বৃহস্পতিবার ভোরে ইউক্রেনের উপর আক্রমণ চালাল রাশিয়া।
কলকাতার মানুষ সকালে উঠে শুনল রাশিয়া ইউক্রেন আক্রমণ করেছে। তবে মস্কোয় বসে যুদ্ধের গন্ধটা আমি বেশ কিছু দিন আগে থেকেই পাচ্ছিলাম। আগে বলতে, বিশ্ব জুড়ে এই রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ-যুদ্ধ ভাবটা তৈরি হওয়ার অনেকটা আগে থেকেই।
মস্কোয় আমি ৩২ বছর রয়েছি। উচ্চশিক্ষার জন্য এসেছিলাম। তার পর রয়ে গিয়েছি। একটা চিনা নেটওয়ার্ক কোম্পানিতে কর্মরত, যেখানে আমার বেশিরভাগ সহকর্মীরাই রুশ নাগরিক। থাকি মস্কোর অস্তান্টকিনো এলাকায়। রাষ্ট্রীয় টেলিভিশন টাওয়ারের কাছে। এটা মস্কোর উত্তর-পূর্ব অংশে। প্রতি দিন গাড়ি চালিয়ে অফিস যেতে মিনিট চল্লিশেক লাগে। সেটা মস্কো শহরের পূর্বাংশে। বৃহস্পতিবারও যেতে যেতে যে দৃশ্য চোখে পড়েছে, তাতে কোনও অস্বাভাবিকতা এখনও দেখছি না। কথাও নয়।
আমার রুশ সহকর্মীদের সঙ্গে এ নিয়ে অনেক আলোচনা হয়েছে। ওঁদের কথায়, এমনটা তো হওয়ারই ছিল। নেটো ঘাড়ে নিঃশ্বাস ফেলবে এটা রাশিয়ানরা কখনওই মেনে নেবেন না। এ বার ইউক্রেন যদি নেটোয় ঢুকে পড়ে, তা হলে ওরা রাশিয়ার ঘরের কাছে বিভিন্ন ওয়ারহেডস বসিয়ে দেবে। সেটা রুশ অস্মিতায় সহ্য করা বেশ চাপের। পুতিন কেন, অন্য কোনও শাসকও হলেও সেটা হতে দিতেন বলে মনে হয় না। কিন্তু সেই চেষ্টা শুরু হয়েছিল বেশ আগে থেকেই।
যদি ঐতিহাসিক দৃষ্টিকোণ থেকে দেখা যায়, তবে বলতে হয় ওই এলাকার অভ্যন্তরীণ সাম্যটা টাল খেতে শুরু করে বছর আষ্টেক আগে। ইউক্রেনে তখন প্রেসিডেন্ট ইয়ানুকোভিচ ক্ষমতায়। সেই সময় থেকে প্রচুর আমেরিকার বিনিয়োগ আসতে থাকে। যা হয়, সরকারি কাজকর্মেও প্রভাব বিস্তার শুরু হয়। পশ্চিমের পছন্দ ছিল না ইয়ানুকোভিচকে। নির্বাচিত শাসক হয়েও তাঁকে ক্ষমতাচ্যুত হতে হয়েছিল।
আর একটা ব্যাপার হল, ওই ডনবাস এলাকার ৯০ শতাংশ মানুষই রাশিয়াপন্থী। এতে কোনও ভুল নেই। মিনস্ক সম্মেলনে ইউক্রেন কথা দিয়েছিল ওই দুই জায়গা লুগানস্ক এবং ডনেটস্ক-কে আরও বেশি স্বায়ত্ত শাসন দেবে, সুযোগ সুবিধা দেবে। সে সব কিছুই করেনি ইউক্রেন। তাই এদের মুক্তির জন্য রাশিয়া এগিয়ে এসেছে। পরিস্থিতিটা অনেকটা বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধে ভারতের ভূমিকার মতো। সে কারণেই এখন অনেকে ইন্দিরা গাঁধীর সঙ্গে তুলনা টানছেন অনেকে।
যুদ্ধের প্রত্যক্ষ প্রভাব যদি বলেন, সেট ইতিমধ্যেই পড়তে শুরু করেছে। শেয়ারবাজারে ধস নেমেছে। ডলারের বিনিময় মূল্য এক দিনে ৭৯ রুবল থেকে নেমে ৮৬ হয়ে গিয়েছে। ইউক্রেন সীমান্ত লাগোয়া ১৮টা বিমানবন্দর বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। এখানে খাবারদাবারের অনেক অংশ ইউরোপের বিভিন্ন দেশ থেকে আসে। আমার ধারণা, যুদ্ধ স্থায়ী হলে সে সবে টান পড়তে পারে। তখন হয়ত দেখব মানুষ নুডলস, ডিম, মাংস এ সব বাড়তি মজুতের দিকে হাঁটবেন। যেমন করোনার সময় দেখেছি, বিভিন্ন মলে রাতারাতি র্যাক ফাঁকা হয়ে গিয়েছিল।
তবে উল্টোটাও ভাববার। রুশ জ্বালানি তেল এবং গ্যাসের দাম বেশ সস্তা। ইউরোপের দেশগুলোকে যদি যুদ্ধের কারণে আমেরিকার থেকে চারগুণ বেশি দাম দিয়ে সে সব কিনতে হয়, তবে তারাও এই যুদ্ধ চালানোর ব্যাপারে খুব উৎসাহ ইউক্রেনকে দেবে না। আমি যুদ্ধবিশারদ নই। তবে সাধারণ বুদ্ধিতে মনে হয় এটা খুব বেশি দিন চলবে না।
এখানে আমার রুশ বন্ধুবান্ধব আছে অনেক। এদের সঙ্গে মেলামেশা, সামাজিক উৎসব অনুষ্ঠানে অংশ নেওয়া— সব মিলিয়ে অনেকটাই জানি। তাই বলে রাখা ভাল, রাশিয়ার একটা নিজস্ব বাস্তবতা আছে। আর সেটা পশ্চিমের গণমাধ্যম যে ভাবে রাশিয়াকে দেখায় তার থেকে অনেকটাই আলাদা।
সেই সুবাদেই বলতে পারি, যুদ্ধ নিয়ে দেশটার আমজনতার মধ্যে যে দারুণ উন্মাদনা শুরু হয়েছে, তেমনটাও বলা যাবে না। কেন জানেন, এদের ডিএনএ-তে যেটা ঢুকে গিয়েছে, সেটা হল সরকারের কাজে সমালোচনা না করা। ওদের মধ্যে ভাবটা হচ্ছে, সরকারের সামনে এটাই ছিল পথ। কাজেই যা হচ্ছে ভাল হচ্ছে।
শুনেছি চিনে এটা আরও মারাত্মক। ভুলেও কোনও বিক্ষোভ, বিরোধিতা দেখাতে যান না সাধারণ মানুষ। একদা কমিউনিস্ট শাসিত দেশগুলোর শরীরে সম্ভবত এমন কিছু চিহ্ন থেকে যায়। জানি না কিউবাতে ব্যাপারটা এ রকমই কি না। তবে কিউবার মতো রাশিয়াতও সাধারণ মানুষকে চিকিৎসা নিয়ে ভাবতে হয় না। সরকার পরিচালিত সেই ব্যবস্থা বেশ ভাল।
তা ছাড়া আরও একটা একটা বিষয় হল, রুশদের জীবনের একটা বছর সেনাবাহিনীতে কাটাতে হয়। তাঁরা ছাত্রজীবন আর কর্মজীবনের মাঝে কোনও এক সময় কঠোর সামরিক অনুশাসন, আর নিয়মনিষ্ঠ জীবন যাপন করেন। সেনাবাহিনীতে থাকার কারণে বিভিন্ন অস্ত্রশস্ত্র সম্পর্কেও সাধারণ রুশদের সম্যক ধারণা রয়েছে। আর রয়েছে দেশের প্রতি আনুগত্য। আমি যতটুকু এঁদের চিনেছি তাতে একটা কথা খুব স্পষ্ট। যুদ্ধকে এরা ভয় পায় না। ইতিহাসে অনেক যুদ্ধে লড়েছেন পূর্বপুরুষরা, না হয় আরও একটা সই। রাশিয়ার প্রকৃতিক সম্পদ আছে, তাই সে দিকে শত্রুদের নজর থাকবেই। আমাদেরই রক্ষা করতে হবে সে সব। নেটোর তপ্ত নিঃশ্বাস সহ্য করার প্রশ্ন নেই।
অনুলিখন: প্রসেনজিৎ সিংহ
(লেখক পেশায় ইঞ্জিনিয়ার। তিন দশকের বেশি সময় রাশিয়ায় রয়েছেন)
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy