আফগানিস্তানে তালিবান বাহিনী। ছবি: সংগৃহীত।
সংখ্যা এবং অস্ত্রের নিরিখে প্রতিপক্ষের তুলনায় পিছিয়ে থেকেও যুদ্ধে জেতার নজির বারে বারেই রেখেছে আফগান যোদ্ধারায় যার সাম্প্রতিকতম উদাহরণ দেখা গেল এ বার। আমেরিকার বাহিনীর প্রশিক্ষিত প্রায় ৩ লক্ষ আফগান সেনাকে হঠিয়ে গোটা দেশ দখল করল তালিবান।
গত সপ্তাহে পেন্টাগনের একটি রিপোর্টে বলা হয়েছিল, কাবুল দখল করতে আরও তিন মাস লাগবে তালিবানের। কিন্তু কয়েক দিনের মধ্যেই সেই হিসেব উল্টে রাজধানী শহরের দখল নিয়েছে তালিব যোদ্ধারা। বস্তুত, আফগানিস্তানের হাতে গোনা কয়েকটি অঞ্চল বাদে পুরোটাই তাদের নিরঙ্কুশ নিয়ন্ত্রণে। এর আগে ১৯৯৬ সাল থেকে ২০০১ পর্যন্ত লাগাতার লড়াই চালিয়েও আফগানিস্তানের এত বেশি এলাকার দখল নিতে পারেননি পাক সহায়তাপ্রাপ্ত তালিবান বাহিনী।
সামরিক দৃষ্টিকোণ থেকে প্রায় ‘অসাধ্যসাধন’ সম্ভব হল কী ভাবে? ধর্মীয় উম্মাদনার পাশাপাশি তালিবান নেতৃত্বের নিখুঁত কৌশলেই এমন দ্রুতগতির জয় সম্ভব হয়েছে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞেরা।
তাঁদের মতে, দীর্ঘ দু’দশক ধরে আফগানিস্তানে বিদেশি সেনার উপস্থিতি মেনে নিয়ে পারেননি সংখ্যাগুরু পাশতুন জনগোষ্ঠী। তালিবান যোদ্ধাদের প্রায় সকলেই এই জাতির। উনবিংশ শতকে ব্রিটিশ এবং আশির দশকে সোভিয়েত ইউনিয়নের সেনার বিরুদ্ধে ‘প্রতিরোধেও’ অগ্রণী ভুমিকা ছিল পাশতুনদের। এ বার আমেরিকার সেনা প্রত্যাহার শুরু হতেই বিশেষত গ্রামাঞ্চলের পাশতুন গোষ্ঠী সক্রিয় ভাবে তালিবানের পাশে দাঁড়ায়। তাই মূল লড়াইয়ে প্রায় ৭০ হাজার তালিবান যোদ্ধা অংশ নিলেও দেড় লক্ষেরও বেশি সহযোগী মিলিশিয়া বাহিনীর সক্রিয় সমর্থন পেয়েছে তারা। এলাকা এবং ভূপ্রকৃতি সম্পর্কে স্থানীয় সহযোগীদের জ্ঞানও কাজে লেগেছে। যুদ্ধক্ষেত্রে যা নির্ণায়ক হয়েছে।
আক্রমণের অভিমুখ নির্বাচনের ক্ষেত্রেও এ বার অনেক বেশি দক্ষতা দেখিয়েছে তালিবান। ১৯৯৬ সালে তারা পাশতুন অধ্যুষিত দক্ষিণাঞ্চল থেকে কাবুলে অভিযান চালিয়েছিল। এ বার আক্রমণ ছিল ‘বহুমুখী’। সংখ্যালঘু হাজারা, তাজিক, উজবেক, তুর্ক এবং পামিরি অধ্যুষিত উত্তর এবং পশ্চিম আফগানিস্তানের এলাকাগুলিতে বিশেষ ভাবে ‘নজর’ দিয়েছিলেন হিবাতুল্লা আখুন্দজাদা, মোল্লা বরাদর, মহম্মদ ইয়াকুবরা। ফলে জুলাইয়ের গোড়াতেই ইরান, তুর্কমেনিস্তান, উজবেকিস্তান, তাজিকিস্তান সীমান্তবর্তী বহু এলাকা তাদের নিয়ন্ত্রণে চলে আসে। আফগান সেনা এবং ওই এলাকায় সক্রিয় তালিবান-বিরোধী মিলিশিয়া গোষ্ঠীগুলির মনোবল তলানিতে ঠেকে।
মাত্র তিন মাসের তৎপরতায় দেশ দখলের পিছনে তালিবানের অর্থশক্তিও বিপুল অর্থশক্তি ‘বড় কারণ’ বলে মনে করছেন সামরিক বিশেষজ্ঞদের অনেকেই। আর সেই অর্থ আসে নানা পথ ধরে। ২০১৮-য় তালিবানের আনুমানিক সম্পদ ছিল ৮০ কোটি ডলার (প্রায় ৬,০০০ কোটি টাকা)। আমেরিকার গোয়েন্দা রিপোর্ট বলছে, ২০২০-তে তা দেড়শো কোটি ডলার (প্রায় ১১ হাজার ১০০ কোটি টাকা) হয়। অন্যদিকে, প্রতিপক্ষ আফগান সেনার বেতনের খরচের জন্যও ওয়াশিংটনের খয়রাতির চেয়ে থাকত হয়। ২০২০ সালের হিসেব বলছে, আফগান সরকার আদায় করা রাজস্বের থেকে মাত্র ২৬.২ কোটি ডলায় (২,০০০ কোটি টাকা) প্রতিরক্ষা খাতে ব্যয় করে। আমেরিকায় সাহায্য আসে প্রায় ৮০ হাজার কোটি টাকার।
তালিবানের অর্থ আমদানির বৃহত্তম উৎস হল খনি। বছরে প্রায় ৩,৫০০ টাকা। দক্ষিণ আফগানিস্তানের অধিকৃত অঞ্চল থেকে নিকেল, টাংস্টেন, সোনা, রুপো, মূল্যবান পাথর, লিথিয়াম, প্রাকৃতিক গ্যাস উত্তোলন করে তারা। সরকার নিয়ন্ত্রিত অঞ্চলে বৈধ খনিগুলি থেকেও নিয়মিত তোলা আদায় চলে। চলে স্থানীয়দের ব্যবসা এবং কৃষি থেকেও ‘কর’ আদায়। সেই সঙ্গে আফিম চাষ। ড্রাগের চোরাচালান এবং পশ্চিম এশিয়ার নানা দেশ থেকে পাওয়া ‘সরকারি-বেসরকারি’ অর্থসাহায্যে পুষ্ট তালিবানের পক্ষে সরকারি আধিকারিক এবং সেনার একাংশকে ঘুষ দিয়ে এলাকা দখল সহজ হয়েছে বলে কয়েকটি রিপোর্টে দাবি। দলত্যাগী সেনাদের বিপুল অস্ত্রশস্ত্র এবং সামরিক সরঞ্জাম হাতে আসার ফলে আগ্রাসনের গতিও বাড়ায় তারা।
আফগান ফৌজের এমন গণ-দলত্যাগ সম্পর্কে সামরিক পর্যবেক্ষক সংস্থা ‘রয়্যাল ইউনাইটেড সার্ভিসেস ইনস্টিটিউট’-এর জ্যাক ওয়াটলিং বলেন, ‘‘আফগান সেনাবাহিনীও নিশ্চিত ছিল না, ঠিক কত সেনা রয়েছেন।’’ একটি রিপোর্টে বলা হয়েছে, অনেক ক্ষেত্রে আফগান বিমানবাহিনীর যুদ্ধবিমান ও চপার আকাশে ওড়ার আগেই ঝটিকা হামলায় ‘এয়ারস্ট্রিপে’র দখল নিয়েছে তালিবান।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy