বয়স তার দশের গণ্ডি ছুঁয়েছে! এই বয়সেই সে লড়ছে কঠিন জীবনযুদ্ধ। চোখ বুজলেই ভেসে ওঠে বছরখানেক আগের এক ভয়াবহ স্মৃতি। বোমা বিস্ফোরণে উড়ে যায় তার বাড়ি। আকস্মিক হামলায় তার জীবন পুরো পাল্টে দিয়েছে। গাজ়া থেকে তার এখন ঠাঁই হয়েছে কাতারের দোহায়। সেখানকার একটি স্কুলেই তার জীবন কাটছে। সেই বিস্ফোরণে সে হারিয়েছে তার দু’টো হাতই! এক বছর ধরে স্বাভাবিক জীবনের সঙ্গে খাপ খাইয়ে নেওয়ার আপ্রাণ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে মাহমুদ আজজুর। এখনও সেই ঘটনা বার বার দুঃস্বপ্নের মতো ফিরে আসে। প্রশ্ন, ‘‘এ ভাবে বাঁচব কী করে?’’ তবে মাহমুদ বুঝে গিয়েছে বাস্তবটা।
২০২৪ সালে গাজ়ার পুরাতন শহরে মাহমুদের বাড়ি উড়ে গিয়েছিল ইজ়রায়েলি বোমা হামলায়। সেই হামলায় প্রণে বেঁচে যায় মাহমুদ। তবে গুরুতর আহত হয়। হারাতে হয় দুই হাত। সংবাদমাধ্যম ‘আল জাজ়িরা’র সঙ্গে কথা বলার সময় মাহমুদ বলেন, ‘‘প্রথমে আমি বুঝতে পারিনি কী হয়েছে। বেভেছিলাম শুধু পড়ে গিয়েছি। দেখলাম রাস্তায় পড়ে আছি। ওঠার ক্ষমতা নেই। ক্লান্ত ছিলাম।’’ পর মুহূর্তে জ্ঞান হারায় মাহমুদ। যখন জ্ঞান ফেরে তখন সারা শরীরে অসহ্য যন্ত্রণা। দেখতে পায়, দুই হাতই নেই। তার মধ্যে একটা আবার পড়ে ছিল অদূরেই!
নিজের হাত শরীর থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পাশের রাস্তা পড়ে থাকতে দেখেও মাহমুদ বিশ্বাস করতে পারেনি, তার সঙ্গে কী ঘটেছে। পরে তার মা তাকে জানায়, বিস্ফোরণে সে দুই হাতই খুইয়েছে। ‘ওয়ার্ল্ড প্রেস ফটো ২০২৫’ সালের সেরা ছবিগুলোর তালিকায় জায়গা করে নিয়েছে অসহায় মাহমুদের ছবি।
মাহমুদের কথায়, ‘‘মা যখন আমায় জানায়, অঝোরে কেঁদেছিলাম। মানসিক ভাবে ভেঙে পড়েছিলাম।’’ চিকিৎসাপর্বও তার খুব একটা সুখকর ছিল না। গাজ়ায় তখন সর্বত্র হাহাকার। হাসপাতালগুলিতেও প্রায় অর্ধেক চিকিৎসার সরঞ্জাম ছিল না। সেই অবস্থাতেই মাহমুদের অস্ত্রোপচার হয়। মাহমুদের কথায়, ‘‘অস্ত্রোপচারের সময় অজ্ঞান করার মতো ওষুধ ছিল না। আমাকে সজ্ঞানেই অস্ত্রোপচার করেছিলেন চিকিৎসকেরা। সেই যন্ত্রণা সহ্য করার মতো ক্ষমতা ছিল না আমার। চিৎকার করে শুধু কাঁদছিলাম।’’ এক বছর আগেই সেই স্মৃতির কথা বলতে গিয়ে এখনও গলা কেঁপে উঠছে মাহমুদের।
মাহমুদ একা নয়, তার মতোই গাজ়ার হাজার হাজার শিশুর জীবন পাল্টে দিয়েছে ইজ়রায়েলি হামলা। রাষ্ট্রপুঞ্জের তথ্য অনুযায়ী, ২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর থেকে চলমান যুদ্ধে প্রতি দিন অন্তত ১০ জন শিশু আহত হয়েছে। কারও হাত উড়েছে, কেউ আবার পা খুইয়েছে।
মাহমুদকে এখন নতুন করে সব কিছু শিখতে হচ্ছে। আগে যে কাজ দু’হাতের সাহায্যে অনায়াসেই সেরে ফেলতে পারত, এখন তা করতেই হিমশিম খেতে হয়। বেশির ভাগ দৈনন্দিন কাজ করতে বিশেষ সহয়তার প্রয়োজন পড়ে। মাহমুদের কথায়, ‘‘হামলার আগে আমি রোজ বাজারে যেতাম। প্রয়োজনীয় সব জিনিস কিনে আনতাম। এখন সবকিছু করাই কঠিন। কিন্তু যথাসাধ্য চেষ্টা করছি।’’ মাহমুদ এখন ভবিষ্যতের স্বপ্ন দেখে। সে আশাবাদী, এক দিন যুদ্ধ থেমে যাবে। আবার সে গাজ়ায় ফিরে যেতে পারবে। তার কথায়, ‘‘গাজ়ায় মানুষ মারা যাচ্ছে। আমার বাড়িতেও বোমা হামলা হয়েছে। এ ভাবে কী করে বেঁচে থাকতে পারি?’’
প্রসঙ্গত, ২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর হামাসের হামলার পরেই গাজ়ায় হানা দিয়েছিল ইজ়রায়েলি সেনা। প্রথমে বন্দুকের নলের সামনে রেখে উত্তর গাজ়া ফাঁকা করানো হয়। এর পরে স্থল অভিযান চলে মধ্য ভূখণ্ডেও। ঘরবাড়ি, হাসপাতাল, ধূলিসাৎ করে দেয়। সেই থেকে টানা যুদ্ধ চলছে। মাহমুদের মতো অনেকেই চাইছেন, ‘‘যুদ্ধ থামুক, শান্তি ফিরুক!’’