স্মরণ: জর্জ ফ্লয়েডের স্মৃতিতে নীরবতা পালন করছেন ডেমোক্র্যাট সদস্যেরা। ক্যাপিটলে। এপি
প্রাক্তন এনবিএ খেলোয়াড় স্টিফেন জ্যাকসন বলছিলেন, ‘‘জর্জ আমার ভাই ছিল। আমরা একই স্বপ্ন দেখতাম।’’ কীসের স্বপ্ন? খেলাধুলোর স্বপ্ন। মৃত্যুর পর কখনও-কখনও কোনও অচেনা ব্যক্তি, তাঁর স্বপ্নও খুব কাছের হয়ে ওঠে। আর সেই মৃত্যু যদি মাটিতে মুখ উল্টোনো, যাঁর ঘাড়ের উপরে সাঁড়াশির মতো এক জনের হাঁটু ক্রমশই শ্বাস যাতায়াতের পথকে রুদ্ধ করে দিতে থাকে, এবং সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি অস্পষ্ট ভাবে, বাঁচার তাগিদে বলতে থাকেন, ‘মা, মা, আমার দমবন্ধ হয়ে আসছে’—তখন সেই মৃত্যুর সঙ্গে মনে হয় নিজের সত্তারই একটা অংশ মরে গেল। যেমন মরেছিল বছর উনিশ আগে। যখন বিমান হানায় ধূলিসাৎ হয়েছিল ‘টুইন টাওয়ারস’।
সন্ত্রাসবাদী হানার শিকার আমেরিকা আর এক কৃষ্ণাঙ্গের মৃত্যুতে উত্তাল আমেরিকা এক নয় ঠিকই। তবে অনেকেই বলছেন, গ্রাউন্ড জ়িরোয় শোকজ্ঞাপনকারীদের পরিবারেরই কেউ না কেউ সেই সন্ত্রাসবাদী হামলায় মারা গিয়েছিলেন, তা তো নয়! তেমনই এই মুহূর্তে আমেরিকায় বিক্ষোভকারীদের সকলেই জর্জ ফ্লয়েডের আত্মীয়-বন্ধু নন।
‘‘এক জন তরুণ কৃষ্ণাঙ্গকে বিক্ষোভের কারণ জিজ্ঞেস করায় সে বলল, রাস্তায় ও ভাবে পুলিশের হাঁটুর নীচে মুখ থুবড়ে পড়া মানুষটা আমার বাবা হতে পারত, আমার ভাই হতে পারত। ওই মানুষটা আমি নিজেই হতে পারতাম!’’— করোনা-ধ্বস্ত দেশে সংক্রমণের তোয়াক্কা না-করে মানুষ কেন রাস্তায় নেমে পড়েছেন, প্রতিবেদকের এই প্রশ্নে বললেন অ্যান্টনি বলডেন। ক্যানসাস বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘আফ্রিকান অ্যান্ড আফ্রিকান-আমেরিকান স্টাডিজ’-এর অ্যাসোসিয়েট প্রফেসর বলডেন একাধিক বইয়ে লিখেছেন, ‘অনেক কৃষ্ণাঙ্গ কবি, যাঁদের কবিতার ভিত্তি কৃষ্ণাঙ্গদের ‘ভার্নাকুলার কালচার’, সেই কবিতাগুলিকে বিশ্ববিদ্যালয়-সহ অন্যত্র থেকে ব্রাত্য রাখা হয়েছে।’
আরও পড়ুন: ওয়াশিংটনে সেই রাতে প্রতিবাদীদের আশ্রয় দিয়ে ‘হিরো’ ভারতীয় বংশোদ্ভূত ব্যবসায়ী
আর দীর্ঘদিনের সেই ব্রাত্যবোধের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে করোনা-সময়ে সাধারণ মানুষের কাজ হারানোর জটিলতা, যা বিক্ষোভে অনুঘটকের কাজ করছে বলে মনে করছেন অনেকে। কিন্তু করোনা তো ধনী-দরিদ্র্যের মধ্যে বিভেদ রাখেনি। কথা শুনে ফুঁসে উঠলেন নোবেলজয়ী অস্ট্রেলীয় পিটার.সি ডোয়ার্টি। এই প্রতিবেদককে তিনি বললেন, ‘‘কিচ্ছুটি পাল্টায়নি। আমেরিকায় দেখুন, সব থেকে বেশি হারে প্রান্তিক মানুষেরাই মারা যাচ্ছেন!’’ ঘটনাচক্রে, করোনায় মৃত্যুর হার নিয়ে আমেরিকারই ‘এপিএম রিসার্চ ল্যাব’-এর সাম্প্রতিক রিপোর্টে তাঁর বক্তব্যের প্রতিফলনই দেখা যাচ্ছে। সংশ্লিষ্ট গবেষণা সংস্থার ম্যানেজিং পার্টনার ক্রেগ হামস্ট্যাটারের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি জানান, পরিবার নিয়ে মেডিক্যাল লিভ-এ রয়েছেন। এপিএম-এর গবেষণা জানাচ্ছে, প্রতি এক লক্ষ জনসংখ্যায় কৃষ্ণাঙ্গদের মৃত্যুর হার ৫৪.৬, দেশের মধ্যে যা সর্বাধিক। সেখানে প্রতি লক্ষে শ্বেতাঙ্গদের মৃত্যুর হার ২২.৭, দেশের মধ্যে সর্বনিম্ন।
আমেরিকার এক অর্থনীতিবিদ আনন্দবাজারকে জানাচ্ছেন, করোনা-ত্রস্ত কৃষ্ণাঙ্গের পুলিশি অত্যাচারের ঘটনার সঙ্গে অর্থনৈতিক-রাজনীতির সূত্র জড়িয়ে রয়েছে। আমেরিকার প্রভাবশালী অংশ চাইছে আমেরিকাকে পুরোপুরি কর্পোরেট দেশ করে তুলতে। যেখানে দৈনিক মজুরি কমিয়ে দেওয়া যাবে। তাঁর কথায়, ‘‘তবে এতে শ্বেতাঙ্গদের একাংশ আপত্তি তুলতে পারেন। তাই কৃষ্ণাঙ্গরা বাড়তি সুযোগ পাচ্ছেন, এমন চিত্র তুলে ধরে কৌশলে বর্ণবিদ্বেষ ছড়ানো হচ্ছে।’’ ‘আমেরিকান সোশিয়োলজিক্যাল অ্যাসোসিয়েশন’-এর ভাইস প্রেসিডেন্ট তথা ম্যাসাচুসেটস-আমহার্স্ট বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘ইনস্টিটিউট ফর সোশ্যাল সায়েন্স রিসার্চ’-এর ডিরেক্টর জয়া মিশ্রের কথায়, ‘‘করোনা ও জর্জ ফ্লয়েডের মৃত্যু, পরস্পর সম্পর্কযুক্ত ঘটনায় জন-বিক্ষোভের মাধ্যমে রাগের সঙ্গে এত দিন মিশে থাকা দুঃখ, কষ্টও পুঞ্জীভূত লাভার মতো বেরিয়ে আসছে!’’
১৯১৫ সালে গঠিত ‘অ্যাসোসিয়েশন ফর দ্য স্টাডি অব আফ্রিকান-আমেরিকান লাইফ অ্যান্ড হিস্ট্রি’ (যে সংগঠনের প্রতিষ্ঠাতা কার্টার জি. উডসনের নেতৃত্বে প্রায় ১০০ বছর আগে প্রথম ‘নিগ্রো হিস্ট্রি উইক’ উদ্যাপন শুরু হয়েছিল, যা কালক্রমে ‘ব্ল্যাক হিস্ট্রি মান্থ’-এ রূপ পায়)-এর বর্তমান প্রেসিডেন্ট এভেলিন ব্রুকস হিগিনবোথাম ওয়েবসাইটে লিখেছেন— কোভিড-১৯ হোক বা জর্জ ফ্লয়েড, আফ্রিকান-আমেরিকানদের মৃত্যু খুব সহজে হয়। তার পরেই এভেলিনের আবেদন,—‘নিজেদের জন্য, সন্তানদের জন্য প্রতিবাদ আমরা করবই, কিন্তু সেটা করব অহিংস ভাবে!’ অনেকে বিস্মিত হয়েছেন এই আবেদনে। কারণ, ধারাবাহিক ভাবে বঞ্চিত মানুষদের সংগঠন যখন অহিংস প্রতিবাদের আবেদন জানায়, তখন বোঝা যায়, ক্ষমতা-স্পর্ধার বিবেক না থাকলেও সাধারণ মানুষ, বঞ্চিত মানুষের বিবেক রয়েছে। ‘আফ্রিকান অ্যান্ড আফ্রিকান-আমেরিকান স্টাডিজ’-এর অ্যাক্টিং চেয়ার সিসিল অ্যাকিলেন প্রতিবেদককে বললেন, ‘‘জর্জ ফ্লয়েডের মৃত্যু আসলে আমেরিকার প্রাতিষ্ঠানিক বর্ণবিদ্বেষ ও অসাম্যের অংশ মাত্র। বাস্তবে অনেকেই নিজেকে জর্জের সঙ্গে একাত্ম করে দেখতে পেরেছেন।’’ তাই বলডেনের প্রশ্নের উত্তরে ওই তরুণ কৃষ্ণাঙ্গ বলেছিলেন, ‘‘পুলিশের হাঁটুর নীচে মুখ খুবড়ে পড়া মানুষটা আমিও হতে পারতাম!’’
যে কারণে ইয়েল বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘লিলিয়ান চ্যাভেনসন সেডেন প্রফেসর অব সোশিয়োলজি’ তথা ‘সেন্টার ফর কালচারাল সোশিয়োলজি’র কো-ডিরেক্টর সমাজতত্ত্ববিদ জ়েফ্রি সি অ্যালেকজ়ান্ডারও বলছেন, ‘‘জর্জ ফ্লয়েডের ঘটনাটা সেই সমস্ত মানুষের সামাজিক বঞ্চনা ও দুরবস্থার প্রতীক—যাঁরা এত দিন কোথাও, কোনও সুবিচার পাননি!’’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy