Advertisement
২৩ ডিসেম্বর ২০২৪
Coronavirus

স্পেনে গৃহবন্দি, রাস্তায় বার হলেই জরিমানা করছে পুলিশ

গতকাল থেকে কেউ যদি রাস্তায় বেরনোর সঠিক কারণ না দেখতে পারে, পুলিশ তাকে ১০০ থেকে ৬০ হাজার ইউরো পর্যন্ত জরিমানা করতে পারে।

সুনসান স্পেনের রাস্তা। নিজস্ব চিত্র।

সুনসান স্পেনের রাস্তা। নিজস্ব চিত্র।

অনীক নন্দী
সান্টিয়াগো (স্পেন) শেষ আপডেট: ২০ মার্চ ২০২০ ২০:২০
Share: Save:

বছরের শুরুতেই যখন করোনাভাইরাসের নামটা সবে শোনা গেল, তখনই আমি রয়্যাল গালিসিয়ান একাডেমি অফ ল্যাঙ্গুয়েজের (পশ্চিমবঙ্গ বাংলা একাডেমির মতো) তরফ থেকে একটি প্রকল্পে ডাক পেলাম। সেই সূত্রে আবার স্পেনের সান্টিয়াগো ফেরা। চেনা শহর আর চেনা মানুষজন। একজন প্রবাসীর কাছে এর কোনো বিকল্প হয় না। তাই ফিরতে কোনও দ্বিধা করিনি। বিদেশে আমি একাই। আমার বাবা আর মা, দুজনেই থাকেন বর্ধমানে। স্কাইপে আর হোয়াটসঅ্যাপ এর মাধ্যমে প্রতিদিনই যোগাযোগ রাখি তাঁদের সঙ্গে। গালিসিয়ার মানুষজন খুবই খোলা মনের। আর কোনও বিদেশি যদি তাদের ভাষা ও সংস্কৃতি নিয়ে বিশেষ উৎসাহ দেখান তবে তো কথাই নেই। বন্ধু হতে দেরি হয় না। তবে স্পেনের এই উত্তর-পশ্চিম কোণে ভারতীয়দের সংখ্যা প্রায় হাতে গোনা। জানুয়ারি মাসের শেষের দিকে ফিরে এসে পুরনোদের সঙ্গে যোগাযোগ করে জানলাম প্রায় সকলেই গত বছরে দেশে ফেরত গিয়েছেন। যাঁদের আসার কথা তাঁরাও এখন করোনাভাইরাস অতিমারীর কথা ভেবে আসা সাময়িক ভাবে স্থগিত রেখেছেন, বা পুরোপুরি ভাবে বাতিল করে দিয়েছেন। ১১ মার্চ মাদ্রিদের ভারতীয় দূতাবাসের তরফ থেকে এক বিজ্ঞপ্তিতে জানতে পারলাম দেশে ফেরা সংক্রান্ত বিভিন্ন তথ্য। তখনও বুঝিনি যে বিষয়টা এতটা দূর পর্যন্ত গড়াতে পারে।

স্পেনের প্রথম করোনাভাইরাস সংক্রমণ ধরা পড়ে ৩১ জানুয়ারি। এক জার্মান পর্যটকের শরীরে। ২৬ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত আক্রান্তের সংখ্যাটা গোটা স্পেনে ১৫ ছাড়িয়ে যায়নি। এর পরেই ২৭ ফেব্রুয়ারি থেকে সংখ্যাটা লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়তে থাকে। আগামী দুই সপ্তাহের মধ্যে আক্রান্তের সংখ্যাটা বেড়ে পাঁচ হাজার ছাড়াল। সংক্রমণের উপকেন্দ্র এখনও মাদ্রিদ (আক্রান্তের সংখ্যা প্রায় সাত হাজার)। যদিও স্পেনের অন্যান্য অঞ্চলেও এই ভাইরাসের প্রকোপ চোখে পড়ার মতো। এই সব দেখে ১৪ মার্চ স্পেনের প্রেসিডেন্ট, পেদ্রো সানচেথ পেরেজ-কাস্তেখন তড়িঘড়ি স্বাস্থ্য সংক্রান্ত জরুরি অবস্থা ঘোষণা করলেন। গত সোমবার থেকে স্পেনের সরকার সমস্ত বেসরকারি হাসপাতালকে অধিগ্রহণ করেছেন যাতে আক্রান্তদের চিকিৎসার জন্য ব্যবহার করা যায়। এই সব সিদ্ধান্তের প্রধান কারণ স্পেনের স্বাস্থ্য ব্যবস্থাকে যেন কোনওভাবেই ভেঙে পড়তে না দেওয়া।

গত সপ্তাহেই জানা গিয়েছিল, প্রেসিডেন্টের স্ত্রীও করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে এখন কোয়রান্টিনে। একই অবস্থা স্পেনের বহু মন্ত্রী ও সাংসদদের। গোটা স্পেনই এখন কার্যত গৃহবন্দি। সরকার বাড়ি থেকেই কাজ করতে অনুরোধ করেছে। সরকারের তরফ থেকে এটাও বারেবারে জানানো হচ্ছে, দেশের এই কঠিন সময়ে মানুষ যেন স্বাস্থ্যব্যবস্থার উপর আস্থা না হারান। আর সকলে যতটা সম্ভব বাড়িতে থাকুন। খুব প্রয়োজন ছাড়া বাড়ির বাইরে বেরনো নিষেধ। সেই থেকেই গোটা স্পেন জুড়ে এখন দোকানপাট বন্ধ। একমাত্র সুপারমার্কেট আর ওষুধের দোকান ছাড়া কিছুই খোলা রাখা যাবে না। পুলিশ ও মিলিটারি বিভিন্ন এলাকায় টহল দিচ্ছে। প্রথম দু’দিন অনেকে বিষয়টাকে একটু অগ্রাহ্য করলেও, পরে সরকার আরও কড়া পদক্ষেপ করতে বাধ্য হয়। গতকাল থেকে কেউ যদি রাস্তায় বেরনোর সঠিক কারণ না দেখতে পারে, পুলিশ তাকে ১০০ থেকে ৬০ হাজার ইউরো পর্যন্ত জরিমানা করতে পারে। আজকের খবর অনুযায়ী, আক্রান্তের সংখ্যা গোটা স্পেনে প্রায় ২০ হাজার, আর মারা গেছেন এক হাজার জনের বেশি। তবে ভাল খবর হল, প্রায় ১ হাজার ৫৮৫ জন লোক সুস্থ হয়ে ঘরে ফিরে গিয়েছেন।

গালিসিয়াতে চিত্রটা খুব একটা আলাদা নয়। রাস্তায় লোকজন নেই। এখানকার প্রাদেশিক সরকার, কেন্দ্রের সঙ্গে যোগাযোগ রেখে একই রকম পদক্ষেপ করেছে। সব রকম শিক্ষা প্রতিষ্ঠানও বন্ধ আছে গত সপ্তাহ থেকে। এই শুক্রবার সান্টিয়াগো বিশ্ববিদ্যালয়ের গালিসিয়ান ভাষা বিভাগে আমার একটা ওয়ার্কশপ করানোর কথা ছিল। সংশ্লিষ্ট বিষয়ের অধ্যাপক যোগাযোগ করে জানিয়েছেন, সেটা এপ্রিল মাসের শেষ পর্যন্ত পিছিয়ে দেওয়া হচ্ছে। তাছাড়া এপ্রিল মাসে এখানে ভোট হওয়ার কথা ছিল। সেইসবও এখন অনির্দিষ্ট কালের জন্য পিছিয়ে দেওয়া হয়েছে। যদিও গালিসিয়াতে করোনা আক্রান্তের সংখ্যাটা স্পেনের অন্যান্য এলাকার থেকে এখনও বেশ কম। আজকের হিসাবে গোটা রাজ্যে আক্রান্তের সংখ্যা এখন ৫৭৮। তার মধ্যে ১৫ জন হাসপাতাল থেকে ছাড়া পেয়েছেন। গত দু’সপ্তাহে মারা গিয়েছেন ছ’জন। তাঁদের আগে থেকেই বিভিন্ন শারীরিক সমস্যা ছিল।

ইটালিতে কোয়রান্টিন শুরু হওয়ার পর পরই একটা আভাস পাওয়া যাচ্ছিল যে এমনটা হতে পারে ইউরোপের অন্যান্য দেশেও। গত সপ্তাহের শুরুর দিকেই বড় সুপারমার্কেটগুলিতে প্রবেশ করলেই একটা সাজ সাজ ভাব টের পাওয়া যাচ্ছিল। সপ্তাহের মাঝামাঝি দেখা গেল অনেক নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিস যেমন টয়লেট পেপার, স্যানিটারি জেল, মাস্ক, টিনজাত খাবার ইত্যাদি আর নেই। যদিও সরকার থেকে বার বার অনুরোধ করা হচ্ছিল আতঙ্কিত না হতে। আমি এক সপ্তাহের বাজার একবারে করি। এবারে একটু বেশি করেই করে রাখলাম। ফ্রিজার পুরোপুরি ভর্তি করে খানিকটা মানসিক শান্তি।

আরও পড়ুন: মৃত্যুতে চিনকে ছাড়াল ইটালি, ১০ মিনিটে ১ জন মৃত ইরানে

যদিও বাড়িতে আমার বাবা মা বেশ চিন্তায় আছেন। দেশে ফেরার কথাও ভেবেছিলাম। এখন বর্ধমানে ফিরতে গেলে আমাকে প্রথমে সান্টিয়াগো থেকে মাদ্রিদ যেতে হবে। সেখান থেকে দিল্লী বা দুবাই হয়ে কলকাতা। এই অবস্থায় ভ্রমণ করা বিপজ্জনক হতে পারে। তাই আমি এখনই দেশে ফেরার কথা ভাবিনি। ভারতীয় দূতাবাসের ওয়েবসাইটে চোখ রেখে চলেছি। জরুরি অবস্থার কথা মাথায় রেখে আমাদের দূতাবাস বেশ কিছু ফোন নম্বর দিয়ে রেখেছেন। খুব প্রয়োজনে সেখানে যোগাযোগ করার কথা ভেবে রেখেছি।

আমার জন্ম আর বড় হয়ে ওঠা দুটোই বর্ধমান শহরে। বর্ধমান বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইংরেজিতে স্নাতকোত্তর করে আমি স্প্যানিশ ভাষার চর্চা শুরু করি। আমি প্রথম বার স্পেনের আসার সুযোগ পাই ২০০৭-এর শেষের দিকে। সেই থেকেই আমার সঙ্গে স্পেন ও গালিসিয়ার (উত্তর-পশ্চিম স্পেনের একটি স্বশাসিত অঞ্চল) সঙ্গে আমার আত্মিক যোগ। ২০০৮-এ আমি সান্টিয়াগো দে কম্পোস্টেলা বিশ্ববিদ্যালয়ে আমি গালিসিয়ান ভাষা ও সংস্কৃতি সংক্রান্ত বিষয়ে আরো পড়াশোনার জন্য স্প্যানিশ মিনিস্ট্রি অফ এক্সটার্নাল অ্যাফেয়ার্স এর তরফ থেকে একটি বৃত্তি পাই। স্কটল্যান্ড (এডিনবরা) থেকে ডক্টরেট ও উত্তর আয়ারল্যান্ড (বেলফাস্ট) থেকে পোস্টডক্টরেট করলেও আমার গবেষণার বিষয় বরাবরই ছিল স্পেন কেন্দ্রিক। তাই কর্মসূত্রে ব্রিটেন বা ইউরোপের বিভিন্ন দেশে ঘুরেলেও, সান্টিয়াগো দে কম্পোস্টেলা শহর, বিশ্ববিদ্যালয় ও গালিসিয়া রাজ্যের সঙ্গে আমার নিয়মিত যোগাযোগ।

আরও পড়ুন: স্পেনে গৃহবন্দি হয়ে আছি, আর এক ইটালি হয়ে উঠতে পারে যে কোনও মুহূর্তে

কোয়রান্টিন শুরু হওয়ার পরে ‘বিবিধের মাঝে মিলনের’ একটা দারুন ছবি পাওয়া গেল গোটা স্পেন জুড়ে। ভারতের মতোই স্পেনও বহু ভাষা ও সংস্কৃতির দেশ। করোনাভাইরাস সবাইকে যেন একজোট করে দিল। এই কঠিন সময়ে স্বাস্থ্যকর্মীরা যেমন দিনরাত জেগে কাজ করছেন, একই অবস্থা যাঁরা সুপারমার্কেট বা ওষুধের দোকান খুলে রেখেছেন। এদের সকলকে ধন্যবাদ ও সাহসিকতাকে কুর্নিশ জানানোর জন্য আমরা সবাই প্রতিদিন নিজেদের বাড়ির জানলা থেকে রাত ৮টা নাগাদ হাততালি দিচ্ছি। ভিডিয়ো বার্তার মাধ্যমে অনেক স্বাস্থ্যকর্মী ও কর্মচারী এই ধন্যবাদ গ্রহণ করেছেন। গতকাল যেমন হাততালি দেওয়া শেষ হতেই, রাস্তার ওপারে একটি বাড়ি থেকে স্প্যানিশে ‘হ্যাপি বার্থডে টু ইউ’ শোনা গেল। আমরা সবাই গলা মেলালাম সেই সুরে। একজোট হওয়ার সুরেই স্পেন জয় করতে চাইছে করোনা আতঙ্ককে।

লেখক ভাষাতত্ত্ববিদ। দ্য রয়্য়াল গালিসিয়ান অ্য়াকাডেমি অফ ল্যাঙ্গুয়েজে কর্মরত

অন্য বিষয়গুলি:

Coronavirus Spain
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy