বিবিসি-কে ঘিরে বিতর্ক আরও দানা বেঁধেছে। ছবি: সংগৃহীত।
গত কাল সন্ধেটা কেটেছে চূড়ান্ত অব্যবস্থায়। আর আজ সকাল থেকে বিবিসি-র অন্দরেই দাবি উঠল, ইস্তফা দিন সংস্থার চেয়ারম্যান রিচার্ড শার্প ও ডিরেক্টর জেনারেল টিম ডেভি। দিনভর সংস্থার কর্মীরা অভ্যন্তরীণ মেসেজিং অ্যাপ ‘স্ল্যাক’-এর মাধ্যমে পরস্পরকে অসংখ্য বার্তা পাঠিয়েছেন, যেগুলির বক্তব্য একটাই— গ্যারি লিনেকারকে অনুষ্ঠান না-করতে দেওয়ার সিদ্ধান্ত ভুল ছিল। সংস্থার ‘মূল্যবোধ’ নিয়েও প্রশ্ন তুলেছেন অনেক কর্মী। সেই সব মেসেজের বেশ কয়েকটি সামাজিক মাধ্যমে ফাঁস হয়ে যাওয়ার পরে ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যমটি ঘিরে বিতর্ক আরও দানা বেঁধেছে।
বিতর্কের শুরু প্রাক্তন ব্রিটিশ ফুটবলার তথা বিবিসির একটি জনপ্রিয় শোয়ের উপস্থাপক গ্যারি লিনেকারের টুইট থেকে। সম্প্রতি নতুন শরণার্থী নীতি ঘোষণা করে একটি বিল পাশ হয়েছে ব্রিটেনে। সেই বিলের পক্ষে সওয়াল করে দিন কয়েক আগে একটি ভিডিয়ো টুইট করেছিলেন ব্রিটেনের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সুয়েলা ব্রেভারম্যান। লিখেছিলেন, ‘যথেষ্ট হয়েছে, আর না। এ রকম কোনও নৌকা করে এ দেশে অনুপ্রবেশের চেষ্টা করলেই ফেরত পাঠিয়ে দেওয়া হবে। নারী-শিশু নির্বিশেষে।’ সুয়েলার সেই ভিডিয়ো রি-টুইট করে গত ৭ মার্চ প্রাক্তন ফুটবলার লিনেকার টুইটারে লিখেছিলেন— ‘হে ঈশ্বর! এর থেকে ভয়াবহ আর কী হতে পারে!’ এ-টুকু বলেই লিনেকার থামেননি। টুইট করেছিলেন, ‘এমন নয় যে আমাদের দেশে বিপুল সংখ্যক শরণার্থী এসে উপস্থিত হন। ইউরোপের বড় দেশগুলি যে সংখ্যক শরণার্থীকে আশ্রয় দেয়, তার তুলনায় আমাদের দেশে আশ্রয় পাওয়া শরণার্থীর সংখ্যা অত্যন্ত নগণ্য। অত্যন্ত দুর্দশাগ্রস্ত মানুষগুলির জন্য এ ধরনের নির্মম ও কঠোর শব্দের ব্যবহার আমাকে ’৩০ দশকের জার্মানির কথা মনে পড়িয়ে দিচ্ছে।’
প্রাক্তন ফুটবলারের সেই টুইটের পরের দিন এক বিবৃতি জারি করে বিবিসি জানায়, ‘লিনেকার সম্প্রতি সামাজিক মাধ্যমে যে মন্তব্য করেছেন, তা বিবিসি-র নির্দেশিকার বিরোধী। বিবিসি মনে করে, লিনেকারের কোনও রাজনৈতিক বিষয়ে এ ভাবে পক্ষ নেওয়া উচিত হয়নি। সামাজিক মাধ্যমে তাঁর মতামত তুলে ধরার বিষয়ে সংস্থা যত দিন তাঁর সঙ্গে সহমত না হচ্ছে, তত দিন ‘ম্যাচ অব দ্য ডে’ অনুষ্ঠানে তাঁর উপস্থাপনা বন্ধ থাকছে।’
লিনেকারকে এ ভাবে ‘সরিয়ে দেওয়ার’ জন্য ব্রিটিশ ফুটবল মহলে নিন্দার ঝড় ওঠে। শনিবার সন্ধেবেলা সম্প্রচারিত হয় লিনেকারের এই ‘ম্যাচ অব দ্য ডে অনুষ্ঠান’। বিবিসি-র জনপ্রিয়তম অনুষ্ঠানের অন্যতম এই অনুষ্ঠান। লিনেকারকে সরিয়ে দেওয়ার খবর পেয়ে অনুষ্ঠানে অংশ নিতে অস্বীকার করেন তাঁর দুই সহ-উপস্থাপক— অ্যালান শিয়ারার এবং ইয়ান রাইট। ফাঁপরে পড়ে যান বিবিসি কর্তৃপক্ষ। যোগাযোগ করা হয় আর এক নামজাদা উপস্থাপক মার্ক চ্যাপম্যানের সঙ্গে। কিন্তু তিনিও জানিয়ে দেন, লিনেকারের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে এই অনুষ্ঠানে অংশ নেবেন না। আরও বেশ কিছু ফুটবলারের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তাঁরাও এই প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেন। শেষ পর্যন্ত কাটছাঁট করে, কোনও উপস্থাপনা ছাড়াই ২০ মিনিটে শেষ করে দেওয়া হয় ‘ম্যাচ অব দ্য ডে’ অনুষ্ঠান।
এখানেই সমস্যার শেষ নয়। শনিবার বিকেল থেকে বিবিসি-র খেলা বিষয়ক বেশ কিছু অনুষ্ঠানের উপস্থাপকেরা লিনেকারকে সমর্থন করে তাঁদের নিজেদের অনুষ্ঠান করতে অস্বীকার করেন। যার ফলে সেই সব খেলার অনুষ্ঠানের বদলে অন্যান্য অনুষ্ঠান দিয়ে সময় পূরণ করতে হয় বিবিসি কর্তৃপক্ষকে। বিবিসির এই ‘কড়া মনোভাব’-এর জন্য ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যমটির সমালোচনা করেছেন কেন্দ্রীয় মন্ত্রী অনুরাগ ঠাকুর। ২০০২ সালের গুজরাত দাঙ্গায় রাজ্যের তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর ‘ভূমিকা’ নিয়ে তথ্যচিত্র সম্প্রচার করে বিতর্ক উস্কে দিয়েছিল বিবিসি। ভারতে সেই তথ্যচিত্রের সম্প্রচার নিষিদ্ধ হলেও বিবিসি নিজেদের অবস্থানে অনড় থেকে জানিয়েছিল, তারা ‘নিরপেক্ষ সাংবাদিকতা’র পক্ষে। লিনেকার-বিতর্কে তার কী হল, প্রশ্ন তুলেছেন অনুরাগ। তাঁর টুইট, ‘খুব আশ্চর্য লাগছে এটা দেখে যে, বিবিসি নিরপেক্ষ এবং স্বাধীন সাংবাদিকতার কথা বলে। কিন্তু তারাই এ বার এক তারকা উপাস্থাপককে তাঁর টুইটের জন্য ছাঁটাই করল!’
লিনেকার এই অনুষ্ঠানের জন্য বছরে আড়াই লক্ষ পাউন্ড মাইনে পান। কিন্তু তিনি বিবিসির ‘ফ্রিলান্স’ কর্মী। ফলে, তাঁর জন্য সংস্থার সব নিয়মনীতি প্রযোজ্য কি না, সেই প্রশ্ন তুলছেন অনেকে। লিনেকার এর আগেও ব্রিটেনের শরণার্থী নীতির সমালোচনা করেছেন। ২০১৬তে তিনি নিজের বাড়িতে কয়েক জন শরণার্থীকে আশ্রয়ও দিয়েছিলেন।
লিনেকারের মন্তব্যের কড়া সমালোচনা করেছেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ব্রেভারম্যান। তিনি বলেন, ‘‘আমাদের শরণার্থী নীতির সঙ্গে নাৎসি জার্মানির কী ভাবে তুলনা করা যায়! আমার স্বামী ইহুদি। তাঁদের মতো বহু পরিবারের সঙ্গে কী হয়েছিল, আমরা জানি।’’
শরণার্থী বিলের পক্ষে সওয়াল করেছেন খোদ প্রধানমন্ত্রী ঋষি সুনকও। দিন দু’য়েক আগে ব্রিটিশ পার্লামেন্টে তিনি জানিয়েছিলেন, বেআইনি ভাবে নৌকা করে যাঁরা এ দেশে ঢোকার চেষ্টা করবেন, তাঁদের ব্রিটেনে ঠাঁই হবে না। হয় তাঁদের নিজেদের দেশে ফেরত পাঠানো হবে, না হলে পুনর্বাসিত করা হবে রোয়ান্ডার মতো কোনও দেশে, যাদের সঙ্গে ব্রিটেনের বিশেষ শরণার্থী চুক্তি রয়েছে। সাধারণত, ফ্রান্সের উপকূল থেকে ইংলিশ চ্যানেল পার হয়ে শরণার্থীরা ব্রিটেনে পৌঁছনোর চেষ্টা করেন। তাঁদের আটকাতে সম্প্রতি ফ্রান্সকে অর্থসাহায্যও ঘোষণা করেছে ব্রিটেন, ব্রিটেনের আনুকূল্যে উপকূলে বিশেষ বাহিনী মোতায়েন করবে ফ্রান্স। তবে লিনেকার-বিতর্কে কোনও পক্ষ নেননি ভারতীয় বংশোদ্ভূত প্রধানমন্ত্রী সুনক। শুধু বলেছেন, ‘‘সরকার নয়, এটি সংবাদমাধ্যম সংস্থাটির অভ্যন্তরীণ বিষয়। আশা করি বিতর্ক তাড়াতাড়ি মিটে যাবে ও লিনেকার ফের উপস্থাপনায় ফিরে আসবেন।’’
পদত্যাগের দাবি উঠলেও বিবিসি-র চেয়ারম্যান রিচার্ড শার্প ও ডিরেক্টর জেনারেল টিম ডেভি জানিয়ে দিয়েছেন, ইস্তফা দেওয়ার কোনও প্রশ্ন নেই। এই প্রসঙ্গে উঠে আসছে রিচার্ডের সঙ্গে কনজ়ারভেটিভ দলের ঘনিষ্ঠ সম্পর্কের প্রসঙ্গও। প্রাক্তন ব্যাঙ্কার রিচার্ড প্রধানমন্ত্রী সুনকের প্রাক্তন বস। কনজ়ারভেটিভ দলের অন্যতম ‘দাতা’ তিনি ও প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসনকে ৮ লক্ষ পাউন্ড অনুদান পেতে সাহায্য করেছিলেন। রিচার্ডের স্পষ্ট রাজনৈতিক মতাদর্শই সংস্থাটির ‘নিরপেক্ষতায়’ দাগ ফেলছে, মনে করছেন অনেকে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy