রোদে-পোড়া প্যারিসে ফোয়ারার জলেই স্নান। এএফপি
তখন আমার বয়স বছর চারেক। মনে পড়ে শান্তিনিকেতনে আমাদের নিচুবাংলার বাড়িতে বৈশাখের প্রচণ্ড গরমে মায়ের পাশে রাতে শুয়েছি, মা তালপাতার পাখায় হাওয়া করছেন, তার মৃদু ছন্দেও ঘুম আসছে না। মা বললেন, ‘‘একটু বাদেই ঠান্ডা হয়ে যাবে...।’’ সেই বিশ্বাস নিয়ে নিজের অজান্তে ঘুমিয়ে পড়তাম। তখন সকলের দেওয়ালপাখা ছিল না। একটা টেবিলপাখাই সম্বল। তার সামনে দুপুরে ঠান্ডা মেঝেতে সবাই একসঙ্গে ঘুমের মজাটা দারুণ ছিল। ব্রিটিশ আমলের ওই পাখাটার জন্য ক’দিন আগে ভারী মন কেমন করল।
বর্তমানে আছি ফরাসি দেশে। এ দেশের সব কিছুই আমার বন্ধুদের কাছে বেশ রোমাঞ্চজনক। ছবির দেশ, সাহিত্যের ও বইয়ের দেশ, ভাল নাটক ও সিনেমার দেশ, ব্যক্তিস্বাধীনতার দেশ, রাজনৈতিক সংগ্রামের ও রাস্তায় নেমে মিছিল করার দেশ, দারুণ সব মদের দেশ, কাফেতে বসে আড্ডার দেশ, সুগন্ধ ও সুন্দর পোশাকআশাকের দেশ ইত্যাদি তকমায় এ দেশ সুশোভিত।
এই জুলাই মাসের প্রথম থেকেই বেশ গরম, তার মধ্যেই রোলঁ গারোসের আন্তর্জাতিক টেনিস খেলায় দর্শকের ভিড়, বাসভর্তি মুঠোফোনে ছবিতোলা চিনে ও জাপানি পর্যটকের বিরাট দল, রাস্তায় ভিক্ষে করা সিরিয়া ও আফ্রিকা থেকে আসা উদ্বাস্তু পরিবার, প্রতি শনিবারে ‘হলুদ জামা’ পরা আন্দোলনকারী ছাত্রছাত্রী, কর্মী ও অবসরপ্রাপ্তদের স্লোগান দেওয়া ও মিছিল চলছিল স্বাভাবিক ভাবেই। এর মধ্যে হঠাৎ করে একটা ‘আকাশ তৃষায়’ কাঁপানো গরম নেমে সবাইকে জানিয়ে দিল যে প্রকৃতিদেবী-ই সব কিছুর ওপরে। দেশের কিছু বন্ধু অবশ্য এই গরমের কথা শুনে ‘ন্যাকামো’, ‘আদিখ্যেতা’ ভেবেছেন, কেউ কেউ সহানুভূতিশীল, কেউ বলেছেন তিব্বতে চলে যেতে!
দেশের সরকার কিছু প্রয়োজনীয় তথ্য ছবি-সহ মেট্রো ও বাসের গায়ে, প্রতি বাড়ির সামনের দেওয়ালে, সিনেমা হলের সামনে ও সিনেমা শুরু হওয়ার আগে, খাবারের দোকানের সামনে, স্কুল-কলেজে, বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রচার করে যাচ্ছেন। টেলিভিশনের পর্দায় তা দেখানো হচ্ছে অনুষ্ঠানের মধ্যে। কিছু সজ্জন নগরাধিকারিক আমার মতো বৃদ্ধদের নিরখরচায় একটা জলভরা পিস্তল উপহার দিলেন, যেটা ব্যবহার করলে পাঁচ মিনিট চশমা ঝাপসা হয়ে কিছুই দেখা যায় না, তবে তাঁর সেই গানের মতো ‘হঠাৎ আসা ক্ষণে ক্ষণে’ জলের ঠান্ডা বাষ্পে একটু চাঙ্গা লাগে।
সরকার একটি তালিকা দিয়েছেন। তাতে যা যা উপদেশ দেওয়া হয়েছে, তার মধ্যে রয়েছে— রোজ স্নান করা। ফরাসি দেশে মাত্র বছর ৫০ হল প্রায় সব বাসস্থানে স্নানের ঘর আছে। সরকারি তালিকা পরামর্শ দিচ্ছে ওই জলের পিস্তল ব্যবহার করার, দিনের বেলা দরজা-জানলা বন্ধ রাখার, নিয়মিত খাওয়াদাওয়া করার, উত্তেজক পানীয় গ্রহণ না করার, (মদের ব্যবসায়ীদের মাথায় হাত আর কী), খুব বেশি কায়িক পরিশ্রম না করার। যদিও শুনতে পাচ্ছি, পাশের বাড়িতে বিদেশ থেকে নিয়ে আসা শ্রমিকদের বাড়ি সারানোর ঘটঘট আওয়াজ। তালিকা আরও জানাচ্ছে, নিজের কুশলসংবাদ দেওয়া ও পরিবার-বন্ধুদের খবর নিয়মিত নেওয়া এবং সর্বোপরি বার বার জল খাওয়া অবশ্য কর্তব্য। তাই হয়তো আমাদের ছোট মেয়ে, যিনি কিছুটা ডুমুরের ফুল, প্রায়ই ফোন করছেন।
সব মিলিয়ে গরমের জন্য হঠাৎ যেন সারা দেশ নড়েচড়ে বসল। বর্তমান রাজনৈতিক ও সামাজিক অসমঝোতার যুগে একটা আপৎকালীন অবস্থা সবাইকে এক ছাতার তলায় নিয়ে এল! প্রকৃতিকে হয়তো এই জন্যই আমরা দেবী বলি। বড় শহর,ছোট শহর, প্রত্যন্ত গ্রাম আর বিশেষ করে ঈফেল টাওয়ারের সামনে চত্বরে এক হাঁটু জলে আবালবৃদ্ধবনিতার দাপাদাপি করা দেখে মনে হল, বাহ্! বেশ একটা ছুটির আমেজ যেন....।
তবে সরকারের এই সজাগ হওয়ার আরও কারণ আছে। সেটা কাল বলব।
লেখক শিল্পী ও শিক্ষক
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy