তিনি দেশে একটিও সাংবাদিক সম্মেলন করেননি। ২০১৯ সালের মে মাসে সাংবাদিক সম্মেলন করেছিলেন ঠিকই, কিন্তু কোনও প্রশ্ন নেননি।’’
আমেরিকার ডেমোক্র্যাট পার্টির দুই কংগ্রেস সদস্য ইলহান ওমর এবং রাশিদা তালেব ইতিমধ্যে মোদীর যৌথ অধিবেশনের বক্তৃতা বয়কট করেছেন। দুই মুসলিম নেত্রীরই বক্তব্য, মোদীর সরকার ভারতে ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের উপর নিপীড়ন করে থাকে। মানবাধিকার কর্মী এবং সাংবাদিকদের আক্রমণ করে। রাশিদা আরও এক ধাপ এগিয়ে এ-ও বলেছেন, ‘‘মানবাধিকার লঙ্ঘন, গণতন্ত্র-বিরোধিতার দীর্ঘ ইতিহাস যাঁর রয়েছে, আমাদের দেশের রাজধানীতে সেই মোদীকে একটা মঞ্চ দেওয়া হয়েছে। এটা অত্যন্ত লজ্জার।’’
সরব হয়েছেন আমেরিকার প্রাক্তন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামাও। তাঁর কথায়, “কূটনৈতিক আলোচনায় ভারতে মুসলমান সংখ্যালঘুদের নিরাপত্তার বিষয়টি তুলে ধরা প্রয়োজন। আমার যদি মোদীর সঙ্গে কথা হত, তাঁকে আমার এটাই বলার থাকত যে, আজ যদি আপনি সংখ্যালঘুদের না দেখেন, তা হলে দেশটা টুকরো হওয়ার আশঙ্কা তৈরি হবে। তা ভারতের স্বার্থের পরিপন্থী।’’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy