প্রতীকী ছবি।
বিশ্বে করোনাভাইরাসে আক্রান্তের সংখ্যা এক কোটি ছাড়িয়েছে। ভারতেও সংক্রমিতের সংখ্যা সাড়ে পাঁচ লক্ষের কাছাকাছি। রেমডেসিভির-সহ একাধিক ওষুধের প্রয়োগ শুরু হয়েছে। তাতে সাড়াও মিলছে বলে চিকিৎসক-বিজ্ঞানীদের দাবি। কিন্তু প্রতিষেধক বা টিকা ছাড়া এই ভাইরাসের সংক্রমণ থামানো সম্ভব নয় বলে প্রথম থেকেই বলে আসছেন বিজ্ঞানী গবেষকরা। তাই করোনার টিকা আবিষ্কারে কার্যত রাতদিন এক করে ফেলছেন চিকিৎসাবিজ্ঞানী ও গবেষকরা। সেই চেষ্টাতেই আরও এক ধাপ অগ্রগতি। এ বার অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের তৈরি করোনার টিকার মানবদেহে তৃতীয় ধাপের পরীক্ষামূলক প্রয়োগ শুরু হল। শুধু তাই নয়, বাণিজ্যিক ভাবে উৎপাদনের জন্য একাধিক সংস্থার সঙ্গে চুক্তিও সারা। কিন্তু সব পরীক্ষায় সফল ভাবে উত্তীর্ণ হওয়ার পর কবে বাজারে আসবে, আপাতত সেই অপেক্ষায় বিশ্ববাসী।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (হু) জানিয়েছে, অন্তত ১৪০টি টিকা আবিষ্কারের প্রকল্প চলছে সারা বিশ্বে। তার মধ্যে অন্তত ১৩টি টিকার পরীক্ষামূলক প্রয়োগ শুরু হয়েছে। তবে এ ক্ষেত্রে প্রথম সারিতে অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়। তাদের তৈরি অ্যাস্ট্রাজেনেকা ইতিমধ্যেই তৃতীয় ধাপে মানবদেহে পরীক্ষামূলক প্রয়োগ শুরু হয়েছে। জানিয়েছেন হু-এর প্রধান বিজ্ঞানী সৌম্য স্বামীনাথন। সংবাদ সংস্থা রয়টার্সকে তিনি বলেছেন, ‘‘অগ্রগতি কতটা, কোন ধাপে রয়েছে, সেই বিচারে আমি মনে করি তারা (অক্সফোর্ডের বিজ্ঞানীরা) এগিয়ে রয়েছেন।’’
মার্কিন সংস্থা ‘মডার্না আইএনসি’র তৈরি এমআরএনএ-১২৭৩ ভ্যাকিসনও দৌড়ে রয়েছে। এই টিকারও তৃতীয় ধাপের পরীক্ষামূলক প্রয়োগ শুরু হচ্ছে আগামী মাসে। সৌম্য স্বামীনাথন তবু অক্সফোর্ডের অ্যাস্ট্রাজেনেকাকেই এগিয়ে রাখছেন। তিনি বলেন, ‘‘আমরা জানি মডার্নার ভ্যাকসিনও তৃতীয় পর্যায়ের ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল শুরু হচ্ছে জুলাইয়ের মাঝামাঝি। ফলে তারাও খুব একটা পিছিয়ে নেই। কিন্তু অগ্রগতি ও বাণিজ্যিক উৎপাদনের প্রক্রিয়ার দিক থেকে আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে বেশি সুযোগ রয়েছে অ্যাস্ট্রাজেনেকার।’’
কিন্তু কোন পর্যায়ে রয়েছে এই টিকাগুলি? কত দিনে শুরু হতে পারে বাণিজ্যিক উৎপাদন? তাদের কার্যকারিতাই বা কেমন, সে সম্পর্কে দেখে নেওয়া যাক।
অক্সফোর্ডের অ্যাস্ট্রাজেনেকা করোনাভাইরাস ভ্যাকসিন
দু’টি ধাপে সফল হওয়ার পর এই ভ্যাকসিনের তৃতীয় ধাপের পরীক্ষামূলক প্রয়োগ চলছে মানবদেহে। যদিও তার ফলাফল নিয়ে কোনও দাবি এখনও সংস্থার পক্ষ থেকে করা হয়নি। তবে ইতিমধ্যেই বিশ্বের অন্তত ১০টি সংস্থার সঙ্গে বাণিজ্যিক উৎপাদন শুরু করার চুক্তি সই হয়েছে। শেষ তথা দশম চুক্তি হয়েছে ব্রাজিলের সঙ্গে। ব্রাজিলে স্থানীয় ভাবে এই ভ্যাকসিন তৈরি হবে। ব্রাজিলের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ জনস্বাস্থ্য আধিকারিক এলসিও ফ্রাঙ্কো সাংবাদিক বৈঠক করে ঘোষণা করেছেন, শুরুতে মোট ৩ কোটি টিকা উৎপাদন করা হবে। তার অর্ধেক ডিসেম্বরে এবং বাকি দেড় কোটি পরের বছরের জানুয়ারির মধ্যেই তৈরি করা হবে। তিনি আরও জানিয়েছেন, ডায়াবিটিস, শ্বাসকষ্টের মতো কো-মর্বিডিটিতে আক্রান্ত প্রবীণ এবং সামনের সারির যোদ্ধা অর্থাৎ চিকিৎসক-নার্সদের প্রথম ব্যাচে উৎপাদিত টিকা দেওয়া হবে। তবে জুনের শুরুতে অ্যাস্ট্রাজেনেকার সিইও বলেছিলেন, এই টিকা করোনাভাইরাসের বিরুদ্ধে সুরক্ষা দেবে এক বছরের জন্য।
আরও পড়ুন: ‘বাবা আমি শ্বাস নিতে পারছি না, ওরা ভেন্টিলেটর সরিয়ে দিয়েছে’, কোভিড রোগীর শেষ ভিডিয়ো ভাইরাল
মডার্নার এমআরএনএ-১২৩৩ ভ্যাকসিন
করোনার ভ্যাকসিন তৈরিতে অক্সফোর্ডের পর দৌড়ে এগিয়ে এই ভ্যাকসিন। তৃতীয় তথা চূড়ান্ত পর্যায়ের পরীক্ষামূলক প্রয়োগ শুরু হচ্ছে জুলাইয়ে। ৩০ হাজার মানুষের উপর প্রয়োগ করা হবে এই ভ্যাকসিন। কিন্তু তার আগেই মার্কিন এই সংস্থা ইতিমধ্যেই উৎপাদনের চুক্তিও সেরে ফেলেছে সে দেশেরই ওষুধ প্রস্তুতকারী সংস্থা ক্যাটালেন্টের সঙ্গে। প্রথম ব্যাচেই ক্যাটালেন্ট ১০ কোটি টিকা উৎপাদন করবে বলে সংস্থার তরফে জানানো হয়েছে। চুক্তি অনুযায়ী টিকা উৎপাদনের পাশাপাশি প্যাকেজিং, লেবেলিং থেকে শুরু করে ডিস্ট্রিবিউশনের কাজও করবে ক্যাটালেন্টই। সম্প্রতি মডার্নার সিইও স্টিফেন বানসেল বলেছেন, পরীক্ষামূলক প্রয়োগের ফল নভেম্বরের মধ্যেই পাওয়া যাবে বলে আশা করা যায়।
আরও পড়ুন: আক্রান্ত সাড়ে পাঁচ লাখ ছুঁইছুঁই, শুধু মহারাষ্ট্রেই ২৪ ঘণ্টায় ৫৪৯৩
স্যানোফির তৈরি জিএসকে কোভিড-১৯ ভ্যাকসিন
অক্সফোর্ড বা মডার্নার চেয়ে কিছুটা পিছিয়ে থাকলেও ফরাসি ওষুধ প্রস্তুতকারী সংস্থার তৈরি এই ভ্যাকসিনের অগ্রগতিও আশানুরূপ। সংস্থার তরফে সম্প্রতি জানানো হয়েছে, একাধিক টিকা প্রস্তুত করেছে তারা। পরীক্ষামূলক প্রয়োগ শুরু হবে এ বছরের চতুর্থ ত্রৈমাসিক অর্থাৎ অক্টোবর থেকে। স্যানোফি আগেই জানিয়েছিল, মার্কিন স্টার্টআপ সংস্থা ‘ট্র্যানস্লেট বায়ো’র সঙ্গে যৌথ ভাবে টিকা তৈরিতে তারা ৪২৫ মিলিয়ন মার্কিন ডলার বিনিয়োগ করবে। সংস্থার সিইও পল হাডসন গত সপ্তাহেই সংবাদ মাধ্যমে বলেছিলেন, তাঁদের তৈরি টিকা সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য হিসেবে তৈরি হতে যাচ্ছে। এটাই একমাত্র ভ্যাকসিন যা কোভিড-১৯ চিকিৎসায় সাফল্যের প্রমাণ দেবে।
তাইল্যান্ড করোনাভাইরাস ভ্যাকসিন
তাইল্যান্ডে অন্তত সাতটি করোনাভাইরাসের ভ্যাকসিন তৈরির গবেষণা চলছে। তার মধ্যে একটির পরীক্ষামূলক প্রয়োগ শুরু হতে পারে অক্টোবরেই। সে দেশের চুলালংকর্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের সেন্টার ফর এক্সেলেন্স ইন ভ্যাকসিন রিসার্চ অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট-এর প্রধান গবেষক কিয়াট রুক্সরুংথাম বানরের দেহে পরীক্ষামূলক প্রয়োগের পর দেখা গিয়েছে, অ্যান্টিবডি তৈরি হয়েছে। তাঁর দাবি, বেশিরভাগ ক্ষেত্রে দেখা গিয়েছে, দেহে প্রবেশ এবং কোষে আক্রমণ রুখে দিতে পেরেছে এই ভ্যাকসিন। এই প্রকল্পে নতুন এমআরএনএ ভ্যাকসিন প্রযুক্তি ব্যবহার করা হয়েছে, যার পরীক্ষামূলক প্রয়োগের ফল আগামী দু’সপ্তাহের মধ্যেই পাওয়া যাবে বলেও দাবি করেছেন রুক্সরুংথাম। পরবর্তী ধাপে ১০ হাজার ভ্যাকসিন তৈরি করে মানবদেহে পরীক্ষামূলক প্রয়োগ শুরু হবে বলেও জানিয়েছেন তিনি।
এমএমআর ভ্যাকসিন
চিকিৎসাবিজ্ঞান সংক্রান্ত পত্রিকা ‘এমবায়ো’-তে সম্প্রতি প্রকাশিত একটি প্রতিবেদনে দাবি করা হয়েছে, মিজলস, মামস ও রুবেলা বা এমএমআর প্রতিরোধে যে ভ্যাকসিন দেওয়া হয়, সেটা করোনাভাইরাসের ক্ষেত্রেও কার্যকরী হতে পারে। কারণ এই টিকা হৃদযন্ত্রে সংক্রমণ আটকায়, যা কোভিড-১৯ আক্রান্তদেরও অন্যতম সমস্যা। ল্যাবে পরীক্ষামূলক প্রয়োগে দেখা গিয়েছে, এই টিকা প্রয়োগ করা হলে এবং তা সক্রিয় থাকলে গুরুতর অসুস্থতা রোধ করা যায়। কোভিডের চিকিৎসায় সরাসরি প্রয়োগের কথা না বললেও কোভিড আক্রান্ত গুরুতর অসুস্থদের ক্ষেত্রে এই টিকা কাজে আসতে পারে বলে মনে করছেন বিজ্ঞানীরা।
তবে এখানেই শেষ নয়। এর বাইরেও করোনাভাইরাস প্রতিরোধী আরও অনেকগুলি ভ্যাকসিন বা টিকা উৎপাদন ও তা নিয়ে পরীক্ষানিরীক্ষা চলছে। কয়েকটির প্রথম ধাপের পরীক্ষামূলক প্রয়োগও শুরু হয়েছে। আমেরিকার ‘ফাইজার’ ও জার্মানির বায়োএনটেক- এই দুই ওষুধ প্রস্তুতকারী সংস্থার যৌথ উদ্যোগে তৈরি বিএনটি-১৬২ ভ্যাকসিনের প্রথম ও দ্বিতীয় পর্যায়ের পরীক্ষামূলক প্রয়োগ চলছে। চিনের দুই সরকারি সংস্থা ‘উহান ইনস্টিটিউট অব বায়োলজিক্যাল প্রোডাক্টস-এর তৈরি ‘ইনঅ্যাক্টিভেটেড ভ্যাকসিন’ এবং বেজিং ইনস্টিটিউট অব বায়োলজিক্যাল প্রোডাক্টস-এর ‘বিবিআইবিপি কর্ভ’ ভ্যাকসিন দু’টিরও প্রথম ও দ্বিতীয় ধাপের পরীক্ষা চলছে একসঙ্গে। হু জানিয়েছে, এই রকম মোট অন্তত ১৩টি ভ্যাকসিন তৈরি হয়েছে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে, যাদের ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল শুরু হয়েছে। তবে অ্যাস্ট্রাজেনেকা ছাড়া সবগুলিই প্রথম বা দ্বিতীয় স্তরে রয়েছে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy