যুদ্ধ পরিস্থিতিতে গাজ়া ভূখণ্ডের বিভিন্ন প্রান্তে গড়ে উঠেছে একাধিক ত্রাণ শিবির। সেখানে আশ্রয় নেওয়া পরিবারগুলির অবস্থা সবচেয়ে খারাপ। আয়া জাইদ বলছিলেন, ‘‘ত্রাণ শিবিরে বেশ কয়েকটি পরিবারের জন্য একটি করে শৌচাগার বরাদ্দ করা হয়।’’ গোপনীয়তার সুযোগ তো নেই-ই। পর্যাপ্ত জল ও নিকাশি ব্যবস্থার অভাবে ত্রাণ শিবিরের জীবন আরও খারাপ হয়ে পড়ছে দিন কে দিন। বিশেষ করে সমস্যায় পড়তে হচ্ছে মহিলাদের। যার ফলে অনেকেরই নানাবিধ সংক্রমণ হয়েছে। স্বাস্থ্য সংক্রান্ত সমস্যায় ভুগছেন বহু মহিলা।
কার্যত ধ্বংসের চেহারা নিয়েছে গোটা শহর। এখানে তাই শুধু ধুলো আর ধুলো। এর মধ্যে গাজ়ায় ‘প্রবেশ নিষেধ’ সাবান, শ্যাম্পুর মতো পণ্যের। আয়া জানান, সবচেয়ে সমস্যা হয় নিত্যদিনের খাবার জোগাড়ে। গাজ়া সীমানার চেক-পয়েন্টগুলিতে কড়াকড়ির ফলে খাবার ও পানীয় জলের প্রবেশও এখন নিয়ন্ত্রিত। আয়া বলছিলেন, ‘‘আমরা আপাতত টিন-জাত খাবার এবং ময়দার উপর সম্পূর্ণ ভাবে নির্ভরশীল। কখনও আবার সেগুলিও দুষ্প্রাপ্য হয়ে উঠছে। দীর্ঘ সময় খাবার বোঝাই ট্রাক চেক-পয়েন্টে আটকে থাকায়, খাবার নষ্ট হচ্ছে। আর এ দিকে আমরা খাবার ও জলের জন্য হাহাকার করছি।’’ এমন পরিস্থিতিতে বেড়েছে লুটপাটও। আয়া বলছিলেন, ‘‘শহরে আইনশৃঙ্খলা বলে কিছু নেই। এই সুযোগে কিছু ক্ষমতাশালী পরিবারের সদস্যেরা মাফিয়াদের মতো হয়ে উঠেছেন। অস্ত্র নিয়ে ঘুরছেন। প্রকাশ্য চুরি-ডাকাতি করছেন।’’
যুদ্ধের আড়ালে গাজ়া ভূখণ্ডে পরিকল্পিত ভাবে হত্যা করা হচ্ছে শিশুদেরও, যাতে ভবিষ্যতের হামাস সমর্থক কেউ বেঁচে না থাকে— এমনই অভিযোগ করছে হামাস। এই অভিযোগকে সমর্থন করছেন আয়াও। বলছিলেন, ‘‘ওরা নিরপরাধ। গাজ়ায় জন্ম নেওয়াটা কি ওদের কোনও অন্যায়?’’ গাজ়া যুদ্ধের শিকার তো সাংবাদিকেরাও? আয়ার জবাব, সাংবাদিকদের উপর আক্রমণও উদ্দেশ্যপ্রণোদিত। তাঁর কথায়, ‘‘গাজ়ায় যা ঘটছে, সেই সত্য বিশ্বের সামনে তুলে ধরাটাকেও এক দল অপরাধ বলে মনে করছেন, যার ‘শাস্তি’ মৃত্যু।’’
তা হলে প্রশ্ন আসে, ২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর হামাসের আক্রমণে নিহত নিরস্ত্র ইজ়রায়েলিদের অপরাধ কী ছিল? আয়ার জবাব, ‘‘৭ অক্টোবরের হামলা একটি রক্তাক্ত অধ্যায়— এ কথা ঠিক। কিন্তু সে ঘটনা দু’দেশের সংঘাতের সূচনা ছিল না। বরং সেটি কয়েক দশক ধরে চলা প্যালেস্টাইনিদের উপর নিপীড়নের পাল্টা আঘাত। মনে রাখতে হবে, দু’দেশের মধ্যে যা ঘটবে, তার মূল্য দিতে হবে উভয় পক্ষের নাগরিকদেরই।’’ ট্যাটু আর্টিস্ট শানি লউকের নগ্ন-মৃত শরীর পিকআপ ট্রাকে চাপিয়ে শহর প্রদক্ষিণও কি ‘মূল্য দেওয়া’রই অংশ? কিংবা কয়েক মাসের শিশুকে জ্বলন্ত আভেনে ছুড়ে ফেলার ঘটনা?
আয়ার উত্তর, ‘‘এই কথাগুলি সত্য নয়। বরং প্যালেস্টাইনিদের প্রতিরোধের ভাবমূর্তিকে কলঙ্কিত করার জন্য ছড়িয়ে দেওয়া মিথ্যা মাত্র। এই দাবিগুলির কোনওটিই প্রমাণিত হয়নি। আমরা নিরপরাধ মানুষের উপর হিংসাকে সমর্থন করি না।’’
হামাসের বিরুদ্ধে ইজ়রায়েলের যুদ্ধ শুরু হলে মনে করা হয়েছিল, পড়শি মুসলিম দেশগুলি গাজ়া ভূখণ্ডের শরণার্থীদের তাদের দেশে আশ্রয় দেবে। কিন্তু বাস্তবে তা হয়নি। এ কথা মানছেন আয়া নিজেও। তবে তাঁর পাল্টা যুক্তি— গাজ়াবাসীর একটা বড় অংশ নিজেরাই তাঁদের জমি ছেড়ে যেতে চাননি। তিনি বলছিলেন, ‘‘অভিবাসন সমাধান নয়। দুর্ভোগ এবং বাস্তুচ্যুত হওয়ার পরেও, স্বদেশে ফিরে আসাই আমাদের চূড়ান্ত লক্ষ্য।’’ বিশ্ব তথা ভারত সরকারের কাছে আয়ার আবেদন— ‘‘গাজ়াবাসী দুর্ভোগের কথা উপেক্ষা করা বন্ধ করুন। দূর থেকে বিবৃতি নয়, আমাদের প্রকৃত সমর্থন প্রয়োজন। প্রতিশ্রুতি নয়, আমাদের চাই যুদ্ধ বন্ধে প্রকৃত পদক্ষেপ।’’
কিন্তু গাজ়ার এই দৃশ্য, এই আবেদন কি বিশ্বের কানে পৌঁছবে?
(শেষ)
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)