ব্রিটেনে এক রাশিয়ানের রহস্যময় মৃত্যু। এ বার তাঁর সঙ্গে সরাসরি জড়িয়ে গেল রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের নাম। শুধু জড়িয়ে যাওয়াই নয়, এই মৃত্যু পুতিনের আদেশেই হয়েছিল বলেও জানাল গণতদন্তকারী কমিশন। ব্রিটেনের তরফে সরকারি ভাবে এখনও পর্যন্ত কোনও মন্তব্য করা হয়নি।
২৩ নভেম্বর, ২০০৬। বন্ধু আন্দ্রেই কে লুগোভোই আর দমিত্রি ভি কোভতুন-কে নিয়ে লন্ডনের মিলেনিয়াম হোটেলের পাইন নামের এক পানশালায় আড্ডা মারছিলেন আলেকজান্ডার ভি লিতভিনেঙ্কো। কেজিবি-র প্রাক্তন এই কর্মী স্ত্রী মারিনা ও একমাত্র পুত্র আনাতোলিকে নিয়ে ২০০০ সালে রাশিয়া থেকে পালিয়ে আসার পরে ব্রিটেনেই বাস করছিলেন। পানভোজন সেরে বাড়ি ফিরেই অসুস্থ হয়ে পড়েন লিতভিনেঙ্কো। হাসপাতালে ভর্তি হন। দ্রুত অবস্থার অবনতি হতে থাকে। মৃত্যুশয্যায় বার বার তাঁর এই অবস্থার জন্য কেজিবি-র উত্তরসূরী এফএসবি এবং সরাসরি পুতিনকে দায়ী করতে থাকেন লিতভিনেঙ্কো। খবর পেয়ে সজাগ ব্রিটিনের নিরাপত্তা সংস্থাগুলি। কিন্তু তাঁর এই অবস্থার কারণ সম্পর্কে চিকিৎসকেরা কিছুতেই নিশ্চিত হতে পারছিলেন না। কিছু ক্ষণ পরেই মৃত্যু হয় লিতভিনেঙ্কোর।
সন্দেহের বশে তাঁর শেষ প্রস্রাব ও রক্তের নমুনা ব্রিটেনের পরমাণু গবেষণা কেন্দ্রে পাঠানো হয়। সেখানেই খোঁজ মেলে, তাঁর শরীরে মিশেছে পোলোনিয়াম-২১০ নামের একটি অতি-তেজস্ক্রিয় পদার্থ। যাঁর থেকেই মৃত্যু। প্রমাণ মেলে, পাইন পানশালায় গ্রিন টি-তেই পোলোনিয়াম-২১০ মেশানো হয়েছিল। সন্দেহের তির ঘুরে যায় আন্দ্রেই কে লুগোভেই আর দামিত্রি ভি কোভতুনক-এর দিকে। জানা যায়, পরমাণু বোমার ট্রিগার হিসেবে পোলেনিয়াম-২১০ ব্যবহার করে রাশিয়া। রাশিয়ার সামরিক গবেষণাগারেই এই পোলোনিয়াম-২১০ তৈরি হয়। তদন্ত যত এগোয় ততই জানা যায় এই দুই বন্ধুর সঙ্গে এফএসবি-র গভীর যোগাযোগ। ক্রমেই রাশিয়া সরকারের সঙ্গে এই ঘটনার যোগাযোগের প্রমাণ মিলতে থাকে। স্বভাবতই রাশিয়ার তরফ থেকে সব অভিযোগ অস্বীকার করা হয়। এমনকী, তদন্তের প্রয়োজনে আন্দ্রেই কে লুগোভেই আর দামিত্রি ভি কোভতুনকে ব্রিটেনের হাতে তুলে দিতেও অস্বীকার করে রাশিয়া। এই নিয়ে ব্রিটেনের সঙ্গে রাশিয়ার কূটনৈতিক সম্পর্কও তলানিতে ঠেকে। কিন্তু জনগণ, বিশেষ করে লিতভিনেঙ্কোর স্ত্রী মারিনা লড়াই চালিয়ে যান। মারিনার চাপেই ব্রিটেনের হাইকোর্টের অবসরপ্রাপ্ত বিচারক রবার্ট ওয়েন-এর নেতৃত্বে তৈরি হয় গণতদন্ত কমিশন। ৩৪ দিন ধরে ৬২ জনের সাক্ষ্য গ্রহণ করে এই কমিশন। বৃহস্পতিবার সেই কমিশনের ৩২৮ পৃষ্ঠার রিপোর্ট প্রকাশিত হয়েছে। সেখানে লিতভিনেঙ্কোর মৃত্যুর জন্য সরাসরি দায়ী করা হয়েছে এফএসবি-র প্রধান পাত্রুশেভ-কে। এবং বলা হয়েছে, পুতিনের আদেশ ছাড়া পাত্রুশেভের পক্ষে এই সিদ্ধান্ত নেওয়া অসম্ভব ছিল। সাক্ষ্যপ্রমাণ সে দিকেই নির্দেশ দিচ্ছে বলে রবার্ট ওয়েন জানিয়েছেন।
কিন্তু কেন লিতভিনেঙ্কো-কে হত্যা করা হল? মারিনাই জানিয়েছিলেন, ব্রিটেনে আসার পরে ব্রিটিশ গুপ্তচর সংস্থা এমআই-৬ কে সাহায্য করতেন। এ ছাড়া স্পেনে বসবাসকারী রাশিয়ার মাফিয়াদের সামলাতেও লিতভিনেঙ্কো-র সাহায্য নেওয়া হত। এই মাফিয়াদের সঙ্গে এফএসবি-র ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ছিল বলে অভিযোগ। পাশাপাশি, দুনিয়া জুড়ে রাশিয়ার গুপ্তচর সংস্থা এফএসবি-র কর্মকাণ্ড নিয়ে নানা সময়ে মুখ খুলেছেন লিতভিনেঙ্কো। এতে এফএসবি-কে অস্বস্তিতে পড়তে হয়েছে। তদন্তকারীদের সন্দেহ, এই কাজ করতে গিয়ে দু’বার লক্ষণরেখা অতিক্রম করেন লিতভিনেঙ্কো। এক বার ইন্টারনেটে প্রকাশিত এক লেখায় পুতিনকে সমকামী বলেছিলেন লিতভিনেঙ্কো। আবার, ১৯৯৯-এর সেপ্টেম্বর জুড়ে মস্কোর বেশ কিছু আবাসনে পর পর বিস্ফোরণ ঘটে। এতে তিনশোর বেশি মৃত্যু হয়। আহত হন প্রায় ১৭০০ জন। এই ঘটনার পরে চেচনিয়ার বিদ্রোহীদের এই বিস্ফোরণের জন্য দায়ী করে চেচনিয়ার রাজধানী গ্রজনি-তে বিমানহানার আদেশ দেন তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ভ্লাদিমির পুতিন। শুরু হয় দ্বিতীয় চেচনিয়া যুদ্ধ। কিন্তু তদন্তে এই বিস্ফোরণে এফএসবি-র ভূমিকা নিয়েও প্রশ্ন ওঠে। লিতভিনেঙ্কো জানিয়েছিলেন, এফএসবি-ই এই বিস্ফোরণ ঘটিয়েছিলেন। এবং তা পুতিনের অজানা ছিল না। এর পরেই লিতভিনেঙ্কো হত্যার বিষয়ে এফএসবি চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেয় বলে তদন্ত কমিশনের ধারণা। তাতে পুতিনই শীলমোহর দেন বলে সাক্ষ্যপ্রমাণ থেকে সন্দেহ দৃঢ় হচ্ছে বলে তদন্তকারীরা জানিয়েছেন।
বৃহস্পতিবার এই তদন্তের রিপোর্ট প্রকাশ্যে আসার পরেই ব্রিটেন-রাশিয়ার কূটনৈতিক সম্পর্ক নিয়ে জলঘোলা হওয়ার আশঙ্কা। লিতভিনেঙ্কোর স্ত্রী মারিনা রাশিয়ার বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা বসানোর জন্য আবেদন করেছেন। তিনি রাশিয়ার কূটনীতিকদের বহিষ্কারের দাবিও তুলেছেন। যদিও পাশাপাশি তাঁর ধারণা, এ বিষয়ে ব্রিটেন বিশেষ কিছুই করবে না। অন্য দিকে, অন্যতম অভিযুক্ত লুভোগোই এখন রাশিয়ায় রাজনীতির সঙ্গে জড়িত। তিনি এ দিন এই রিপোর্টকে ভিত্তিহীন বলে উড়িয়ে দিয়েছেন।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy