ছবি রয়টার্স।
তালিবান ফিরে এসেছে। ত্রাহি ত্রাহি রব উঠেছে আফগানিস্তানের বিজ্ঞানমহলে। তাই বিজ্ঞানী, গবেষকরাও এখন আফগান শরণার্থী! জান-প্রাণ বাজি ধরে তাঁদেরও ঘণ্টার পর ঘণ্টা দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা যাচ্ছে কাবুল বিমানবন্দরে ঢোকার গেটের বাইরে।
যাঁরা রাজনীতির সাতে-পাঁচে কস্মিনকালেও থাকেননি, সেই বিজ্ঞানী, গবেষকরাও এ বার আফগান শরণার্থী হয়ে প্রাণের দায়ে ছুটছেন এ-দেশ, ও-দেশে। মাথা গোঁজার একটুকরো ছাদের জন্য। নিরাপদ আশ্রয়ের জন্য।
হোক না তা মাসতিনেকের জন্য। তার পর না হয় আবার চলে যাওয়া যাবে অন্য কোনও দেশে। অথবা ফেরা যাবে নিজের দেশে। শরণার্থী হয়ে ভেসে চলা দেশ থেকে দেশান্তরে।
যে ভাবে পারেন আফগান মুলুক ছেড়ে আমেরিকা, জার্মানি, ফ্রান্স, ইটালি-সহ বিভিন্ন দেশে গিয়ে ঠাঁই খুঁজতে শুরু করেছেন আফগানিস্তানের যে বিজ্ঞানী ও গবেষকরা সেই দলে রয়েছেন পুরীর ‘গজা’ও (ডাক নাম)। কাবুলের অদূরে গমের ক্ষেত (তাঁর গবেষণা ক্ষেত্র) ফেলে যিনি টেক্সাসে পালিয়েছেন বাঁচার জন্য। দিনপাঁচেক আগে। ভারতে ফিরে এলে পিএইচডি শেষ করা সম্ভব হত না যে।
কাবুলে ‘আমেরিকান ইউনিভার্সিটি অব আফগানিস্তান’-এর কৃষিবিজ্ঞান বিভাগের গবেষক সৌম্য মহাপাত্র (নিরাপত্তার কারণে নাম পরিবর্তিত) বছর তিনেক আগে মেতে যান গবেষণাগারে উচ্চমানের অধিক ফলনশীল গমের বীজ তৈরির সাধনায়। আমেরিকার মিশিগান বিশ্ববিদ্যালয়ের সহযোগিতায়। এটাই ছিল পুরীর গজার পিএইচ ডি-র বিষয়।
টেক্সাস থেকে টেলিফোনে ‘আনন্দবাজার অনলাইন’-কে সৌম্য সোমবার বললেন, “দোহাই আমার আদত নামটি লিখবেন না। খুব বিপদে পড়ে যাব। ওরা ঠিক খুঁজে বার করে আমাকে মেরে ফেলবে। শুধু আমার ডাক নামটি উল্লেখ করতে পারেন। গজা। আমার আদত বাড়ি পুরীতে। পিএইচ ডি করতে গিয়েছিলাম কাবুলে।”
২০০১ সালে আমেরিকার সেনা মোতায়েনের পর আফগানিস্তানের বহু জায়গাতেই আফিম, গাঁজার চাষ পুরোপুরি বন্ধ হয়ে গিয়েছিল গত দু’দশকে। সেই জমিতে শুরু হয়েছিল ভাল জাতের গমের ফলন। দ্রুত ফলনশীল। গুণমানেও অনেক এগিয়ে।
কাবুলের অদূরে সেই গমের ক্ষেত ফেলেই দিনপাঁচেক আগে টেক্সাসে পালিয়েছেন পুরীর গজা। সৌম্য মহাপাত্র। কোনও মতে জোগাড় করা আমেরিকার খুব অল্প দিনের ভিসায়।
কাবুলে আমেরিকান ইউনিভার্সিটি অব আফগানিস্তানের কৃষিবিজ্ঞান বিভাগের গবেষক সৌম্য মহাপাত্র কাবুল লাগোয়া একটি মফস্সল এলাকায় বিশ্ববিদ্যালয়ের নেওয়া কয়েক বিঘা জমিতে গবেষণাগারে বানানো বীজ থেকে ‘সোনার গম’-এর ফলনও শুরু করেছিলেন গত বছর থেকে। একই জমিতে বছরে দু’-তিন বার সেই গম ফলানো যায়।
কিন্তু ১৫ অগস্টের পরই সৌম্য বুঝে যান আর তাঁর পক্ষে কাবুলে থাকা সম্ভব নয়। যে ভাবেই হোক এ বার পালাতে হবে।
কেন?
সৌম্যর কথায়, “ওরা (তালিবান) বিজ্ঞান, সভ্যতার উন্নয়নের চালিকাশক্তিকে ওদের পরম শত্রু বলে মনে করে। তাই বিজ্ঞানী, বিজ্ঞানের গবেষকদের ওরা সব সময় দেখে সন্দেহের চোখে। ২০০৯ সালে দক্ষিণ-পূর্ব আফগানিস্তানের গারদেজে ইউএস এজেন্সি ফর ইন্টারন্যাশনাল ডেভেলপমেন্ট-এর একটি বিজ্ঞান গবেষণামূলক প্রকল্পে কর্মরত আমার এক আফগান বন্ধুকে খুন করার চেষ্টা করেছিল তালিবরা। ওই বন্ধুর গবেষণাগারেই বোমা রেখে দিয়েছিল তালিবরা। বন্ধুটি বেঁচে গিয়েছিল সেই সময় গবেষণার কাজে জার্মানিতে গিয়েছিল বলে। কিন্তু সেই বোমা বিস্ফোরণে তাঁর আরও চার সতীর্থ গবেষক ও এক জন নিরাপত্তারক্ষী প্রাণ হারিয়েছিলেন। তার পর ২০১৯-এর জুলাইয়ে আফগানিস্তানের শিক্ষামন্ত্রকের একটি গবেষণা প্রকল্পে কাজ করার সময় কাবুলের অদূরে রাস্তায় আমার গাড়ির সামনে এসে দাঁড়িয়েছিল এক তালিবানের এক আত্মঘাতী বোমা। কিন্তু পিছনে দাঁড়ানো পুলিশটি তার মতলব বুঝে তাকে পিছন থেকে জাপটে ধরে তার বোমাটি নিষ্ক্রিয় করে তাকে ধরে নিয়ে যায়। বরাতজোরে বেঁচে গিয়েছিলাম সে দিন।”
সৌম্যর আফগান বন্ধু কাবুল পলিটেকনিক ইউনিভার্সিটির ওয়াটার ম্যানেজমেন্ট বিভাগের অধ্যাপক মহম্মদ আসিম মায়ার (নাম পরিবর্তিত)-ও গত সপ্তাহে পালিয়েছেন জার্মানিতে। হাইডেলবার্গ বিশ্ববিদ্যালয়ের ফেলোশিপ নিয়ে।
‘আনন্দবাজার অনলাইন’-কে মায়ার জানিয়েছেন, ২০০১ সালে তালিবরা উৎপাটিত হওয়ার পর গত ২০ বছরে আফগানিস্তান অনেকটাই বদলে গিয়েছিল। দেশটার খুব দ্রুত পরিবর্তন হচ্ছিল। গতি পেয়েছিল বিজ্ঞানের বিভিন্ন শাখার গবেষণা। সহায়তার হাত বাড়িয়ে দিয়েছিল আমেরিকার মিশিগান ও ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়। আমেরিকার জিওলজিক্যাল সার্ভে, আফগান মুলুকে খনিজ সম্পদের ভান্ডার নিয়ে গবেষণায়। এগিয়ে এসেছিল ব্রিটেন ও জার্মানিরও কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয়। অগ্রাধিকার পেতে শুরু করেছিল কম্পিউটার বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিবিদ্যা। তালিবান জমানায় আফগানিস্তানে উচ্চশিক্ষার প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা ছিল হাতে গোনা। আর গত বছরে সেটা বেড়ে ১০০-রও বেশি হয়ে গিয়েছিল। সেগুলিতে মহিলাদের অংশগ্রহণও বেড়েছিল উল্লেখযোগ্য ভাবে। তাই ২০১৬ সালে কাবুলে আমেরিকান ইউনিভার্সিটি অব আফগানিস্তান টার্গেট হয়ে ওঠে তালিব জঙ্গিদের। বিশ্ববিদ্যালয় চত্বরে তালিবদের রাখা বোমা বিস্ফোরণে ১৩ জনের মৃত্যু হয়। গুরুতর জখম হন ৫০ জনেরও বেশি অধ্যাপক, ছাত্রছাত্রী, গবেষক।
“গত সপ্তাহে তালিবান কাবুলের দখল নেওয়ার পর বাড়িতে বাড়িতে ঢুকে তল্লাশি হচ্ছে। বিজ্ঞানী, বা বিজ্ঞানের গবেষক হলে তো আর রেহাই নেই। তাঁদের গোপনে তুলে নিয়ে রাখা হচ্ছে তালিবান হেফাজতে”, বললেন মায়ার।
সৌম্য জানালেন, গত সপ্তাহে তালিবরা কাবুল দখল করার পর আফগানিস্তানের গারদেজে পাকতিয়া বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালনার জন্য ইতিমধ্যেই তাদের পছন্দের এক জন রেক্টরকে নিয়োগ করেছে।
আফগানিস্তানের বিপন্ন বিজ্ঞানী, গবেষকদের পাশে এসে দাঁড়িয়েছে অবশ্য রাষ্ট্রপুঞ্জের অধীনস্থ সংস্থা ‘স্কলার্স অ্যাট রিস্ক (এসএআর বা সার) নেটওয়ার্ক’। সংস্থার এগজিকিউটিভ ডিরেক্টর রবার্ট কুইন 'আনন্দবাজার অনলাইন-'কে ইমেল জবাবে জানিয়েছেন, আফগানিস্তানের অন্তত আড়াই হাজার বিজ্ঞানী, গবেষকের যৌথ স্বাক্ষরিত একটি চিঠি তাঁরা পেয়েছেন। সেই চিঠিতে আফগানিস্তানের বিপন্ন বিজ্ঞানী, গবেষকরা আমেরিকার বিদেশসচিব অ্যান্টনি ব্লিঙ্কেনের কাছে সে দেশের ভিসা আইন সাময়িক ভাবে শিথিল করে তাঁদের যত তাড়াতাড়ি সম্ভব আমেরিকায় গিয়ে স্থগিত গবেষণা ফের শুরু করার সুযোগ দেওয়ার আর্জি জানিয়েছেন।
ইমেলে রবার্ট কুইন লিখেছেন, “আমরা ইতিমধ্যেই আমেরিকার বিদেশসচিবের কাছে সেই চিঠি পাঠিয়ে এ ব্যাপারে সহানুভূতির সঙ্গে বিবেচনার অনুরোধ জানিয়েছি। পুরীর সৌম্য মহাপাত্র তড়িঘড়ি টেক্সাসে চলে যেতে পেরেছে আমাদেরই সহযোগিতায়। আমরা আমেরিকায় সৌম্যর ভিসার ভিসার মেয়াদ বাড়ানোর চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি। আফগানিস্তানের বিপন্ন বিজ্ঞানী, গবেষকদের সাহায্যে এগিয়ে এসেছে মিশিগান ও ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ও। ২০১৭ সাল থেকে উন্নতমানের অধিক ফলনশীল শস্য উৎপাদনের গবেষণায় কাবুল বিশ্ববিদ্যালয়ে ১২ জন মহিলা-সহ বিভিন্ন দেশের ৩৩ জন পিএইচডি করছিলেন মিশিগান বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রকল্পে। তাঁদের যে ভাবেই হোক যত তাড়াতাড়ি সম্ভব কাবুল থেকে আমেরিকায় নিয়ে যেতে উদ্যোগী হয়ে উঠেছে মিশিগান বিশ্ববিদ্যাল়য়।”
আর কী ফিরতে চান কাবুলে?
টেক্সাস থেকে টেলিফোনে গজা বললেন, “আমার মা, বাবা এখনও কাবুলেই আছেন। খুব চিন্তা হচ্ছে ওঁদের জন্য। আমি ওঁদেরও আমেরিকায় নিয়ে আসার কথা ভাবছি। তবে আমি আর ফিরতে চাই না কাবুলে। অন্তত যত দিন সেখানে ক্ষমতায় থাকবে তালিবরা।”
“আমি মরতে চাই না যে…” বলেই টেলিফোনের লাইন কেটে দিলেন সৌম্য।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy