অরিন্দম বসু
ক্যানসার এখনও প্রায় গোলকধাঁধা। শরীরের এক-এক জায়গার ক্যানসারের চরিত্র এক-এক রকম। ফলে তার চিকিৎসাও আলাদা। আবার একই ধরনের ক্যানসার আক্রান্তদের কেউ কেমোথেরাপিতে সুস্থ হয়ে যান, কারও কাজই দেয় না। আগে এর বেশিটাই ছিল অজানা, কারণ ব্যাখ্যা করা তো দূর অস্ত্। চিকিৎসা বিজ্ঞানের আধুনিকতার সঙ্গে সঙ্গে ক্রমশ জটিলতা কাটছে। এক জন নির্দিষ্ট রোগীর জন্য তৈরি হচ্ছে ‘পার্সোনালাইজ়ড’ চিকিৎসা ব্যবস্থা। ঠিক এ ভাবেই ওভারিয়ান বা ডিম্বাশয়ের ক্যানসারের জন্য একটি কার্যকর চিকিৎসার খোঁজ দিলেন হার্ভার্ড মেডিক্যাল স্কুলের ডেনা-ফার্বার ক্যানসার ইনস্টিটিউটের বিজ্ঞানী অরিন্দম বসু ও তাঁর দল। তাঁদের গবেষণাপত্রটি প্রকাশিত হয়েছে ‘ক্যানসার রিসার্চ’ পত্রিকায়।
বিজ্ঞানীরা জানাচ্ছেন, বহু ক্ষেত্রেই দেখা যায়, কোনও ব্যক্তির ক্যানসার আক্রান্ত হওয়ার কারণ লুকিয়ে থাকে তাঁর শরীরেই। যেমন ধরুন, এক ব্যক্তি সারা জীবন ধূমপান করে গেলেন, তাঁর ক্যানসার হল না। অথচ যিনি সিগারেট ছুঁয়েও দেখেননি, তিনি কর্কট রোগের শিকার হলেন। এই রহস্যের বীজ বহুলাংশে বপন করা থাকে মানবজিনে। অরিন্দম বসু জানিয়েছেন, শুধুমাত্র মানবদেহের নিজস্ব ‘ডিএনএ ড্যামেজ ও রিপেয়ার সিস্টেম’-এর জেনেটিক অস্বাভাবিকতার কারণে পাঁচ ধরনের ক্যানসার হওয়ার আশঙ্কা বেশি। এগুলি হল প্রস্টেট, প্যানক্রিয়াস, ব্রেস্ট, ওভারি ও ব্রেনের ক্যানসার। যেমন, হলিউড অভিনেত্রী অ্যাঞ্জেলিনা জোলির ব্রাকা জিনে মিউটেশন ছিল। স্তন ক্যানসারে আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা থাকায়, ম্যাসেকটোমি করিয়েছিলেন তিনি।
প্রচলিত ক্যানসার চিকিৎসায় (রেডিয়েশন ও কেমোথেরাপি) রোগীর ডিএনএ-র ক্ষতি করে ক্যানসার কোষগুলোকে হত্যা করা হয়। কোনও সুস্থ মানুষের শরীরে ছ’ধরনের ডিএনএ মেরামতির পদ্ধতি সক্রিয় থাকে। বিষয়টা এমন, মানুষের দেহে প্রায়শই নানা কারণে ডিএনএ ক্ষতিগ্রস্ত হতে থাকে। মানবদেহের ডিএনএ রিপেয়ার সিস্টেম আপনা থেকেই সেগুলিকে সারাতে থাকে। কিন্তু বহু ক্ষেত্রেই ক্যানসার কোষগুলোতে কোনও একটি ডিএনএ মেরামতি পদ্ধতি নিষ্ক্রিয় থাকে কোনও নির্দিষ্ট জেনেটিক মিউটেশনের জন্য। সেই মিউটেটেড জিনটিকে অথবা তার পাথওয়েকে চিহ্নিত করা জরুরি। এ সব ক্ষেত্রে দেখা যায়, ছ’টি ডিএনএ মেরামতির পদ্ধতির মধ্যে কোনও একটি অকেজো হলে অন্য একটি ডিএনএ রিপেয়ার পাথওয়ের উপর বেশি নির্ভরশীল হয়ে যায় কোষ। এখন এই অতিরিক্ত সক্রিয় পাথওয়েটিকেও যদি কোনও ভাবে অকেজো করে দেওয়া যায়, তা হলে ক্যানসার কোষ আর বাঁচে না। একে বলা হয় ‘সিন্থেটিক লিথাল কম্বিনেশন’।
এই চিকিৎসা পদ্ধতিতে খুঁজে বার করতে হবে রোগীর দেহের ওই একটি মিউটেটেড জিন (যা হল নিষ্ক্রিয় ডিএনএ রিপেয়ার পাথওয়ে) এবং তার কাজের দায়িত্ব নেওয়া দ্বিতীয় অতিরিক্ত সক্রিয় জিনটিকে। সাধারণত ‘সিন্থেটিক লিথাল কম্বিনেশন’-এ যে ওষুধ ব্যবহার করা হয়, তাকে বিজ্ঞানের ভাষায় বলে স্মল মলিকিউল ইনহিবিটর। চিকিৎসা বিজ্ঞান যত উন্নত হচ্ছে, এই ধরনের ইনহিবিটর-এর ব্যবহার বাড়ছে। বর্তমানে ক্যানসারের চিকিৎসায় অন্যতম কেমোথেরাপিউটিক ওষুধ হয়ে উঠছে এই ধরনের ইনিহিবিটর।
নরেন্দ্রপুর রামকৃষ্ণ মিশনের প্রাক্তনী অরিন্দম জানিয়েছেন, ডিম্বাশয়ের ক্যানসার নিয়ে তাঁদের গবেষণায় তাঁরা দু’টি ডিএনএ রিপেয়ার ইনহিবিটর ব্যবহার করেছেন। নিশানা করেছেন, দু’টি ডিএনএ রিপেয়ার পাথওয়েকে। তারা হল, এনএইচইজে (নন-হোমোলোগাস এন্ড-জয়েনিং) ও এমএমইজে (মাইক্রোহোমোলগি মেডিয়েট এন্ড জয়েনিং)। ইনহিবিটরের সাহায্যে এ ভাবে ক্যানসার কোষগুলিকে ধ্বংস করে একটি নতুন সিন্থেটিক লিথাল কম্বিনেশন আবিষ্কার করেছেন বিজ্ঞানীরা। এই চিকিৎসা পদ্ধতিতে তাঁরা টিপি৫৩ মিউটেটেড ক্যানসার কোষগুলিকে মেরে ফেলতে সক্ষম হয়েছেন। টিপি৫৩ হল ক্যানসারের জন্য দায়ী জিন, যা ক্যানসার তৈরি করে ও ছড়িয়ে দেয়।
ক্যানসার রোগীর বায়োপসি বা অস্ত্রোপচারে বাদ দেওয়া অংশ বা শরীরে জমা জলের নমুনা সংগ্রহ করে গবেষণাগারে পরীক্ষা চালিয়েছিলেন অরিন্দমরা। তিনি বলেন, ‘‘আমরা ডিম্বাশয়ের ক্যানসারে আক্রান্ত রোগীদের (যাঁদের ব্রাকা১ ও টিপি৫৩ মিউটেশন ছিল) নমুনা সংগ্রহ করেছিলাম। গবেষণাগারে সিন্থেটিক লিথাল কম্বিনেশন প্রয়োগ করতেই সাফল্য মিলেছে।’’
বাজারে এই ওষুধ আনার প্রস্তুতি চলছে দ্রুত গতিতে। গবেষণাগারে সাফল্য মিলতেই ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালের তোড়জোড় শুরু হয়েছে। ডিম্বাশয়ের ক্যানসারে দারুণ কার্যকরী হবে তাঁদের তৈরি ওষুধ, আশাবাদী অরিন্দম।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy