ছবি রয়টার্স
ইটালিতে আছি বটে, অবস্থাটা মোটেও ভাল নয়। জানি না কী হবে! গত এক সপ্তাহ ধরে বিপর্যয় চলেছে। শুক্রবার কোভিড-১৯-এ আক্রান্ত হয়ে ৬২৭ জন প্রাণ হারিয়েছেন। শনিবার ৭৯৩। এক দিনে নতুন করে আক্রান্ত হচ্ছেন ৬ হাজারের বেশি মানুষ। সব মিলিয়ে অসুস্থ ৫০ হাজার ছাড়িয়ে গিয়েছে। এখন তো মানুষ খাদ্যসঙ্কটের মুখে। মিলছে না প্রয়োজনীয় ওষুধপত্র। হাসপাতালগুলিতে আরও স্বাস্থ্যকর্মী ও অ্যাম্বুল্যান্স প্রয়োজন। নোভেল করোনাভাইরাসে আক্রান্তেরা প্রতি মুহূর্তে আসছেন।
কিন্তু ঘরে বসে থাকলে চলবে কী করে! আবার বেরোলেই অর্থদণ্ড। সরকারের লক ডাউন আদেশ অমান্য করে বাইরে বেরিয়ে ৪০ হাজার মানুষ জরিমানা দিয়েছেন ইতিমধ্যে।
এখানে বসবাসকারীদের দেশে ফেরাতে ভারত সরকার শুরুতেই ব্যবস্থা গ্রহণ করেছে। ২৬৩ জন ভারতীয়কে নিয়ে গেল এয়ার ইন্ডিয়ার বিমান। রবিবার তা দিল্লিতে পৌঁছেছে। এর আগে শেষ বিমানটি গিয়েছিল ১৪ মার্চ। কিছু ভারতীয় এখানেই থেকে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। আমিও তাই করি। আমার ভাবনাটা হল, এখনও তো সুস্থ আছি। মিলান শহরের এক বাড়িতে একা থাকছি। এমন ভয়াবহ পরিস্থিতিতেও নিজেকে ঘরবন্দি রাখতে পারলে হয়তো বেঁচে যেতে পারি। কিন্তু দেশে ফিরতে গিয়ে আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কাটা আরও বেশি। অসমের শিলচরে আমার বাড়ি।মা-বাবা রয়েছেন। তাঁদের কাছে ফিরতে তিন বার বিমান বদলাতে হবে। মিলান থেকে দিল্লি, পরে দিল্লি-কলকাতা, কলকাতা-শিলচর। আড়াই দিন পথেই কাটবে। এ আরও বেশি ঝুঁকির। আমার মনে হয়েছে, বাড়ি যাওয়ার পথে আমি করোনায় সংক্রমিত হলে মা-বাবাও আক্রান্ত হতে পারেন। আমার সূত্র ধরে করোনা ছড়িয়ে পড়তে পারে দেশ জুড়ে। তখন অবশ্য ভারতে পজিটিভ একটিও ছিল না। বারবার মনে হচ্ছিল, আমার মধ্য দিয়ে দেশ করোনা-আক্রান্ত হলে নিজেকে ক্ষমা করতে পারব না।
তাই ইটালিতেই থেকে গিয়েছি। ঘরবন্দি। হাইজিন মেনে চলছি। দু’মাসের খাদ্যসামগ্রী এনে রেখেছি।চাল, আলু, মাছ। তখন স্থানীয় বন্ধুরা এ নিয়ে হাসিঠাট্টা করছিল। এরা তখনও বুঝতে পারেনি, বিপর্যয় কাকে বলে! এখন তারা জীবনের ঝুঁকি নিয়ে সুপার মার্কেটে যেতে বাধ্য হচ্ছে।
দ্বাদশ শ্রেণি পর্যন্ত আমার পড়াশোনা শিলচর মহর্ষি বিদ্যামন্দিরে। পরে চেন্নাইয়ের এসআরএম ইউনিভার্সিটি থেকে করি বিটেক। ২০১৬ সালে এমটেক করতে এখানে আসি। ভর্তি হই পলিটেকনিকো ডি মিলানো-তে। মেকানিক্যাল ও ইলেকট্রনিকস মিলিয়ে একটা কোর্স রয়েছে এখানে— মেকট্রোনিকস। এতেই স্পেশালাইজেশন করছি। সঙ্গে কাজ করছি মেক্সিকোর একটি কোম্পানির মিলান ইউনিটে। ইটালিতে ভারত থেকে প্রচুর ছাত্রছাত্রী পড়তে আসে।দক্ষিণ ভারতীয়ই বেশি। এ ছাড়া, এত দেশ থেকে ছাত্ররা আসে যে, সব একাকার। তাদের নিয়ে মুশকিল নেই। তবে স্থানীয়রা ইংরেজিটা কম বোঝেন। ইটালিয়ান ভাষাটা বলতে সুবিধা হত। তবে চলাফেরায় সমস্যা হয় না। কঠিন পরিস্থিতিতেও প্রয়োজনে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেন এ শহরের মানুষ। ফলে নিরাপত্তাহীনতা একেবারেই নেই।
এখন অন্য ধরনের নিরাপত্তাহীনতা। করোনাভাইরাসের এপিসেন্টার বলে পরিচিত করদোনো থেকে মিলান খুব একটা দূরে নয়। তাই সামান্য সর্দি-কাশি হলেও ভয় হয়। এর ওপর ভারতেও প্রতি দিন করোনা আক্রান্তের সংখ্যা বাড়ছে। চিন্তা হয় মা-বাবাকে নিয়ে। দিদি বেঙ্গালুরুতে চাকরি করেন। তাঁকে নিয়েও চিন্তা। তাঁরাও আমাকে নিয়ে উদ্বিগ্ন। তবু বাবা আমার বড় শক্তি। এই সময়ে আমার দেশে না-ফেরার যুক্তি মেনে নিয়েছেন।
কিন্তু প্রশ্ন হল, কত দিন একেবারে ঘর থেকে না-বেরিয়ে থাকা সম্ভব হবে! ৬ কোটি মানুষের এই দেশটির এখন এমন অবস্থা যে, প্রতিষেধক বার হওয়ার আগে পর্যন্ত ঘরবন্দিই থাকতে হবে। ক’দিন আগে আমেরিকা মানবদেহে প্রতিষেধক পরীক্ষা শুরু করেছে। সফল হলেও তো দেড়-দু’বছরের ব্যাপার।
বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ। এপ্রিলে কোর্স শেষ হওয়ার কথা ছিল। এখন কবে যে রোগটা নিয়ন্ত্রণে আসবে! বিশ্ববিদ্যালয় খুলবে! আর সব সেরে সুস্থ অবস্থায় দেশে ফিরব!
সময় কাটছে কী করে? সোশ্যাল নেটওয়ার্কে সময় দিতে মন চায় না। চেন্নাইয়ে কাজ করার সময়ে দেখেছি দু’মুঠো খাবার জোগাড় করাই কী কঠিন! জলে বন্যায় ফসল নষ্ট হয়। গ্রামের উপযুক্ত কোনও সাইকেল, সৌরশক্তির সাহায্যে ফসল সংরক্ষণের যদি কোনও ব্যবস্থা করা যায়, তার ডিজাইন তৈরির চেষ্টা করছি। দেশে ফিরে যা কাজে লাগানো যায়।
আর হ্যাঁ, চুটিয়ে বই পড়ছি। এমন সুযোগ কি হাতছাড়া করা যায়!
লেখক ‘পলিটেকনিকো ডি মিলানো’র এমটেক পড়ুয়া
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy