ইউক্রেনের গ্রাবোভোয় পর্যবেক্ষকদের ঘিরে রেখেছে রুশপন্থী জঙ্গিরা। পড়ে আছে ধ্বংস হওয়া এমএইচ-১৭-র যাত্রীদের দেহ। ছবি: রয়টার্স
ধ্বংসস্তূপ না যুদ্ধক্ষেত্র বোঝা দায়! চার দিকে ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ে মৃতদেহ বা দেহাংশ। বিমানের দোমড়ানো-মোচড়ানো ভাঙা পোড়া টুকরো। আর সে সব ঘিরে আধুনিক সব আগ্নেয়াস্ত্র হাতে পাহারা দিচ্ছে জঙ্গিরা। দুর্ঘটনাস্থল থেকে ফিরে এসে শনিবার এই অভিজ্ঞতার কথা জানালেন একটি আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষক দলের সদস্যরা।
শুক্রবার আমস্টারডাম থেকে কুয়ালা লামপুর যাওয়ার পথে ইউক্রেনের রুশ সীমান্ত ঘেঁষা ডনেৎস্কের গ্রাবোভো গ্রামে ভেঙে পড়েছিল মালয়েশীয় বিমান সংস্থার এমএইচ-১৭ উড়ান। বিপর্যয়ের দায় নিয়ে চাপানউতোর যা-ই থাকুক, দুর্ঘটনাস্থলের আশপাশের ২০ কিলোমিটার পর্যন্ত পরিধিকে বিশেষ সুরক্ষিত এলাকা বলে গত কালই মানতে রাজি হয়েছিল জঙ্গিরা।
স্মরণে। এমএইচ-১৭-এর মৃতদের উদ্দেশে মোমবাতির শ্রদ্ধা। রবিবার কুয়ালা লামপুরে। ছবি: রয়টার্স
কিন্তু ইউক্রেন ও আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষকদের অভিযোগ, কথা রাখার ধারেকাছেই যায়নি রুশপন্থী জঙ্গি সংগঠন। আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষকরা সওয়া ঘণ্টার বেশি ঘটনাস্থলে থাকার সুযোগ পাননি। বিশাল এলাকা জুড়ে ছড়িয়ে পড়েছিল বিমানের অংশ। অথচ ২০০ মিটার এলাকার মধ্যেই পর্যবেক্ষকদের আটকে রাখে জঙ্গিরা। এর বাইরে কোনও কিছু দেখারই সুযোগ পাননি ভিয়েনার সংগঠন ‘অর্গানাইজেশন ফর সিকিউরিটি অ্যান্ড কোঅপারেশন ইন ইউরোপ’ (ওএসসিই)-এর ৩০ জন প্রতিনিধি। ইউক্রেন প্রশাসনের অভিযোগ, তথ্যপ্রমাণ লোপাট করতেই জঙ্গিদের এই অতন্দ্র প্রহরা। রাশিয়া যে আন্তর্জাতিক অপরাধ করেছে, জঙ্গিরা এখন তা ধামাচাপা দিতে তৎপর। তারা ঘটনাস্থল থেকে অনেক দেহ ও দেহাংশ সরিয়ে ফেলছে। সেই সঙ্গে চলছে নিহতদের দামি জিনিসপত্র লুঠপাট।
ওএসসিই-র পর্যবেক্ষক দলটি আজ দুপুরের দিকে ওই ঘটনাস্থলে যায়। গত কালও তাঁরা অল্প কিছু ক্ষণের জন্য ওই এলাকায় গিয়েছিলেন। আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষক দল হিসেবে ওখানে প্রথম পা রাখেন তাঁরাই। কিন্তু তদন্তের জন্য আজ তাঁরা সময় পেয়েছেন সাকুল্যে ৭৫ মিনিট। দলের এক মুখপাত্রের কথায়, “গিয়ে পৌঁছনোর পর মনে হল যেন বিশ্বের জঘন্যতম অপরাধ-ক্ষেত্রে এসে পড়েছি। চার পাশে ফৌজি পোশাক পরা জঙ্গিরা ফেউয়ের মতো লেগে রয়েছে পর্যবেক্ষকদের সঙ্গে।” পর্যবেক্ষকদের সাহায্য করা তো দূরে থাক, তাঁদের চমকে দিয়ে মাঝে মধ্যেই শূন্যে গুলি ছুড়েছে জঙ্গিরা।
ওএসসিই-র চেয়ারম্যান টমাস গ্রিমিঙ্গারও আজ বলেন, “ঘটনাস্থল যতটা ঘুরে দেখার দরকার ছিল, পর্যবেক্ষকদের সেই সুযোগ দেওয়া হয়নি। বরং তাঁদের অবাধ গতিবিধিকে নিয়ন্ত্রণ করেছে জঙ্গিরা। মাত্র ২০০ মিটার এলাকা ঘুরে দেখার সুযোগ পেয়েছেন তাঁরা।”
এই মৃত মহাদেশে... ভেঙে পড়া মালয়েশীয় বিমানটির ধ্বংসস্তূপে
দাঁড়িয়ে এক গ্রামবাসী। শনিবার। ছবি: এএফপি
ক্ষেপণাস্ত্র হানায় মালয়েশিয়ার বিমান ধ্বংস হওয়ার পরপরই অভিযোগের আঙুল উঠেছিল ইউক্রেনের রুশ মদতপুষ্ট জঙ্গিদের দিকে। ইউক্রেন প্রশাসন আজ একটি ভিডিও প্রকাশ করে দাবি করেছে, পরশুই তারা জানতে পেরেছিল, রাশিয়ার কাছ থেকে বিমান বিধ্বংসী ‘বুক’ ক্ষেপণাস্ত্র হাতে পেয়েছে জঙ্গিরা। তবে রুশ সেনার পক্ষেই ওই ক্ষেপণাস্ত্র ছোড়া সম্ভব। এবং রুশ এলাকা থেকেই তা ছোড়া হয়েছিল এমএইচ-১৭ ধ্বংস করতে।
বিমানটির ব্ল্যাক বক্স কোথায় গেল সেই প্রশ্নের জবাব মেলেনি আজও। রাশিয়ার এক রেডিও স্টেশনের দাবি, এমএইচ-১৭-র ব্ল্যাক বক্স ইতিমধ্যেই পৌঁছে গিয়েছে মস্কোর হাতে। যদিও রুশ বিদেশমন্ত্রী জানিয়েছেন, বিমানের ব্ল্যাক বক্সের সঙ্গে রাশিয়ার কোনও যোগ নেই। বিমানে সাধারণত দু’টো ব্ল্যাক বক্স থাকে। একটাকে বলা হয় ফ্লাইট ডেটা রেকর্ডার। দ্বিতীয়টা ককপিট ভয়েস রেকর্ডার। এ দু’টো একসঙ্গেও থাকতে পারে কোনও বিমানে। কিন্তু রুশপন্থী জঙ্গিরা একটা সময় বলেছিল, তাদের কাছে নাকি বারোটার মধ্যে আটটা ব্ল্যাক বক্স রয়েছে। এতগুলো ব্ল্যাক বক্স কোথা থেকে এল, সে প্রশ্নের কোনও জবাব অবশ্য তারা দেয়নি।
ব্ল্যাক বক্স নিয়ে রহস্য আরও বাড়িয়েছে জঙ্গি দলের প্রেসিডেন্ট আলেকজান্দার বোরোদাইয়ের একটা কথা। তার বক্তব্য, এ রকম কোনও কিছুই তাদের হাতে আসেনি। জঙ্গি অধ্যুষিত ডনেৎস্কের গভর্নরের এক উপদেষ্টা আবার বলেছেন, ব্ল্যাক বক্স খুঁজে পাওয়া গিয়েছে। এবং তা ইউক্রেন প্রশাসনের হাতেই তুলে দেওয়া হয়েছে। ব্ল্যাক বক্স নিয়ে রাজনীতির খেলা যা-ই চলুক না কেন, দ্বিতীয় দিনের শেষেও ব্ল্যাক বক্সের হদিস না মেলায় বিমান ধ্বংস নিয়ে ধোঁয়াশা সেই রয়েই গেল।
পূর্ব ইউক্রেনের যেখানে বিমানটি ভেঙে পড়েছে, সেই জায়গাটা প্রত্যন্ত বললেও কম বলা হয়। বিস্তীর্ণ এলাকা জুড়ে শুধু গম আর সূর্যমুখীর চাষ হয়। গোটা এলাকায় কোথাও বিদ্যুৎ সংযোগ নেই। দু’দিন পড়ে থাকার পর দেহগুলিতে পচন ধরতে শুরু করেছে। কোথাও পড়ে রয়েছে আসনের সঙ্গে সিটবেল্ট লাগানো মৃতদেহ। কেউ বা আবার ধ্বংসের মুহূর্তে মগ্ন ছিলেন হেডফোনে গান শুনতে। খোলা মাঠে এখনও ও ভাবেই পড়ে আছেন তিনি। খালি প্রাণটাই যা নেই।
বিস্তৃত ওই প্রান্তরে কী নেই! কোথাও পুড়ে যাওয়া উপন্যাস, কোথাও সমুদ্র সৈকতে পরার বাহারি হাওয়াই চটি, কোথাও আবার দামি গয়না, ক্রেডিট কার্ড। দামি জিনিসের লোভে মৃতদেহ ও দেহাংশের আশপাশেই চলছে অবাধ লুঠতরাজ। ক্রেডিট কার্ড থেকে টাকা নয়ছয় আটকাতে মৃতদের পরিবারের কাছে কার্ডগুলো ব্লক করে দেওয়ার আর্জি জানিয়েছে ইউক্রেন সরকার।
রাশিয়ার মদত ছাড়া এমন কাণ্ড জঙ্গিরা ঘটাতে পারত না বলে কালই প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের বিরুদ্ধে সুর চড়িয়েছিলেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা। পর্যবেক্ষকদের এলাকা ঘুরে দেখতে না দেওয়ায় ফের নিজেদের উদ্বেগ টুইট করে জানিয়েছে মার্কিন বিদেশ মন্ত্রক। ঘটনার তদন্ত করতে এফবিআইয়ের দুই প্রতিনিধিকে পাঠাবেন ওবামা।
আন্তর্জাতিক মহল রাশিয়ার উপর যত চাপ বাড়িয়েছে, ততই ঘটনা থেকে নিজেদের হাত ঝেড়ে ফেলতে তৎপর হয়েছে মস্কো। রুশ প্রেসিডেন্ট পুতিনের দাবি, ঘটনাটা যেহেতু ইউক্রেনের আকাশসীমায় হয়েছে, তাই এর সঙ্গে রাশিয়াকে জড়ানো অর্থহীন। এমএইচ-১৭ বিপর্যয়ে মারা গিয়েছেন অস্ট্রেলিয়ার ২৭ জন নাগরিক। পুতিনের এই বক্তব্যের পর কড়া প্রতিক্রিয়া জানিয়েছে তারাও। রাশিয়া এ ভাবে দায় ঝেড়ে ফেলতে চাইলে তার ফল ভাল হবে না, হুঁশিয়ারি দিয়েছেন সে দেশের প্রধানমন্ত্রী টনি অ্যাবট। আন্তর্জাতিক পর্যায়ের তদন্তের জন্য তারাও ছ’জন প্রতিনিধিকে পাঠাবে। পুতিনের সঙ্গে কথা বলার পর আজ জার্মান চ্যান্সেলর অ্যাঙ্গেলা মের্কেলও বলেন, রাশিয়া যে বিষয়টার সমাধানে সত্যিই আগ্রহী, সেটা প্রমাণ করার শেষ সুযোগ এখন মস্কোর সামনে। ইউক্রেন পরিস্থিতি নিয়ে গত কাল জরুরি বৈঠক ডেকেছিল রাষ্ট্রপুঞ্জের নিরাপত্তা পরিষদ। ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীও আজ মালয়েশিয়ার প্রধানমন্ত্রীকে চিঠি লিখে গোটা ঘটনার তীব্র সমালোচনা করেছেন। তদন্তে কোনও রকম দরকার হলে ভারত সাহায্য করতে প্রস্তুত বলেও জানিয়েছেন মোদী।
বিমান বিপর্যয় থেকে রাশিয়া যতই নিজেদের দূরত্ব বাড়ানোর চেষ্টা করুক না কেন, শনিবার কিন্তু নতুন অস্বস্তির মুখে পড়তে হয়েছে তাদের। জঙ্গিদের কাজ নিয়ে রুশ টেলিভিশন চ্যানেলে মুখ খুলেছিলেন সারা ফারথ নামে এক সাংবাদিক। বিশ্বের খবরের শিরোনামে যখন এমএইচ-১৭, তখন অদ্ভুত ভাবে রাশিয়ার সংবাদমাধ্যম বিষয়টিকে অনেক কম গুরুত্ব দিয়ে দেখায়। দেশের সংবাদ মাধ্যমের উপর সরকারের প্রভাবের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানাতে আজ পদত্যাগ করলেন সারা।
এমএইচ-১৭ নিয়ে বিশ্বজুড়ে যখন এত সমালোচনা, তার মধ্যেই কিন্তু ফের অশান্তির খবর এসেছে ইউক্রেন থেকে। রুশ মদতপুষ্ট জঙ্গিরা এ দিন হামলা চালিয়েছে দক্ষিণ-পূর্ব ইউক্রেনের লুহানস্ক শহরে। বাসিন্দারা জানিয়েছেন, প্রতি মিনিটেই একটা-দু’টো করে মর্টার ফাটার আওয়াজ শুনেছেন তাঁরা।
ইউক্রেন-রাশিয়ার সমস্যার মাঝে পড়ে শুক্রবারই প্রাণ হারিয়েছেন ২৯৮ জন নিরীহ বিমানযাত্রী। রাশিয়া বা ইউক্রেনের কারও স্বার্থের সঙ্গে যাদের কোনও সম্পর্কই ছিল না। দুই রাষ্ট্রের লড়াইয়ের আর কত মাসুল দিতে হবে বিশ্বকে, সেই প্রশ্নেরই উত্তর খুঁজছেন সকলে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy