Advertisement
২২ নভেম্বর ২০২৪
Vaccine

নিরাপদ, প্রথম ধাপে ‘পাশ’ অক্সফোর্ড-টিকা

অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের এই ‘মাস্টারস্ট্রোক’ এখন ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালের চূড়ান্ত পর্যায়ে রয়েছে।

করোনার ভ্যাকসিন পরীক্ষার জন্য অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে চলছে রক্তের নমুনা সংগ্রহের কাজ। ছবি: এপি

করোনার ভ্যাকসিন পরীক্ষার জন্য অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে চলছে রক্তের নমুনা সংগ্রহের কাজ। ছবি: এপি

শ্রাবণী বসু
লন্ডন শেষ আপডেট: ২১ জুলাই ২০২০ ০৩:০৬
Share: Save:

নিরাপদ তো বটেই, প্রত্যাশামতো মানবশরীরের রোগ-প্রতিরোধ ক্ষমতাকে (ইমিউনিটি) যথাযথ দিশাও দেখাচ্ছে অক্সফোর্ডের ‘ক্যান্ডিডেট’। পার্শ্ব প্রতিক্রিয়াও প্রায় নেই! প্রায় ২৪ ঘণ্টার রুদ্ধশ্বাস অপেক্ষার পরে অবশেষে করোনার সম্ভাব্য ভ্যাকসিন নিয়ে এমনই স্বস্তির রিপোর্ট দিল ব্রিটিশ মেডিক্যাল জার্নাল ‘দ্য ল্যানসেট’। তবে কবে এই ভ্যাকসিন বাজারে আসছে, তার সদুত্তর পাওয়া গেল না। এ বছর কিংবা আগামী বছরের গোড়ায় আদৌ মিলবে তো প্রতিষেধক? রিপোর্ট প্রকাশের আগেই খোদ ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসন বললেন— ‘‘কথা দিতে পারছি না!’’

গবেষণার গোড়ায় নাম ছিল, ‘চ্যাডস্ক ১’। এখন— ‘এজ়েডডি ১২২২’। অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের এই ‘মাস্টারস্ট্রোক’ এখন ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালের চূড়ান্ত পর্যায়ে রয়েছে। প্রায় হাজার জনের উপরে চালানো তাঁদের প্রথম পর্যায়ের পরীক্ষার রিপোর্ট পেশ করতে গিয়ে আজ বিশ্ববিদ্যালয়ের ভ্যাকসিন গ্রুপের প্রধান অ্যান্ড্রু পোলার্ড বললেন, ‘‘বলতে পারেন, প্রথম বাধা টপকে গিয়েছি। যেমন ভাবা হয়েছিল, ভ্যাকসিন প্রয়োগের পরে তেমনই রোগ-প্রতিরোধ ক্ষমতা তৈরির প্রমাণ পেয়েছি আমরা।’’

তবে সম্ভাব্য এই ভ্যাকসিনটিকে চূড়ান্ত ‘ফিট সার্টিফিকেট’ দেওয়ার আরও যে বড় মাত্রায় ক্লিনিক্যাল পরীক্ষা ও তার রিপোর্টের জন্য অপেক্ষা করতে হবে, তা-ও জানালেন তিনি। বিশ্ববিদ্যালয় সূত্রের খবর, এখনও পর্যন্ত শুধু ব্রিটেনেই ন’হাজার জনের উপর এই ভ্যাকসিনের পরীক্ষামূলক প্রয়োগ হয়েছে। করোনা-হটস্পট ব্রাজিলেও প্রায় পাঁচ হাজার জনকে এর ডোজ় দেওয়া হয়েছে। গবেষকেরা বলছেন, সাফল্য যে মিলবেই, সে ব্যাপারে তাঁরা ৮০ শতাংশ নিশ্চিত।

রিপোর্ট ‘পজ়িটিভ’

প্রতিষেধক: ‘এজ়েডডি১২২২’ (গোড়ায় ছিল ‘চ্যাডক্স-১’) ভ্যাকসিন

গবেষণায়: জানুয়ারি থেকে আসরে অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘জেনার ইনস্টিটিউট’ ও ‘অক্সফোর্ড ভ্যাকসিন গ্রুপ’। নেতৃত্বে ইবোলা-টিকার জন্মদাত্রী
সারা গিলবার্ট

মানবশরীরে পরীক্ষা শুরু: ২৩ এপ্রিল, ২০২০। একই সঙ্গে চালু প্রথম ও দ্বিতীয় পর্যায়ের পরীক্ষা

পরীক্ষাধীন স্বেচ্ছাসেবী: তিন মহাদেশের এখনই অন্তত ১০ হাজার। পরবর্তী লক্ষ্যমাত্রা আরও ৪৫ হাজার

প্রস্তুতকারক সংস্থা: বরাত অ্যাস্ট্রোজ়েনেকা-কে। যৌথ উদ্যোগে ১০০ কোটি ডোজ় তৈরি করবে ভারতের সেরাম ইনস্টিটিউটও (ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল শুরু অগস্টে)

গোত্র-ঠিকুজি

আদতে ‘অ্যাডিনোভাইরাস ভেক্টর ভ্যাকসিন’। তৈরি হয়েছে একটি ভাইরাস (চ্যাডক্স১) থেকে। যা অ্যাডিনোভাইরাসকে জিনগত ভাবে বদলে, দুর্বল করে, তৈরি করা হয়েছে। অ্যাডিনোভাইরাসের হানায় শিম্পাঞ্জিদের সাধারণ সর্দি-জ্বর হয়ে থাকে। দুর্বল ভাইরাসটি মানুষের শরীরে ঢুকে সংখ্যায় বাড়তে পারে না। এদের অল্প উপস্থিতিতেই দেহে অ্যান্টিবডি তৈরি হয়, যা পাল্টা জবাব দেয় নোভেল করোনাভাইরাসকে। চ্যাডক্স১-এর জেনেটিক মেটেরিয়ালে রাখা হয়েছে করোনাভাইরাসের স্পাইক গ্লাইকোপ্রোটিনটিকেও।

তুরুপের তাস ‘টি-সেল’

অক্সফোর্ড জানিয়েছে, তাদের সম্ভাব্য টিকায় ‘টি সেল’ তৈরি হচ্ছে। ‘মেমরি চিপের’ মতো হানাদার ভাইরাসকে চিনে রাখে এই কোষ। অ্যান্টিবডির আয়ু ফুরোলেও ফের হামলা হলে ভরসা দেবে টি সেল।

প্রথম বাধা টপকে গিয়েছি। যেমন ভাবা হয়েছিল, ভ্যাকসিন প্রয়োগের পরে তেমনই রোগ-প্রতিরোধ ক্ষমতা তৈরির প্রমাণ পেয়েছি আমরা।

অ্যান্ড্রু পোলার্ড, অক্সফোর্ড ভ্যাকসিন গ্রুপের প্রধান

‘আগামিকাল। প্রতিষেধক। মনে হয়...।’ গতকাল এই কয়েকটা শব্দের টুইটেই বিশ্বের চিকিৎসক মহলে শোরগোল ফেলে দিয়েছিলেন মেডিক্যাল জার্নাল ‘দ্য ল্যানসেট’-এর প্রধান সম্পাদক রিচার্ড হর্টন।

অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের তৈরি সম্ভাব্য করোনা-প্রতিষেধকের ‘ক্লিনিক্যাল রিপোর্ট’ যে আজ, সোমবার তাঁদের পত্রিকায় বেরোচ্ছে, সে খবর আগেই চাউর হয়ে গিয়েছিল। কাল সম্পাদকের টুইটেও তেমনটাই ইঙ্গিত মিলেছিল। কিন্তু আজ বিকেল-সন্ধে গড়িয়ে গেলেও অক্সফোর্ড কিংবা ল্যানসেট— কারও তরফেই কোনও প্রতিক্রিয়া মেলেনি। মাঝখানে আবার জনসনের দেওয়া ওই ‘অশনি সঙ্কেত’! তা-হলে প্রতিষেধক কি অধরাই? প্রশ্নটা যখন সবে উঠতে শুরু করেছে, ঠিক তখনই, ভারতীয় সময় সন্ধে ৭টা নাগাদ, এল স্বস্তি। জানা গেল— রিপোর্ট আসছে।

আরও পড়ুন: ‘ভ্যাকসিনোলজিস্ট’ হবেন, ভাবেননি সারা

আরও পড়ুন: দেশীয় টিকা বাজারে আসতে ২০২০-পার

বাজারে আসার আগেই ভ্যাকসিনের চাহিদা তুঙ্গে। বেরোলেই হয়তো শুরু হবে হাহাকার। সেই আশঙ্কা থেকেই একটি জার্মান ও একটি ফরাসি সংস্থার সঙ্গে চুক্তি করে নিজেদের ব্যবহারের জন্য ন’কোটি ডোজ় আজ নিশ্চিত করে ফেলল ব্রিটেন। সঙ্গে ‘ঘরোয়া জোগান’ অক্সফোর্ড ও লন্ডনের ইম্পিরিয়াল কলেজের ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালে থাকা জোড়া ভ্যাকসিন রইলই!

অনেকেই বলছেন, অক্সফোর্ডের রিপোর্ট যে ‘ভাল’, তার আগাম খবর ছিলই বরিস-প্রশাসনের কাছে। কী ভাবে কাজ করছে এই ভ্যাকসিন, আজ তা-ও প্রকাশ করেছে ল্যানসেট। তাতে বলা হয়েছে, ভ্যাকসিনের ডোজ় প্রত্যাশামতোই অ্যান্টিবডি এবং টি-সেল তৈরি করছে শরীরে। হালের কিছু গবেষণা বলছে, অ্যান্টিবডির আয়ু মোটামুটি মাস তিনেক। কিন্তু ঘাতক কোষ ‘টি-সেল’ বহু বছর শরীরে থেকে লড়াই চালিয়ে যেতে পারে। অ্যান্টিবডির কাজ হল, ভাইরাস সংক্রমণ হলে তার বিরুদ্ধে লড়াই করা। আর টি-সেল অনেকটা ‘মেমরি চিপের’ মতো। ভাইরাসের সমস্ত বৈশিষ্ট নিজের শরীরে ধরে রাখে। অর্থাৎ, ভবিষ্যতে ফের কোনও কোষ ওই ভাইরাস-আক্রান্ত হলেই টি-সেল সক্রিয় হয় এবং সেই মতো খবর পাঠায় ইমিউন সিস্টেমকে। তার পরেই পুরনো চেনা শত্রুর বিরুদ্ধে শুরু করে হামলা।

অক্সফোর্ডের ভ্যাকসিন এই টি-সেলেই বাজিমাত করবে বলে মনে করছেন বিজ্ঞানীরা। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (হু)-র দাবি, এই মুহূর্তে প্রায় ১৫০টি ভ্যাকসিনের কাজ চলছে দেশে-দেশে। প্রায় দু’ডজন রয়েছে ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালের পর্যায়ে। কিন্তু অক্সফোর্ডের গবেষকেরা ছাড়া আর কেউ টি-সেল তৈরি হচ্ছে বলে দাবি করেননি। হু-র জরুরি স্বাস্থ্য বিষয়ক প্রধান মাইকেল রায়ান ল্যানসেটে রিপোর্ট প্রকাশিত হওয়ার পরে বলেন, ‘‘দারুণ খবর। এ বার আরও বড় করে বিশ্ব জুড়ে পরীক্ষায় নামতে হবে অক্সফোর্ডকে।’’ ল্যানসেটের সম্পাদক রিচার্ডও অক্সফোর্ডের বিজ্ঞানীদের অভিনন্দন জানিয়ে লিখেছেন, ‘‘এই টিকা নিরাপদ, সহনশীল এবং ইমিউনিটি বাড়াতে সক্ষম।’’

গবেষক পোলার্ডও তাঁদের গবেষণাপত্রে লিখেছেন, ‘‘আমরা আশা করছি, এর প্রয়োগে যে প্রতিরোধ ক্ষমতা তৈরি হচ্ছে, তা দীর্ঘদিন ওই ভাইরাসটিকে মনে রাখবে। এবং সেই মতো সুরক্ষা দেবে মানুষকে।’’ প্রথম পর্যায়ের পরীক্ষায় দেখা গিয়েছে, ভ্যাকসিন প্রয়োগের ১৪ দিনেক মাথায় শীর্ষে পৌঁছচ্ছে টি-সেলের মাত্রা। আর অ্যান্টিবডি ২৮ দিনে। প্রতিরোধ ক্ষমতা অন্তত মাস দু’য়েক তো থাকছেই। সর্বোচ্চ সীমা কত, তা নিশ্চিত করতে সময় লাগবে। ভ্যাকসিন প্রোগ্রামের প্রধান অ্যান্ড্রু পোলার্ড জানালেন, তাঁদের পরীক্ষাধীন ৯০ শতাংশ মানুষের শরীরে অ্যান্টিবডি তৈরি হয়েছে একটি ডোজ়েই। বাকিদের দ্বিতীয় ডোজ় দিতে হয়েছে।

পোলার্ড জানালেন, এই ভ্যাকসিন নিরাপদ। আর পার্শ্ব-প্রতিক্রিয়া? ল্যানসেটের রিপোর্ট বলছে, পরীক্ষাধীন ৭০ শতাংশের সামান্য মাথাব্যথা বা অল্প জ্বর ছাড়া উল্লেখ করার মতো কোনও প্রতিক্রিয়া হয়নি।

এ বার? অক্সফোর্ডের গবেষকেরা জানিয়েছেন, শুধু ব্রিটেনেই আরও ১০ হাজার জনের উপরে এই টিকা-পরীক্ষা হবে। ব্রিটেনের বাইরে দক্ষিণ আফ্রিকায় দু’হাজার ও আমেরিকায় ৩০ হাজার জনের উপর চলবে এর পরীক্ষামূলক প্রয়োগ।

তার পর হবে ‘চ্যালেঞ্জ ট্রায়াল।’ টিকা নিয়ে স্বেচ্ছাসেবীরা সরাসরি আক্রান্তদের সংস্পর্শে আসবেন। অক্সফোর্ড বলছে, বুক চিতিয়ে লড়তে তৈরি তারা। সময় লাগুক, তবু সম্পূর্ণ নিরাপদ এবং যথাযথ প্রতিষেধকই আনতে চাইছেন ইবোলা-টিকার জন্মদাত্রী সারা গিলবার্টের টিম।

অন্য বিষয়গুলি:

Vaccine COVID 19 AZD 1222 Oxford University
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy