প্রতীকী ছবি।
আরব সাগরের তীরবর্তী শহরটা পাকিস্তানের বাণিজ্যিক রাজধানী। পাকিস্তানের সবচেয়ে বড় বন্দর-নগরীও বটে। পশ্চিমি দুনিয়ার কাছে ইসলামাবাদের চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ পাকিস্তানের এই শহর। কিন্তু করাচিতে এখন ইউরোপ বা আমেরিকার লোকজনের চেয়ে চিনাদের আনাগোনা অনেক বেশি। শহরের যে কোনও বড় হোটেলে, বড় বাণিজ্যিক সংস্থায়, দামী রেস্তোরাঁয়, অভিজাত এলাকায় চোখ ফেরালেই এখন ইতিউতি স্যুটেড-বুটেড চিনাদের দেখা মেলে। পদস্থ সরকারি কর্তাদের দফতরে চিনা কর্পোরেটদের অবাধ যাতায়াত। করাচির বাণিজ্যিক সংস্থাগুলি উর্দু, সিন্ধি এবং ইংরেজির পাশাপাশি এখন চিনা ভাষাতেও ব্রোশিওর ছাপছে। যে সব পাকিস্তানিরা চিনা ভাষা জানেন, বিভিন্ন বাণিজ্যিক সংস্থায় তাঁদের দর আচমকা বেড়ে গিয়েছে, বেতন বেড়ে গিয়েছে।
কয়েক বছর আগেও কিন্তু ছবিটা এ রকম ছিল না। গত দু’তিন বছরেই এই বদলটা এসেছে এবং অত্যন্ত দ্রুত এসেছে। বলছেন পাক কর্পোরেটরা। চায়না-পাকিস্তান ইকনমিক করিডর বা সিপিইসি-র হাত ধরেই এই বদল। পাকিস্তানের ভূখণ্ডকে ব্যবহার করে চিন নিজেদের দেশের পশ্চিমাংশকে আরব সাগরের তীরবর্তী গোয়াদর বন্দরের সঙ্গে জুড়ে ফেলেছে। দ্রুত বাড়ছে সড়ক এবং রেল পরিকাঠামো। আর পাল্লা দিয়ে বাড়ছে পাকিস্তানে চিনা বিনিয়োগ।
গোয়াদর বন্দরই হতে চলেছে আরব সাগরের সবচেয়ে বড় চিনা ঘাঁটি। ছবি: সংগৃহীত।
সিপিইসি-র জন্য পাকিস্তানে ৫৭০০ কোটি ডলার বিনিয়োগ করছে চিন। এই বিনিয়োগের মাধ্যমে পশ্চিম চিনের এক বিরাট অংশ আরব সাগরে একটি বন্দর পাচ্ছে। মধ্য এশিয়া এবং আফ্রিকার সঙ্গে সমুদ্রপথে চিনের বাণিজ্য আগের চেয়ে অনেক সহজ হচ্ছে। আরব সাগরে চিনা নৌসেনার জন্যও স্থায়ী ঘাঁটি তৈরি থাকছে।
পাকিস্তানের কী লাভ হচ্ছে? পাক কর্পোরেটদের বড় অংশই জানাচ্ছেন, পাকিস্তানের অর্থনীতি দারুণ ভাবে লাভবান হচ্ছে। সিপিইসি-র আওতায় পাকিস্তানে সড়ক ও রেল পরিকাঠামোর ব্যাপক উন্নতি তো হচ্ছেই। কিন্তু তাতেই শেষ নয়। চিনা বাণিজ্যিক সংস্থাগুলি পাকিস্তানের ইস্পাত, সিমেন্ট, শক্তি (বিদ্যুৎ) এবং বস্ত্র শিল্পে বিপুল বিনিয়োগ করছে। ২৭০০০ কোটি ডলারের পাক অর্থনীতির মেরুদণ্ড এই চারটি ক্ষেত্র। বিপুল চিনা বিনিয়োগে সেই মেরুদণ্ড অনেক মজবুত হতে চলেছে বলে পাক সরকার মনে করছে।
গোয়াদর বন্দরে চিনা পণ্য। —ফাইল চিত্র।
ঠিক কী পরিমাণে চিনা বিনিয়োগ ঢুকছে পাকিস্তানে? নমুনা দেখে নেওয়া যাক। চিনা সংস্থাগুলির নেতৃত্বে গঠিত একটি বাণিজ্যিক জোট সম্প্রতি সরাসরি পাকিস্তান স্টক এক্সচেঞ্জে বড়সড় অংশীদারিত্ব নিয়ে নিয়েছে। আর এক চিনা সংস্থা সাংহাই ইলেকট্রিক পাওয়ার সম্প্রতি ১৮০ কোটি ডলার লগ্নি করে পাকিস্তানের সবচেয়ে বড় শক্তি উৎপাদক সংস্থা কে-ইলেকট্রিককে কিনে নিয়েছে। পাকিস্তানের বেসরকারিকরণ মন্ত্রী মহম্মদ জুবেইর জানিয়েছেন, তাঁদের রাষ্ট্রায়ত্ত ইস্পাত সংস্থা পাকিস্তান স্টিল মিলসকে চিনা ইস্পাত সংস্থা বাওস্টিল ৩০ বছরের জন্য লিজ নেওয়ার বিষয়ে আলোচনা চালাচ্ছে।
চিনা কর্পোরেটরা পাকিস্তানে জমিও কিনছেন বিপুল পরিমাণে। করাচি, লাহৌর এবং ইসলামাবাদের যে সব অঞ্চলে জমির দাম সবচেয়ে বেশি, সেই সব এলাকাই কিনে নিতে চাইছেন চিনারা। ব্যবসায় চিনাদের কর এবং শ্রম আইন সংক্রান্ত সুবিধা দিতে পাক প্রশাসন এখন বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল বা এসইজেড গড়ে দিচ্ছে। ফলে চিনা বিনিয়োগকারীদের পথ আরও সুগম হয়ে গিয়েছে। পাকিস্তানের বিভিন্ন শহরে এবং লাগোয়া এলাকায় একের পর এক চিনা সংস্থা জমি কিনতে শুরু করেছে। অল্প জমিও নয়, চিনা লগ্নিকারীরা শ’য়ে শ’য়ে একর জমি কেনার দিকে ঝুঁকেছেন। ফলে পাকিস্তানের শহর এবং লাগোয়া এলাকাগুলিতে জমির দাম বাড়ছে হু হু করে। করাচির মতো শহরে আবাসন শিল্প দ্রুত বাড়ছে। একের পর এক আকাশচুম্বী বহুতল গড়ে উঠছে।
আরও পড়ুন: একসঙ্গে ১০টি নিউক্লিয়ার ওয়ারহেড জুড়ে ক্ষেপণাস্ত্র ছুড়ল চিন! কীসের ইঙ্গিত?
তবে সবটা কিন্তু মসৃণ নয়। জঙ্গি নাশকতার আতঙ্ক সব সময় তাড়া করছে সিপিইসি কর্তাদের। তার সঙ্গে শুরু হয়ে গিয়েছে শ্রমিক আন্দোলনও। যে সব চিনা সংস্থা আফ্রিকায় ব্যবসা করে, তাদের বিরুদ্ধে স্থানীয় শ্রমিকদের সঙ্গে চূড়ান্ত দুর্বব্যবহারের অভিযোগ রয়েছে। চিন সে কথা স্বীকার করে না। কিন্তু পাক শ্রমিক সংগঠনগুলি বলছে, পাকিস্তানের শিল্পক্ষেত্রকে পুরোপুরি নিজেদের নিয়ন্ত্রণে নেওয়ার পর চিনারা পাক শ্রমিকদের সঙ্গেওওই রকম দুর্ব্যবহারই করবে। পাকিস্তানের জাতীয় শ্রমিক সংস্থা ‘ন্যাশনাল ট্রেড ইউনিয়ন ফেডারেশন-পাকিস্তান’এর ডেপুটি জেনারেল সেক্রেটারি নাসির মেহমুদ নিজেই এই আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন। তাই পাক অর্থনীতির সিংহভাগের নিয়ন্ত্রণ চিনাদের হাতে চলে না যেতে দেওয়ার দাবিতেও আন্দোলন শুরু হয়ে গিয়েছে।
এ সবের মধ্যেই এগোচ্ছে সিপিইসি। কিন্তু ভবিষ্যৎ কতটা মধুর, তা নিয়ে সংশয় দু’তরফেই থাকছে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy