ভূমিকম্প কেড়েছে প্রাণ। কম্বলে জড়ানো শিশুর মৃতদেহ নিয়ে অশ্রুসজল পরিজন। বৃহস্পতিবার তুরস্কের আডিয়ামান প্রদেশে। রয়টার্স
এখনও মাঝেমধ্যেই কেঁপে উঠছে জমি। আধভাঙা বাড়িগুলো হুড়মুড় করে ধসে পড়ছে মাটিতে। চারদিকে ধ্বংসের ছবি আর ধুলোর মেঘ জমে। পাতালের অন্ধকার থেকে এক-এক করে টেনে বার করা হচ্ছে দেহগুলো। ভারতের বিপর্যয় মোকাবিলা বাহিনী আজ একটি ছ’বছরের শিশুকে জীবিত উদ্ধার করেছে। চার দিন পার করে তুরস্ক ও সিরিয়ায় মৃতের সংখ্যা ২০ হাজার ছাড়িয়েছে। বিশেষজ্ঞদের আশঙ্কা, এই সংখ্যা আরও অনেক বাড়বে। বিপর্যয়ের ভয়াবহতা মনে করিয়ে দিচ্ছে ৮৪ বছর আগের কথা। ১৯৩৯ সালে তুরস্কে এক ভূমিকম্পে ৩৩ হাজার মানুষ মারা গিয়েছিলেন।
তুরস্ক-সিরিয়া সীমান্ত বিশ্বের সবচেয়ে সক্রিয় ভূমিকম্পপ্রবণ অঞ্চল বলে পরিচিত। অতীতেও ভয়াল ভূমিকম্পের সাক্ষী হয়েছে এই অঞ্চল। তুরস্কের সাধারণ মানুষের ক্ষোভ, এ সব জানা সত্ত্বেও সরকার কোনও সতর্কতামূলক ব্যবস্থা নেয়নি। সাম্প্রতিক কালে নিম্নমানের জিনিস দিয়ে তৈরি করা হয়েছে একের পর এক বাড়ি। ১৯৯৯ সালের ভূমিকম্পে ১৭ হাজার মানুষের মৃত্যুর পরে বাড়িনির্মাণ সংক্রান্ত কড়া নিরাপত্তাবিধি জারি করা হয়েছিল। যেমন, ভূমিকম্পপ্রবণ এলাকায় বাড়ি তৈরি করতে হলে উচ্চমানের কংক্রিট ও ইস্পাত ব্যবহার করতে হবে। বাড়ির ভিতের স্তম্ভগুলির অবস্থান এমন হবে, যাতে ভূমিকম্পের ঝাঁকুনি সহ্য করতে পারে। কিন্তু কোনও নিয়মই মানা হয়নি গত এক দশকে। সরকারি-বিধিকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে বেআইনি বাড়ি নির্মাণ চলেছে অবাধে।
মালাটিয়া শহরে সদ্য তৈরি হওয়া একটি বাড়ি ভেঙে পড়েছে। ইসকেনদেরুন, আন্টাকিয়া শহরেও গত কয়েক বছরে তৈরি হওয়া বাড়িগুলি ধূলিসাৎ হয়ে গিয়েছে সোমবারের ভূমিকম্পে। ইউনিভার্সিটি কলেজ লন্ডন-এর বিশেষজ্ঞ ডেভিড আলেক্সান্ডার জানিয়েছেন, সোমবারের ভূমিকম্পের তীব্রতা খুবই বেশি ছিল। কিন্তু বাড়িগুলি যদি সব নিয়ম মেনে তৈরি করা হত, তা হলে হয়তো এই পরিমাণ ক্ষতি হত না। ইস্তানবুলের ইঞ্জিনিয়ার ও স্থপতিদের একটি সংগঠনের তরফে জানানো হয়েছে, দক্ষিণ তুরস্কে ৭৫ হাজার বাড়ি বেআইনি ভাবে তৈরি করা হয়েছিল। যাদের পরবর্তী কালে ছাড় দিয়ে দেওয়া হয়েছিল সরকারের পক্ষ থেকে। সম্প্রতি আইন আরও লঘু করার কথাও ভাবা হচ্ছিল। হয়তো ভোটের কথা মাথায় রেখেই।
তিন মাস পরেই তুরস্কে সাধারণ নির্বাচন। এর মধ্যে মানুষের ক্ষোভের মুখে রীতিমতো বেকায়দায় রিচেপ তায়িপ এর্ডোয়ানের সরকার। বাসিন্দাদের দাবি, উদ্ধারকাজ চলছে, কিন্তু খুবই ধীরে গতিতে। অব্যবস্থা চতুর্দিকে। যাঁরা বেঁচে আছেন, তাঁরাও চরম অসহায় অবস্থায় রয়েছেন। প্রবল ঠান্ডায় মাথার উপর ছাদ নেই, যথেষ্ট গরম পোশাক নেই, চিকিৎসার ব্যবস্থা নেই। আর এই নৈরাজ্য দেখার জন্য প্রশাসনের কোনও কর্তাব্যক্তিও উপস্থিত নেই। গাড়ির মধ্যে রাত কাটাচ্ছেন অনেকে। অস্থায়ী শিবির খোলা হয়েছে বেশ কিছু জায়গায়। কিন্তু সেখানে সারা রাত বসে কাটানোর থেকে বহু বাবা-মা ছেলেমেয়েকে কম্বলে জড়িয়ে রাস্তায় হাঁটছেন। তাতে বরং গা গরম থাকছে। আডিয়ামান প্রদেশের বাসিন্দা রেসাত গোজ়লু জানিয়েছেন, তাঁর এলাকায় তিন দিনেও কোনও উদ্ধারকারী দল পৌঁছয়নি। একটি স্পোর্টস স্টেডিয়ামে পরিবার নিয়ে আশ্রয় নিয়েছেন তিনি। রেসাতের অভিযোগ, কিছু মানুষ ধ্বংসস্তূপের নীচে মারা যাবে, আর বাকিরা ঠান্ডায় হাইপোথার্মিয়া হয়ে। একটি ব্রিটিশ সংবাদ সংস্থাকে রেসাত বলেন, ‘‘কোনও মতে বেঁচে রয়েছি। শৌচকর্ম করার জায়গাটুকু পর্যন্ত নেই। এ ভাবে চললে কঠিন রোগ ছড়াবে।’’ বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (হু)-ও জানিয়েছে, যাঁরা ভূমিকম্প থেকে বেঁচে গিয়েছেন, তাঁদের দ্রুত উদ্ধার করা না হলে, তাঁরাও এ বার খাবার, পানীয় জলের অভাব ও প্রবল ঠান্ডায় প্রাণ হারাবেন। হু-র কথায়, যে কোনও ‘পারিপার্শ্বিক বিপর্যয়’ ঘটে যেতে পারে।
আজ সোশ্যাল মিডিয়ায় সরকারের বিরুদ্ধে ‘প্ররোচনামূলক’ পোস্ট করার জন্য ১৮ জনকে গ্রেফতার করা হয়েছে তুরস্কে। সমালোচনার ঝড় থেকে বাঁচতে গত কাল সাময়িক ভাবে টুইটার পরিষেবা বন্ধ করে দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু তাতেও রক্ষা মেলেনি। এলাকা গোপন রেখে ভিপিএন-এর সাহায্যে টুইটার ব্যবহার করেছেন অনেকেই। সরকারকে বিঁধতেও ছাড়েননি তাঁরা।
কাজে খামতি যে রয়েছে, তা স্বীকার করেছেন প্রেসিডেন্টও। প্রবল ঠান্ডায় উদ্ধারকাজে বিঘ্ন ঘটছে। কিছু জায়গায় তুষারপাত হচ্ছে। এক এক জায়গায় বরফবৃষ্টি। গাজ়িয়ানটেপে তাপমাত্রা আজ মাইনাস ৫ ডিগ্রি সেলসিয়াসে নেমে গিয়েছে। এ অবস্থায় ধ্বংসস্তূপের নীচে প্রাণের আশাও কমছে। ভারতীয় বিপর্যয় মোকাবিলা বাহিনী (এনডিআরএফ) আজ গাজ়িয়ানটেপে ধ্বংসস্তূপ থেকে একটি ছ’বছরের শিশুকে জীবিত উদ্ধার করেছে। ‘#অপারেশনদোস্ত’ লিখে টুইটারে সেই খবর পোস্ট করেছে ভারতের বিদেশ মন্ত্রক। তবে বিশেষজ্ঞেরা জানাচ্ছেন, ৭২ ঘণ্টা কেটে গিয়েছে, এর পরে আর কারও বেঁচে থাকার আশা ক্ষীণ। এ দিন এর্ডোয়ান হতাশা প্রকাশ করে বলেন, ‘‘আমি জানি, উদ্ধারকাজে অনেক খামতি রয়েছে। কিন্তু পরিস্থিতি তো দেখাই যাচ্ছে। এ রকম বিপর্যয়ের জন্য তৈরি থাকা অসম্ভব!’’
যে সব দেহ উদ্ধার হয়েছে, তাঁদের চিহ্নিত করাও এক বিপুল কাজ। আন্টাকিয়ার একটি হাসপাতালের পার্কিং লটে দেহ নিয়ে যাওয়ার ব্যাগ রাখা হয়েছে। আত্মীয়-পরিজনদের বলা হয়েছে, দেহ খুঁজে পেলে নিয়ে যেতে। রানিয়া জ়াবৌবি নামে এক তরুণী বলেন, ‘‘কাকিমাকে খুঁজে পেয়েছি। কিন্তু কাকুকে পাচ্ছি না।’’ সিরিয়া থেকে শরণার্থী হয়ে আসা রানিয়া এ দেশে এসেও সব হারালেন। তার পরিবারের আট জন মারা গিয়েছেন ভূমিকম্পে।
ভ্যানে করে কবরস্থানগুলোতে একের পর এক মৃতদেহ আসছে। শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত কন্টেনারগুলোকে মোবাইল মর্গ করা হয়েছে। নতুন কফিন তৈরি করতে হয়েছে অনেক। কিছু কফিন তৈরি করা হয়েছে পাইন গাছ কেটে, কিছু দেখেই বোঝা যাচ্ছে পুরনো আলমারি। তাতেই একসঙ্গে ঠাঁই হচ্ছে অনেকের। গণকবর দেওয়া ছাড়া উপায় নেই। ওসমানিয়েতে গত কাল ৪০০ কবর দেওয়া হয়েছে। তবে এই সংখ্যা তো কিছুই নয়।
তুরস্কের চেয়ে মৃত্যু কম হলেও সিরিয়ার পরিস্থিতি আরও জটিল। তিন দিন পরে আজ প্রথম রাষ্ট্রপুঞ্জের ত্রাণসাহায্য পৌঁছল এ দেশে। রাষ্ট্রপুঞ্জের মহাসচিব আন্তোনিয়ো গুতেরেস বলেছেন, ‘‘আরও সাহায্য চাই ওঁদের। মানুষের কথা কিন্তু আগে মাথায় রাখতে হবে।’’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy