লিঙ্কন আর লুথার নির্মিত সমতার মানচিত্র হারিয়ে যাচ্ছে। গ্রাফিক: শৌভিক দেবনাথ।
একদা মসি ছিল অসির চেয়ে ঢের বেশি শক্তিশালী। আর এই উত্তরাধুনিক দুনিয়ায়, এই ‘ডিজিটাল ডাইন্যাসটি’-র আমলে, কলমের চেয়ে অনেক বেশি প্রভাবশালী হল ক্যামেরা। গোটা পৃথিবী সবিস্ময়ে তার প্রামাণ্য ভিডিয়ো দেখল, অতি সম্প্রতি, মিনেসোটা প্রদেশের মিনিয়াপোলিস শহরে।
স্রেফ একটা ছবি রীতিমতো একটা সামাজিক বিপ্লব ঘটিয়ে দিল মার্কিন মুলুকে। এবং ইতিহাস বলছে, গত শতকের ছয়ের দশকের মাঝপর্বে বর্ণবৈষম্য ও সামাজিক অসাম্যের বিরুদ্ধে মার্টিন লুথার কিংয়ের সেই গণআন্দোলনের পর, এমনটা আর কখনও দেখেনি আমেরিকা। এটা যে ঘটল তার কারণ, মার্টিন লুথার যে সুষম সমাজের স্বপ্ন দেখেছিলেন, সেটা এখনও বাস্তবায়িত হয়নি সুসভ্য এবং সমৃদ্ধ আমেরিকায়। বরং বাস্তবটা হল এই যে, ওই ভিডিয়ো ক্লিপিংসটা একটা ‘শো-কেস’ মাত্র, যেটা বিবৃত করে, এ রকম আরও আছে। যুগযুগান্ত ধরে ‘সেই ট্র্যাডিশন সমানে চলেছে’! সেই কৃষ্ণাঙ্গদের ওপর শ্বেতাঙ্গদের ‘গায়ের জোর’! সেই সংখ্যালঘুদের ওপর সংখ্যাগুরুদের ‘বলপ্রয়োগ’! সে দিনের মিনিয়াপোলিসের ওই ছবিটা আরও একবার জানান দিল, ‘গভীরে যাও, আরও গভীরে যাও’।
আশ্চর্যের ব্যাপার হল, এমন একটা ঘটনার শুরুটা ছিল এক্কেবারে সাদামাটা। বছর ছেচল্লিশের জর্জ ফ্লয়েড একটা দোকানে ঢুকেছিলেন সিগারেট কিনতে। ওই দোকানের এক কর্মচারীর অভিযোগ, ফ্লয়েড একটা জাল নোট (২০ ডলার) ব্যবহার করেছিলেন। এটা ওই কর্মী বুঝতে পারেন ফ্লয়েড দোকান থেকে বেরিয়ে যাওয়ার পর। সঙ্গে সঙ্গে ওই কর্মী বাইরে বেরিয়ে দেখেন ফ্লয়েড তখনও তাঁর গাড়িতে বসে আছেন। তাঁকে সেটা জানালে ফ্লয়েড অভিযোগ অস্বীকার করেন। সম্ভবত উনি মদ্যপ ছিলেন। স্বভাবতই ওই দোকানকর্মী পুলিশ ডাকেন। পুলিশ আসে। ফ্লয়েড আবারও অভিযোগ অস্বীকার করেন। ওই দোকানের ক্লোজড সার্কিট ক্যামেরায় দেখা গিয়েছে, ওই অবস্থায় অকারণে উত্তেজিত হয়ে পড়েন ওই শ্বেতাঙ্গ পুলিশকর্তা ডেরেক শভিন। ফ্লয়েডের ‘অপরাধের অতীত’ নিয়ে কোনও তথ্য পুলিশের কাছে ছিল না। ফ্লয়েড নিরস্ত্র ছিলেন। ফ্লয়েড কাউকে মারতে উদ্যত হননি। তবু ফ্লয়েডকে গাড়ি থেকে টেনে বের করে, তাঁকে মাটিতে ফেলে দিয়ে, ক্রুদ্ধ কসাইয়ের মতো তাঁর ঘাড় নিজের হাঁটু দিয়ে সজোরে চেপে ধরেন শভিন। ফ্লয়েড চেঁচিয়ে ওঠেন, ‘আমি মরে যাচ্ছি। আমি শ্বাস নিতে পারছি না’। শভিন নির্বিকার। চোখেমুখে তাঁর বাহাদুরির ছাপ। এবং সহকর্মীর এই ‘হত্যালীলা’ তখন ভাবলেশহীন মুখে চেয়ে দেখছেন আরও তিন পুলিশকর্তা। যে রক্ষক, সেই-ই ভক্ষক। ছবি দেখে মনে হওয়া স্বাভাবিক যে, পুলিশ ‘খুন’ করছে, ঠান্ডা মাথায়!
ওকল্যান্ডে জমায়েত। আমেরিকার শহরে-গ্রামে এ ভাবেই পথে নেমেছেন মানুষ। ছবি: পিটিআই।
ব্রেখটের পদ্যে আছে, ‘জঙ্গল যদি পুলিশে ছয়লাপ হয়ে যায়, তা হলে আর কেউ কোনও দিন গাছকে নিয়ে কবিতা লিখবে না’! জোর যার মুলুক তার। একে পুলিশ, তায় শ্বেতাঙ্গ, উপরন্তু ‘শিকার’ হল কৃষ্ণাঙ্গ। এবং, বন্দুক থাকলেই বীর! রাষ্ট্রবিজ্ঞানীরা এই কারণেই ‘শাসন’-কে ‘শোষণ’ অভিধা দিয়ে থাকেন। আর কে না জানে, শোষণ এবং শৃঙ্খল নামান্তর মাত্র। প্রশাসন যথারীতি এ ব্যাপারে পুলিশের পাশে দাঁড়িয়েছিল। আমেরিকার ‘সাদালোক’রা বরাবর যা করে, শ্বেতাঙ্গ কর্তারাও তাই-ই করলেন। তাঁরা গলা উঁচিয়ে বুক বাজিয়ে বললেন, ‘যত দোষ ওই কালো লোকটার’! তাঁদের অভিযোগ অবশ্য ধোপে টিকল না। আপামর মার্কিন নাগরিক ওই ছবিটা দেখে প্রথমে চোখের জল ফেলল, তার পর রাগে ফেটে পড়ল। তারা রে রে করে তেড়ে গেল পুলিশ প্রশাসনের দিকে। ঘোর বিপদ বুঝে প্রশাসন শভিনকে গ্রেফতার করে তাঁর বিরুদ্ধে খুনের মামলা রুজু করল। বরখাস্ত করে দিল ওই ঘটনার ‘দর্শক’ তিন পুলিশ কর্তাকে। কিন্তু তাতেও আমজনতার ক্ষোভ বিক্ষোভ মিটল না। মেটার কথাও না। কারণ ফ্লয়েডের মৃত্যু একটা প্রতীকী ঘটনা মাত্র। আসলে কালোদের বিরুদ্ধে এই বর্ণবিদ্বেষ মার্কিন সাদাদের কাছে একটা ঐতিহাসিক অভ্যাস, বিশুদ্ধ বিনোদন, রাজারাজরাদের বিলাসী মৃগয়ার মতো!
আন্দোলনে কুকুর লেলিয়ে দিতে চাওয়া ট্রাম্পকে ঢুকতে হল বাঙ্কারে। ছবি: রয়টার্স।
আরও পড়ুন: খুনই করা হয়েছে জর্জ ফ্লয়েডকে, দাবি ময়নাতদন্তের রিপোর্টে
দেওয়ালে পিঠ ঠেকে যাওয়া মানুষ এ বার ঘুরে দাঁড়াল। সাধারণ মানুষ রাস্তায় নামল করোনা-উদ্ভূত ‘দৈহিক দূরত্ব’ উপেক্ষা করে। দাবানলের মতো মানুষের মিছিল ছড়িয়ে পড়ল রাজ্যে রাজ্যে। ‘ব্ল্যাক লাইফ ম্যাটারস’ স্লোগানে পোস্টারে ব্যানারে ফেস্টুনে ঝলসে উঠল মানুষের প্রতিবাদ। সব বয়সের, সব পেশার মানুষ, ছাত্রছাত্রী, যুবক যুবতী, সবাই সামিল হলেন এই হঠাৎ বিপ্লবে। আন্দোলন ছড়িয়ে পড়ল গ্রামগঞ্জ শহর নগর মফস্বল মাঠ ময়দান রাজপথ জনপদে। কালোদের পাশাপাশি মুক্তমনের কিছু সাদা মানুষও নেমে পড়লেন এই মনুষ্যত্বের আন্দোলনে। বিদ্রোহী জনতাকে ঠেকাতে প্রশাসন দমনপীড়নের কৌশল নিল। একের পর এক শহরে জারি হল কার্ফু। পুলিশ নির্বিচারে লাঠি, গুলি, জলকামান আর কাঁদানে গ্যাস চালাল। চলল ধরপাকড়। তাতে হিতে বিপরীত হল। জনতার রোষ এ বার হিংসাত্মক হয়ে উঠল। আমেরিকার উত্তর থেকে দক্ষিণে, পূর্ব থেকে পশ্চিমে চলল ভাঙচুর, অগ্নিসংযোগ, মারের বদলে পালটা মার। আন্দোলনের সমর্থক কিছু মানুষ অবশ্য এই সহিংস আন্দোলনের বিরোধিতা করেছেন। কিন্তু জনআন্দোলন একবার শুরু হলে তা নিয়ন্ত্রণে আনা মুশকিল। ধনুক থেকে একবার তির ছুটে গেলে তাকে আর ফেরানো যায় না। তাই আমেরিকা এখন ‘হিংসা উপত্যকা’!
নিউ ইয়র্কে এ বাবেই ছড়ায় বিক্ষোভের আগুন। ছবি: এপি।
এই জাতীয় অস্থিরতার সময়ে রাষ্ট্রপ্রধানের উচিত ‘শান্তির দূত’ হয়ে ওঠা। কিন্তু আমেরিকার প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প একটু অন্য ধরনের মানুষ। উনি জ্বলন্ত দেশের আগুনে ঘি ছড়িয়ে দিলেন। পাড়ার মাস্তানদের ভাষায় তিনি বললেন, ‘কুকুর লেলিয়ে দেব। ঠান্ডা করে দেব ওই সব আন্দোলনকে’! ঠান্ডা তো দূরের কথা, আরও উত্তপ্ত হয়ে উঠল মানুষের মিছিল। মনে পড়বেই পল পারোর সেই কবিতা, ‘কিং ক্যানিউট’! দ্বাদশ শতাব্দীর ঘটনা। ডেনমার্কের রাজা ক্যানিউট তাঁর সৈকতপ্রাসাদের বারান্দায় বসে পারিষদদের বললেন, ‘দেখবে আমার ক্ষমতা! আমি বললেই স্তব্ধ হবে সাগরের ঊর্মিমালা’! রাজা পারাবারকে বললেন, ‘থামো’। থামা তো দূরের কথা, শত গুণ বেশি বেগে ধেয়ে এসে সমুদ্রের ঢেউ আছড়ে পড়ল রাজপ্রাসাদে। রাজা তখন পারিষদদের বললেন, ‘তোমরা যতটা মনে করো, আমি ততটা ক্ষমতাবান নই’! কোথায় যেন মিল। ট্রাম্পের ‘ঠান্ডা করার’ হুকুম শুনে কালোদের মারমুখী মিছিল দ্বিগুণ উৎসাহে ঝাঁপিয়ে পড়ল ‘সাদাবাড়ি’-তে। নগরে আগুন লাগলে দেবালয়ও রক্ষা পায় না। ভয়ার্ত প্রেসিডেন্ট প্রমাদ গুনলেন, আশ্রয় নিলেন হোয়াইট হাউসের বাঙ্কারে। ঠিক যে ভাবে লাল ফৌজের তাড়া খেয়ে অ্যাডল্ফ হিটলার আত্মগোপন করেছিলেন রাইখ চ্যান্সেলারির বাঙ্কারে। এর পরে কী হয়েছিল, সেটা ইতিহাস সম্যক জানে। আর সবাই জানে, মানুষকে শিক্ষা দিতে মহাকালের নিয়মেই ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি ঘটে।
ডেনভারে প্রতিবাদ। ছবি: রয়টার্স।
ঠিক, কিন্তু এই দেশটা যে ‘হালের’ আমেরিকা। সে এখন ‘শিব ঠাকুরের আপন দেশ’। মানুষের এই চলতি আন্দোলন এক সময় থিতিয়ে যাবেই। বরং এই ঘটনার পর থেকে মার্কিন দেশে মানুষে মানুষে সন্দেহ বাড়বে। স্কুলকলেজ অফিস আদালত আর শপিংমলে সাদারা ভুরু কুঁচকে তাকাবে কালোদের দিকে, স্বভাবের দোষে, ‘জলের গতি যেমন সদা নিম্ন দিকে ধায়’। পাড়া পার্ক আর গির্জায় কালোরা রুষ্ট চোখে তাকাবে সাদাদের দিকে, আক্রোশের অভ্যাসে, ‘আগুনেরই স্বভাব যেমন সব কিছু পোড়ায়’! সংখ্যাগুরুরা সুযোগ পেলেই সংখ্যালঘুদের ঘাড় মটকে দেবে। জাতীয় পতাকা হাতে জাতীয় সঙ্গীত গাওয়ার সময় এক মার্কিন নাগরিক পাশের সহনাগরিকের দিকে আড় চোখে তাকিয়ে তার গায়ের রংটা দেখে নেবে। বোঝার চেষ্টা করবে, তার কথাবার্তায় ‘অ্যাক্সেন্ট’ আছে কিনা। এই বিশ্বাসহীনতার ফিতে কেটে দিয়েছেন আমেরিকার ‘একটু অন্যরকম’ রাষ্ট্রপ্রধান স্বয়ং। তিনি প্রতিবেশী দেশের লাগোয়া সীমান্তে প্রাচীর তুলে দিতে চাইছেন। তিনি পেশাদার অভিবাসীদের আমেরিকা থেকে তাড়িয়ে দিতে চাইছেন। তিনি একটা বিশেষ দেশের পড়ুয়াদের আমেরিকায় ঢোকা বন্ধ করে দিতে চাইছেন। এ ভাবেই লিঙ্কন আর লুথারের নির্মিত সমতার মানচিত্র থেকে দিনান্তের আলোর মতোই হারিয়ে যাচ্ছে ‘বহুজাতিক’ আমেরিকা। কয়েকটা বছর আগে দেখা আমাদের সেই বহুত্ববাদের আমেরিকা দ্রুত, খুব দ্রুত বদলে যাচ্ছে।
এই ‘নতুন’ আমেরিকাকে আমরা চিনি না। আমরা শ্বাস নিতে পারছি না।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy