শুধু শেখ মুজিবুর রহমান বা তাঁর পরিবারের লোকেরাই নন, মানবতাবাদী লালন সাঁই, বিজ্ঞানী আচার্য সত্যেন্দ্রনাথ বসু, আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রায়, কবি জীবনানন্দ দাশেরাও যে বাংলাদেশে ইউনূস সরকারের কাছে সমান অবাঞ্ছিত— খুলনা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ তা স্পষ্ট করে দিলেন। ব্রাত্যের এই তালিকায় তাজউদ্দিন আহমেদ, সৈয়দ নজরুল ইসলামের মতো মুক্তিযুদ্ধের নেতাও রয়েছেন, শেখ হাসিনা যাঁদের যোগ্য মর্যাদা দেননি বলে অভিযোগ করেন ইউনূস-অনুগত ছাত্রেরা। রয়েছেন রাজাকার ও পাকিস্তানি বাহিনীর হাতে প্রাণ দেওয়া কয়েক জন বিশিষ্ট অধ্যাপক ও বিদগ্ধ জনও।
বুধবার খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিস্ট্রার এস এম মাহবুবুর রহমান একটি নোটিসে ১৬টি ভবনের নাম বদলের কথা ঘোষণা করেছেন। নোটিসে জানানো হয়েছে, শনিবার বিশ্ববিদ্যালয়ের সিন্ডিকেট বৈঠকে এই নাম পরিবর্তনের সিদ্ধান্ত হয়েছে, রেজিস্ট্রার যা কার্যকর করছেন। নোটিসে মোট ১৯টি ভবনের নামের উল্লেখ থাকলেও তিনটির নামবদল করা হয়নি। এই তিনটি ভবন মাইকেল মধুসূদন দত্ত, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এবং কাজী নজরুল ইসলামের নামাঙ্কিত। এর আগে ইউনূস সমর্থকদের প্রভূত বিষোদ্গার করতে শোনা গিয়েছে
‘ভারতের নাগরিক’ রবীন্দ্রনাথের নামে। ‘বিদেশি’ এই কবির লেখা গান কেন বাংলাদেশের জাতীয়সঙ্গীত করা হয়েছে, তা নিয়েও এই সমর্থকদের ক্ষোভের শেষ নেই। তবে খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের সিন্ডিকেট ‘রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর শিক্ষা ভবন’ থেকে তাঁর নাম উপড়ে দেয়নি। একই ভাবে অটুট থাকছে ‘কাজী নজরুল ইসলাম কেন্দ্রীয় গ্রন্থাগার’ এবং ‘মাইকেল মধুসূদন দত্ত অতিথি ভবন’-এর নাম ফলক। তবে ‘জাতির জনক বঙ্গবন্ধু মুজিবুর রহমান হল’ নামে ছাত্রাবাসের নাম ‘বীরশ্রেষ্ঠ মোহাম্মদ রুহুল আমিন হল’ করা হয়েছে। ‘বঙ্গমাতা বেগম ফজিলাতুন্নেছা মুজিব হল’ হয়েছে ‘বিজয় ২৪ হল’, ‘জয় বাংলা ভবন’-কে ‘অকাডেমিক ভবন ০৪’ নামে ডাকা হবে।

খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভবনের নাম বদলের নোটিস। ছবি: সংগৃহীত।
লালন সাঁইয়ের মতো উদারপন্থী মানবতাবাদীকে নিয়ে ইউনূস সরকারের সমর্থক কট্টর মৌলবাদীদের অস্বস্তি প্রচুর। বুধবারেই টাঙ্গাইলের মধুপুরে ‘লালন স্মরণোৎসব’ বন্ধ করে দিয়েছে হেফাজতে ইসলামি। তাদের নির্দেশ মেনে প্রশাসন কঠোর ব্যবস্থা করেছে, যাতে কেউ লালন মেলায় বসতে না পারেন। আয়োজকেরা জানিয়েছেন, প্রশাসনিক সব ধরনের অনুমোদন নিয়েই তাঁরা এই মেলা করছিলেন। বুধবারে তা শুরু হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু হেফাজতের আপত্তিতে প্রশাসন তা বন্ধ করে দিয়েছে। কেন আপত্তি, এই প্রশ্নের জবাবে হেফাজতের নেতা মাহমুদুল্লা সংবাদ মাধ্যমকে বলেছেন, “লালনের ভ্রান্ত আদর্শের প্রচার আমরা করতে দেব না।” ইউনূসের ছ’মাসের শাসনে এর আগেও মৌলবাদীদের চোখরাঙানিতে বাংলাদেশের নানা জায়গায় লালন উৎসব বন্ধ হয়েছে। খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের সিন্ডিকেট ‘লালন সাঁই মিলনায়তন’-এর নাম বদলে ‘টিএসসি ভবন’ করে দিয়েছে। আচার্য সত্যেন্দ্রনাথ বসু, আচার্য জগদীশচন্দ্র বসু, জীবনানন্দের নামে ভবনগুলি থেকেও এঁদের নাম সরিয়ে দেওয়া হয়েছে। ‘সুলতানা কামাল জিমনাসিয়াম’ হয়েছে ‘খুলনা বিশ্ববিদ্যালয় জিমনাসিয়াম’।
রাষ্ট্রপুঞ্জের মানবাধিকার শাখা জুলাই-অগস্টে বাংলাদেশের অরাজকতা ও হত্যাকাণ্ডগুলি নিয়ে একটি রিপোর্ট প্রকাশ করেছে। ইউনূস সরকার ক্ষমতায় আসার পরে মানবাধিকার শাখার একটি দল বাংলাদেশে এসে রিপোর্ট তৈরি করেছেন। রিপোর্টটিতে বলা হয়েছে, ছাত্র আন্দোলন হাসিনার ইস্তফার দাবিতে দাঙ্গায় পরিণত হওয়ার পরে তা দমন করতে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে হিংসাত্মক হতে নির্দেশ দিয়েছিলেন সরকারের শীর্ষ নেতৃত্ব। তবে রিপোর্টে দেওয়া হিসাব অনুযায়ী— ৭ থেকে ১৫ অগস্ট, হাসিনা-বিদায়ের পরের ৮ দিনে সব চেয়ে বেশি— ৭৫০ জনের প্রাণহানি ঘটেছে। নিহতরা আওয়ামী লীগের নেতাকর্মী ও পুলিশ। এর আগে ১ জুলাই থেকে ৬ অগস্ট পর্যন্ত যে ৬৫০ জন মারা গিয়েছেন, তাতে ‘দাঙ্গাকারী, আওয়ামী লীগ কর্মী এবং পুলিশেরা’ ছিলেন।
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)