প্যাংগং-এ সেনা সমাবেশ। -ফাইল ছবি।
থমথম করছে গোটা লাদাখ। তৈরি হয়েছে সঙ্ঘাতের পরিস্থিতির। প্রকৃত নিয়ন্ত্রণরেখার কাছে এ বার চিনা সেনার প্রস্তুতি আগের বারগুলির চেয়ে একেবারেই অন্য রকম। বেজিং আরও দু’ থেকে আড়াই হাজার সেনা মোতায়েন করেছে প্যাংগং সো আর গালওয়ান উপত্যকায়। গালওয়ানে বেজিং বাঙ্কার তৈরিরও চেষ্টা চালাচ্ছে বলে খবর। প্রকৃত নিয়ন্ত্রণরেখা বরাবর বিতর্কিত এলাকাগুলিতে সেনা সমাবেশ বাড়িয়েছে ভারতও। ফলে, ২০১৭-র ডোকলাম পরিস্থিতির পর প্রকৃত নিয়ন্ত্রণরেখায় ভারত ও চিনের মধ্যে বৃহত্তম উত্তেজনার সৃষ্টি হয়েছে।
সমর বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দিনকে দিন পরিস্থিতির যে ভাবে অবনতি ঘটছে, তাতে দু’পক্ষ তড়িঘড়ি কোনও সমঝোতায় পৌঁছতে না পারলে রণক্ষেত্র হয়ে উঠতে পারে প্যাংগং সো, গালওয়ান উপত্যকা, ভারতীয় চৌকি ‘কেএম১২০’-সহ ভারত-চিনের মধ্যে ৩ হাজার ৪৪৮ কিলোমিটার লম্বা প্রকৃত নিয়ন্ত্রণরেখা।
সেনা সূত্রের খবর, ভারতের পক্ষে সবচেয়ে উদ্বেগজনক হয়ে উঠেছে, কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ এলাকায় চিনা সেনার উপস্থিতি ও তাদের সংখ্যাবৃদ্ধি। যেটা সবচেয়ে বেশি হয়েছে গালওয়ান উপত্যকায়। উপত্যকার ওল্ডি রোডে যেমন এ মাসের গোড়া থেকেই চিনা সেনা সমাবেশ বাড়তে শুরু করেছে, তেমনই দারবুক, শায়ক ও দৌলত বেগে গত তিন সপ্তাহে বেড়েছে চিনা সেনার সংখ্যা। ভারতীয় চৌকি ‘কেএম-১২০’-র আশপাশে চিনা সেনা সমাবেশ দেখা গিয়েছে।
প্রাক্তন নর্দার্ন আর্মি কমান্ডার অবসরপ্রাপ্ত লেফটেন্যান্ট জেনারেল ডি এস হুডা বলেছেন, ‘‘এটা খুবই গুরুতর ঘটনা। চিনা সেনারা এর আগেও প্রকৃত নিয়ন্ত্রণ রেখা পেরিয়ে ভারতের এলাকায় ঢুকেছে। কিন্তু এ বার সেই সব এলাকায় চিনা সেনা সমাবেশ আর অন্যান্য প্রস্তুতি অভূতপূর্ব।’’
হুডা এও জানিয়েছেন, গালওয়ানে চিনা সেনা সমাবেশই সবচেয়ে বেশি উদ্বেগজনক। কারণ, এই এলাকাটি নিয়ে ভারত ও চিনের মধ্যে কোনও দিনই কোনও বিরোধ ছিল না।
প্রায় একই সুরে কথা বলেছেন প্রতিরক্ষা বিশেষজ্ঞ অশোক কে কণ্ঠও। তাঁর কথায়, ‘‘এর আগে এই এলাকায় বহু বার ঢুকে পড়েছে চিনা সেনা। কিন্তু এ বারের ঘটনাটা আগের বারেরগুলির মতো নয়। খুবই উদ্বেগজনক।’’
কেন এ বার এই পরিস্থিতির সৃষ্টি হল?
বিশেষজ্ঞরা জানাচ্ছেন, আকসাই চিন নিয়ে চিনের দাবি নতুন কিছু নয়। যেমন নতুন নয় অরুণাচল প্রদেশের বেশ কিছু এলাকা নিয়ে চিনা দাবিও। কিন্তু এ বার চিন বেশি উদ্বিগ্ন গিলগিট-বাল্টিস্তান এলাকা নিয়ে। যা পড়ে চিন ও পাকিস্তানের মধ্যে নির্মীয়মান অর্থনৈতিক করিডরে। আর পড়ে লাদাখে। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী সরকার সংবিধানের ৩৭০ ধারা বাতিল করে জম্মু-কাশ্মীর রাজ্যকে ভেঙে জম্মু, কাশ্মীর ও লাদাখকে তিনটি কেন্দ্রশাসিত এলাকায় পরিণত করার পর থেকেই বেজিংয়ের উদ্বেগ আরও বেড়ে গিয়েছে।
কিরঘিজস্তানে প্রাক্তন ভারতীয় রাষ্ট্রদূত পি স্তোবদান বলেছেন, ‘‘চিন পাকিস্তানের সঙ্গে অর্থনৈতিক করিডর বানাচ্ছে ভারত মহাসাগরে নিজের সামরিক প্রভূত্ব সার্বিক ভাবে গড়ে তুলতে। তাই লাদাখকে নিজের হাতে রাখার দরকার বেজিংয়ের। সে জন্যই এ বার যে কোনও ভাবে লাদাখে ঢুকে পড়তে চাইছে চিন।’’
আরও পড়ুন- লাদাখ সীমান্তে সেনা জড়ো করছে চিন, সঙ্ঘাতের পরিস্থিতি
আরও পড়ুন- কালো বস্তুটা গোঁ গোঁ করে ঝাঁপিয়ে পড়ল, মাথা তোলার অবস্থা নেই সাগরের
সেনা সূত্রের খবর, প্যাংগং সো, ডেমচক ও দৌলত বেগে পরিস্থিতি এখন এমনই, যে কোনও মুহূর্তে মুখোমুখি সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়তে পারে ভারতীয় ও চিনা সেনা। গালওয়ান উপত্যকায় গত দু’সপ্তাহে ১০০টিরও বেশি তাঁবু খাটিয়েছে চিনা সেনা।
এলাকায় পরিস্থিতির অবনতি ঘটতে শুরু করে গত ৫ মে থেকে। পূর্ব লাদাখে সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়ে প্রায় ২৫০ চিনা ও ভারতীয় সেনা। যা গড়ায় পরের দিন পর্যন্ত। ফলে, দু’পক্ষের মধ্যে বৈঠকের পর কিছুটা স্বস্তি ফেরে এলাকায়। কিন্তু তার তিন দিনের মাথায় গত ৯ মে উত্তর সিকিমে ফের সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়ে শতাধিক ভারতীয় ও চিনা সেনা। ওই সময়েই চিনের তরফে অভিযোগ তোলা হয়, ভারতীয় সেনা ঢুকে পড়েছিল তাদের এলাকায়। যদিও বিদেশমন্ত্রকের মুখপাত্র অনুরাগ শ্রীবাস্তব সেই সময় চিনা অভিযোগ উড়িয়ে দিয়েছিলেন।
বিশেষজ্ঞদের মতে, গত বছর অগস্ট মাসে জম্মু-কাশ্মীরের বিশেষ মর্যাদা প্রত্যাহারের পরেই আকসাই চিন সম্পর্কে প্রথম লাল সঙ্কেত পেয়েছিল বেজিং, কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহের মন্তব্যে। তখন থেকেই নিজেদের ঘুঁটি সাজানো শুরু করেছিল তারা। মাঝে কোভিড নিয়ে নজর কিছুটা ঘুরলেও কালক্রমে তা সামলে নিয়ে আবার সীমান্তে প্রস্তুত করা হচ্ছে পিএলএ-কে।
গত বছর অগস্টে কাশ্মীর নিয়ে সিদ্ধান্তের পরেই সংসদে অমিত শাহ পাকিস্তান ও চিনের সঙ্গে সীমান্ত সমস্যার ব্যাপারে চড়া সুরে বলেন, ‘‘পাক অধিকৃত কাশ্মীর ও আকসাই চিনও ভারতের অবিচ্ছেদ্য অংশ।’’
এর ঠিক পরেই এক বিবৃতিতে চিনা বিদেশ মন্ত্রকের মুখপাত্র হুয়া চুনইং বলেছিলেন, ‘‘ভারত-চিন সীমান্তের পশ্চিম দিকে থাকা চিনা ভূখণ্ডের ভারতভুক্তি নিয়ে সব সময় প্রতিবাদ জানিয়ে এসেছে চিন। সম্প্রতি অন্তর্দেশীয় আইন সংশোধন করে ভারত চিনের আঞ্চলিক সার্বভৌমত্ব খাটো করার ক্রমাগত চেষ্টা করছে। যেটা মেনে নেওয়া যায় না। এই চেষ্টা কোনও দিনই সফল হবে না।’’
গত কয়েক মাসে একাধিক বার বিদেশমন্ত্রী এস জয়শঙ্কর এবং জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা অজিত ডোভাল চিনা নেতৃত্বকে বুঝিয়ে এসেছেন যে জম্মু-কাশ্মীর নিয়ে যে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে তা একান্তই ভারতের অভ্যন্তরীণ। কিন্তু পরিস্থিতি যে দিকে এগোচ্ছে তাতে স্পষ্ট, কূটনৈতিক দৌত্যে চিঁড়ে ভেজেনি।
উল্টে এ দিন ভারত-নেপাল সীমান্তে লিপুলেখ গিরিপথে রাস্তা তৈরি নিয়ে ভারতকে ফের তোপ দেগেছে নেপাল। চিনা মদতেই নেপাল ওই রাস্তা নিয়ে আপত্তি করছে বলে মন্তব্য করেছিলেন ভারতীয় সেনাপ্রধান এম এম নরবণে। নেপালি প্রতিরক্ষামন্ত্রী ঈশ্বর পোখরেলের বক্তব্য, ‘‘এই মন্তব্য করে ভারতীয় সেনার নেপালি গোর্খাদেরও অপমান করেছেন ভারতীয় সেনাপ্রধান।’’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy