এই পরিবর্তন কিন্তু বিশ্ব উষ্ণায়নের ফল। ছবি: এপি।
আমার জীবনের জলবায়ু-বিহারটা গরম থেকে ঠান্ডার দিকে। কলকাতা, হায়দরাবাদ, উত্তর ইউরোপ, টরন্টো হয়ে এখন সাস্কাটুনে। সাইবেরিয়া বাদ দিয়ে মানুষের বসবাস বিশ্বের যে সব হিমশীতল এলাকায়, তার মধ্যে আমাদের এই অঞ্চল (যার পোশাকি নাম কানাডিয়ান প্রেরি) শীতলতম। এখানে দীর্ঘ শীতকাল, স্বল্পায়ু গ্রীষ্মকাল আর ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র বসন্ত ও শরৎ। গ্রীষ্মের সর্বোচ্চ আর শীতকালের সর্বনিম্ন তাপমাত্রার পার্থক্য প্রায় ৭০-৭৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস। গরমে কয়েক দিন তাপমাত্রা ৩২/৩৩ ডিগ্রি সেলসিয়াসও হতে পারে। শীতকালে সাধারণ ভাবে তাপমাত্রা থাকে -২০ ডিগ্রি থেকে -২২ ডিগ্রি সেলসিয়াস। মাঝেমধ্যে -৪০ থেকে -৪৫ ডিগ্রি সেলসিয়াসেও নেমে যায়। আর বসন্তকালে বেশ বৃষ্টি হয়।
বছর দশেক আগে যখন এই শহরে এসেছিলাম, উড়োজাহাজ থেকে নীচের দিকে তাকিয়ে মনে হয়েছিল, জনমানবশূন্য বরফে মোড়া এক তেপান্তর। মাঝ-ফেব্রুয়ারির সেই দিন থেকে এত দিন কেটে গেল, আস্তে আস্তে এখানকার আবহাওয়া গা-সওয়া হয়ে গিয়েছে। এখন তো আপাদমস্তক মহাকাশচারীর মতো পোশাকে -৪০ ডিগ্রি সেলসিয়াসে বরফ আর ঠান্ডাকে কাঁচকলা দেখিয়ে দিব্যি ১০-১৫ মিনিট হেঁটে যেতে পারি। এখানে ইস্কুলে -২০ ডিগ্রি সেলসিয়াসে বাচ্চারা বরফের উপরে হুটোপাটি করে। ডিসেম্বরের ঠান্ডায় লোকে পাহাড়ে যায় স্কি করতে। কুকুর টানা স্লেজ গাড়িতে ১০ কিলোমিটার ঘুরে এসে আগুনের ধারে বসে হট চকলেট খায় লোকজন।
কিন্তু গত পাঁচ-সাত বছরে এই আবহাওয়ায় পরিবর্তন দেখা দিয়েছে। প্রথম প্রথম হয় তো ততটা খেয়াল করিনি, কিন্তু এখন বেশ বুঝতে পারি। শীতকালে এখানে পোলার ভর্টেক্সের জন্য মাঝেমধ্যে মাইনাস ৪০ থেকে মাইনাস ৪৫ ডিগ্রি সেলসিয়াসে তাপমাত্রা নেমে যায়। সেটা নতুন কিছু না। নতুন হল এই পোলার ভর্টেক্স-এর ক্রমশ দক্ষিণে চলে আসা। এমনিতে প্রতি শীতে এক বা দু’সপ্তাহ মাইনাস ৪০ ডিগ্রি সেলসিয়াসের নীচে তাপমাত্রা নেমে যায়। কিন্তু গত বছর সেটা প্রায় ছিল জানুয়ারির মাঝামাঝি থেকে মার্চ মাসের প্রথম সপ্তাহ পর্যন্ত। তুষার ঝড়ও হয়েছে অন্যান্য বারের থেকে অনেক বেশি। কোনও কোনও দিন তাপমাত্রা মাইনাস ৫০ ডিগ্রি সেলসিয়াসের নীচে নেমে গিয়েছিল। হাসপাতালে হাইপোথার্মিয়া আক্রান্ত গৃহহীন মানুষের সংখ্যা উল্লেখযোগ্য ভাবে বেড়ে গিয়েছে। আপিস-কাছারি-কলকারখানায় উপস্থিতি কমেছে অনেক, যা এখানে প্রায় অভাবনীয়।
এই পরিবর্তন কিন্তু বিশ্ব উষ্ণায়নের ফল। অনেকেই বলবেন, ঠান্ডার তীব্রতার সাথে উষ্ণায়নের কী সম্পর্ক? উলট-পুরাণ নাকি? যেমন বলেছিলেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। ঠান্ডার তীব্রতা থেকে বাঁচতে টুইট করে গ্লোবাল ওয়ার্মিং-কে স্বাগত জানিয়েছিলেন তিনি!
বিশ্ব উষ্ণায়নের ফলে এই এলাকায় বসন্তে বর্ষার পরিমাপ কমছে ধীরে ধীরে। বাড়ছে শুষ্ক গরম। কানাডা দিগন্ত বিস্তৃত পাহাড় ও বনভূমির দেশ। শহর ছেড়ে বেরোলেই মাইলের পর মাইল বার্চ, পাইন, রেড ওক
আর মেপেল গাছের বন। বৃষ্টি কমে যাওয়ার ফলে গত তিন-চার বছরে দাবানলের সংখ্যা প্রচুর বেড়ে গিয়েছে। বেড়েছে প্রায় অবিচ্ছিন্ন হারে।
এই দাবানলের ক্ষয়ক্ষতির একটা উদাহরণ দিই। আলবার্টা কানাডার একটি রাজ্য। আলবার্টার উত্তরে একটি জনপদ ‘ফোর্ট ম্যাকমারি’। ৬৭ হাজার মানুষের বাস। ২০১৬ সালের বিধ্বংসী দাবানলে এই ‘ফোর্ট ম্যাকমারি’র আশেপাশে ৫ লক্ষ ৯০ হাজার হেক্টর বনভূমি সম্পূর্ণ পুড়ে গিয়েছিল।
প্রায় ৩২৫০ বাড়ি ভস্মীভূত হয়ে যায়, যার বেশির ভাগই ছিল বসত বাড়ি। ক্ষতি হয়েছিল প্রায় এক হাজার কোটি ডলার। গৃহহীন হয়েছিলেন প্রায় ৩০ হাজার মানুষ। সে বার প্রায় টানা দু’মাস বৃষ্টি হয়নি।
আমার বাড়ির পাশেই থাকেন এক শ্বেতাঙ্গ দম্পতি। বয়স ষাটের কোঠায়। গ্রীষ্মে বাড়ির বাগানে নাতি-নাতনিদের জন্য অস্থায়ী সুইমিং পুল বসান। সে দিন তাপমাত্রা প্রায় ৩৫ ডিগ্রি। যেই না প্রতিবেশী ভদ্রলোককে বলেছি— ‘‘উফ্, আজকে খুব গরম’’ আমাকে চোখ পাকিয়ে বললেন ‘‘এই গরম অতি উত্তম, উপভোগ করো ভায়া, উপভোগ করো।’’
তাঁর কথায় প্রতিবেশী দেশের রাষ্ট্রনেতার কথারই প্রতিধ্বনি শুনতে পেলাম যেন!
লেখক তথ্যপ্রযুক্তি কর্মী
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy