লকডাউনে জনশূন্য ব্রিটেনের রাস্তা।
কলকাতায় চিকিৎসকদের অনেকেই কোভিড-১৯ অতিমারীর প্রেক্ষিতে বেশ সমস্যার মধ্যে। সংবাদ মাধ্যমে দেখতে পাচ্ছি, সারাদিন হাসপাতালে লড়াই করে বাড়িতে ফিরে আসার পরে তাঁদের কারোর কপালে জুটছে হাউজিং সোসাইটির তরফে হুমকি, কারোর বাড়িওয়ালা তাঁকে তাড়ানোর জন্য উঠেপড়ে লেগেছেন। কারণ একটাই, চিকিৎসকের মাধ্যমেই যদি ঘটে যায় সংক্রমণ! ভারতের অন্যত্রও ছবিটা খুব আলাদা নয়, এমন খবরও পাচ্ছি। বিশ্বময় এই লড়াইয়ে যাঁরা অগ্রবর্তী সৈনিক, তাঁদেরকেই যদি এমন ব্যবহার পেতে হয় সমাজের কাছে, তখন মন ভেঙে যায়। মনে হয়, নিজের জীবন বিপন্ন করে এই কাজ চালিয়ে যাওয়ার অর্থ কী।
কিন্তু এই সাত সমুদ্র পারের দেশ ব্রিটেনে চিকিৎসক সম্পর্কে মানুষের ধারণা এই মুহূর্তে একেবারেই আলাদা। এটা আমি টের পেলাম সেদিন সকালে। আমি সকাল ৬টা ১৫ নাগাদ হাসপাতালে যাওয়ার জন্য বের হই। সেদিন আমি আমার গেট বন্ধ করে রওনা দেব, এমন সময়ে আমি আমার প্রতিবেশীদের পক্ষ থকে হাততালি ও হর্ষধ্বনি শুনতে পেলাম। সেটা শুধুমাত্র আমার পেশার কারণে। আমার চোখ আবেগে ভিজে উঠল। এমনটা কি আমি আশা করেছি কখনও?
আমি চিকিৎসক। কলকাতা মেডিক্যাল কলেজের প্রাক্তনী এবং আমি ব্রিটেনের এনএইচএস-এর ৪০,০০০ ভারতীয় চিকিৎসকের একজন। গত তিন সপ্তাহে আমার পেশা সংক্রান্ত ধারণা আমূল বদলে দিয়েছে কোভিড-৯ অতিমারী। আমি যে হাসপাতালে কর্মরত, সেখানে কোভিড-১৯-এর জন্য সদ্য খোলা ওয়ার্ডের দায়িত্ব আমাকে দেওয়া হয়। আমি এবং আমার কনসালটেন্ট চিকিৎসক সহকর্মী নওয়াইদ আহমেদের অধীনে ৩০ জন রোগী রয়েছেন। যখন আমাকে কোভিড পজিটিভ রোগীদের চিকিৎসার ভার দেওয়া হল, আমার মনে হল আমিও নভেল করোনাভাইরাসের দ্বারা আক্রান্ত হতেই পারি। প্রথম সপ্তাহে ব্যাপারটা বেশ কঠিন ছিল, কারণ ওখানে যথেষ্ট পরিমাণে পিপিই (পার্সোনাল প্রোটেকটিভ ইকুইপমেন্টস) বা ব্যক্তিগত সুরক্ষার সরঞ্জাম ছিল না। আর আমার হাতে ছিলেন তিনজন কোভিড পজিটিভ রোগী। পরে কিছু সরঞ্জাম আমাদের হাতে আসে, তা-ও পরিমাণে যথেষ্ট নয়।
এই সব উপসর্গ দেখা দিলে তবেই ভর্তি করা হচ্ছে হাসপাতালে।—নিজস্ব চিত্র।
দ্বিতীয় সপ্তাহে ঘটনা অন্য দিকে গড়াতে শুরু করে এবং সপ্তাহের শেষ দিকে ২০টি বেডের সবক’টিতেই রোগী ভর্তি হন। আমার অধীনে ১০জন রোগী আসেন, যাঁরা প্রত্যেকেই পজিটিভ। এঁদের বয়স ২৮ থেকে ৯০ বছর। এঁদের মধ্যে ৯৫ শতাংশেরই রোগলক্ষণ ছিল বিভিন্ন মাত্রার নিউমোনিয়ার মতো। বয়স্ক রোগীদের আরও বেশ কিছু সমস্যা ছিল, ফলে নিউমোনিয়া প্রতিরোধের ক্ষমতাও কম ছিল। সেরে উঠতে তাঁদের অনেকটা বেশি সময় লাগছিল। তাঁদের মধ্যে এক জন এর মধ্যে মারাও যান। এই সময়ে আমাদের রোগীদের পাশাপাশি তাঁদের উদ্বিগ্ন আত্মীয়-স্বজনকেও সামলাতে হচ্ছিল যাবতীয় বিধি-নিষেধ এবং সোশ্যাল ও ফিজিক্যাল ডিস্ট্যান্সিংয়ের নিয়ম মেনেই।
তৃতীয় সপ্তাহে কোভিড-১৯-এ আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা বেড়ে দাঁড়াল ২৬। অন্য আর একটা ওয়ার্ডে বাড়তি রোগীদের জায়গা দেওয়া হল। কার পর্কিং, অ্যাক্সিডেন্ট ও এমার্জেন্সি-সহ যাবতীয় নিয়মিত বিভাগ ও সার্জারি বাতিল করা হল। আগামী ৩-৪ সপ্তাহে সংক্রমণ বাড়তে পারে অনুমান করে ওয়ার্ডের সংখ্যা বাড়ানোর চেষ্টা শুরু হল। আমরা আমাদের নিয়মিত চিকিৎসার কাজ বাতিল করে টেলিফোনে পরামর্শ দেওয়া শুরু করলাম।
আরও পড়ুন: এক সপ্তাহে মৃতের সংখ্যা দ্বিগুণ হয়েছে, কোভিড-১৯ নিয়ে উদ্বেগে হু
ব্রিটেনে পরিস্থিতি বেশ সঙ্কটপূর্ণ। জাতীয় স্তরে প্রধানমন্ত্রী, স্বাস্থ্য মন্ত্রী, চিফ মেডিক্যাল অফিসার—প্রত্যেকেই কোভিড-১৯-এ আক্রান্ত এবং আইসোলেসনে চলে গিয়েছেন। কলকাতায় আমার পরিবারের জন্য আমি খুবই চিন্তিত। সেই সঙ্গে আমেরিকা, ইউরোপ, সিঙ্গাপুরে ছড়িয়ে থাকা আত্মীয়দের জন্যও। আমার মা, ভাই , বোন ও তাঁদের পরিবার কলকাতায় এবং তাঁদের কাছ থেকে আমি শুনতে পাচ্ছি, সেখানেও সামাজিক লকডাউন চলছে এবং সরকারের তরফে যথেষ্ট ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে। তবুও চিন্তা থেকেই যায়।
আরও পড়ুন: লকডাউনের পরের ছক তৈরি রাখুন, মুখ্যমন্ত্রীদের সঙ্গে বৈঠকে বার্তা প্রধানমন্ত্রীর
কিন্তু, জীবন থেমে থাকবে না। আমি চিকিৎসক। এটা আমার পেশা। প্রতিবেশীদের তরফে সেদিন সকালে এই কৃতজ্ঞতা প্রকাশ দেখে মনে হল, যে ঝুঁকি আমরা নিচ্ছি, তার অন্য মানে রয়েছে। বৃহত্তর মানব সমাজের জন্য আমাদের এই কাজ চালিয়ে যেতে হবে। রোগীকে রোগমুক্ত করার শপথ নিয়েছি আমরা। তার মর্যাদা রাখতে আমাদের লড়াই চালিয়ে যেতেই হবে।
লেখক টেলফোর্ডের প্রিন্সেস রয়্যাল হসপিটালে কনসালট্যান্ট রেসপিরেটরি ফিজিশিয়ান হিসেবে কর্মরত।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy