Advertisement
২২ নভেম্বর ২০২৪
USA

দেশে কি ফিরতে পারব, নাকি ফিরবে আমার মতো অন্য কেউ?

নিউ জার্সি। ছবি: টুইটার থেকে নেওয়া।

নিউ জার্সি। ছবি: টুইটার থেকে নেওয়া।

ঋতুপর্ণা ভট্টাচার্য
নিউ জার্সি (আমেরিকা) শেষ আপডেট: ১৯ মে ২০২০ ১৯:৩১
Share: Save:

একটা দেশে শ্রমিকরা রাস্তায় বেরিয়ে হাঁটছে মাইলের পর মাইল, অন্য একটা দেশে কিছু মানুষ আরও গুটিয়ে যাচ্ছে ঘরের ভিতর। “তেইশ দিন দরজা খুলিনি ভাড়া নেওয়া অ্যাপার্টমেন্টের। ভয়ে। এখানে তো আমাদের কোনও বন্ধু, আত্মীয় কেউ নেই। সংক্রমণ হয়ে গেলে কী হবে? প্রতি পনের দিনে বাড়ির লিজ রিনিউ করছি, জানেন! ঘরে শুধু চাল আছে, বাচ্চাদের একটু দুধ আর ওষুধ। সারা মাসের ওষুধ দেশে পাই পাঁচ হাজার টাকায়, এখানে কিনছি সাতশো ডলারে। ছেলেটার দেড় বছর বয়েস। আমরা সবাই ইন্ডিয়ান। শুধু আমার ছয় বছরের মেয়েটা আমেরিকান বলে আমরা দেশে ফিরতে পারছি না। বারো বছর ধরে আমেরিকা আসছি। পারতাম না থেকে যেতে, বলুন তো? এ বার ব্যবসার কাজ আর পারিবারিক ছুটি কাটাতে এসে দু’মাস ধরে আটকে আছি। আমরা কি ভারতীয় নই? ট্যাক্স দিইনা?” নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন ভদ্রলোক জানালেন। তাঁর সঙ্গে রয়েছেন স্ত্রী এবং দুই সন্তান।

“এপ্রিলের শেষে মারা গেছেন আমার বাবা। তার আগে থেকেই যেতে চাইছিলাম। আমি আমেরিকার সিটিজেন। কিন্তু মা-বাবা ভারতীয়। মুম্বইতে মা-বাবা একলা থাকতেন। সেই মার্চ মাসে হঠাৎ একদিন নোটিশ দিয়ে সেদিনই বন্ধ করে দেওয়া হল ভিসা এবং ওসিআই কার্ডধারীদের ভারতে প্রবেশ। আমাদের তো ফিরে যাওয়ার সুযোগটুকুও দেওয়া হল না। টুইট করছি। এদিক ওদিক ছুটোছুটি করছি। ওদিকে এই লকডাউনে মা একা একা সামলাচ্ছেন সব কিছু। আমাদের মতো ইমার্জেন্সি কেসের ক্ষেত্রেও কি ছাড় পাওয়া যেত না? আমার নাম, টুইটার পোস্ট সব কিছু লিখে দেবেন। যদি কেউ শোনে!” আলিয়ার আকুতি ঝরে পড়ছিল ফোনের ওপারে।

“সেভিংস আর কিছু নেই রে! দু’মাস হল চাকরি চলে গেছে। এইচ ওয়ানবি ভিসার মেয়াদ শেষ। ষাট দিনের গ্রেস পিরিয়ড পেরিয়ে যাচ্ছে শিগগির। একশ আশি দিনের এক্সটেনশনের জন্য বলা হয়েছে, মার্কিন সরকার সে রকম কিছু কনফার্ম করেনি এখনও। কী হবে জানি না। পিএচডি করতে এসেছিলাম। নিজের যোগ্যতায় চাকরি পেয়েছি। সিঙ্গল মাদার হয়ে কত ঝক্কি সহ্য করছি। আমার ছেলেটা আমেরিকান বলেই কেবল মুখ ঘুরিয়ে নিল সবাই? অথচ ওসিআই দেওয়ার সময় তো বলেছিল, কত নিশ্চিন্তি। বার বার ভিসার ঝামেলা নেই। নিজেদের ডকুমেন্টকে নিজেরাই অস্বীকার করছে কী করে বল তো?” বলছিল প্রিয় বন্ধু। রাগে দুঃখে ফুঁসছে। একবার গায়ে হাত দিয়েছিল বলে উদোম পিটিয়েছিল একটা ছেলেকে মাঝরাস্তায়। আমরা তখন কলেজে। সেই ক্যারাটে জানা মেয়েটা কেমন অসহায় হয়ে লুটিয়ে পড়ছে নিজেই এখন। ওর হাত কি নিশপিশ করছে?

আরও পড়ুন: করোনা মোকাবিলায় এক ভিক্ষুকের দান দেখে অকুণ্ঠ প্রশংসা নেটাগরিকদের

এগুলো খণ্ড চিত্র। একটা ভয়াবহ ক্যানভাসের উপরে কিছু এবড়োখেবড়ো রং। পুরো ছবিটা এখনো স্পষ্ট হয়নি। আন্ডার কনস্ট্রাকশন। খড়কুটোর মতো ভাসছে কিছু জীবন। কী অপরাধ তাদের? তারা শিক্ষিত? তারা বিত্তবান? তারা বিদেশে বসবাস করছে ? তাদের শেষ রুটিটা ট্রেনের লাইনে পড়ে নেই? তারা পায়ে হেঁটে ফিরছে না লম্বা কঠিন পথ? ফিরতে পারবে না। তাদের ফেরার কোনও রাস্তা নেই এখনও।

সেই মার্কিনি নাগরিকত্ব তাদের কেউ হাতের মোয়া হিসেবে তুলে দেয়নি। নিজের যোগ্যতায় অর্জন করতে হয়েছে। দু’জন নোবেলজয়ী বাঙালিকে নিয়ে আমরা আহ্লাদে ভূলুণ্ঠিত প্রায়। ভেঙ্কি রামকৃষ্ণন নোবেল পাওয়ার পর মনে হয়েছিল ভারতেই বুঝি চলে গিয়েছে সেই নোবেল। কল্পনা চাওলা ভারতীয় নাগরিকত্ব ত্যাগ করেছিলেন জেনেও তাঁকে মহাকাশের দেবী হিসেবে মান্য করেছি। সুনীতা উইলিয়ামসকেও তাই। রবি ঠাকুরের নোবেল চুরি গেলেও ঝুম্পা লাহিড়ির পুলিৎজার সম্ভব হলে ভারতীয় জাদুঘরে সাজিয়ে রাখতাম আমরা। সত্য নাদেলা? সুন্দর পিচাই? কত হাজার সহস্র নাম প্রবাসী ভারতীয়দের উত্তরণের মিছিলে। আপন যোগ্যতায় নিজের দেশের কমফোর্ট জোন ছেড়ে যারা জগৎজয়ের আশায় বেরিয়েছে, আজকে এই মায়াহীন মুহূর্তে তারা সবাই স্থবির! ভয়ে, চিন্তায়, নিরাশায় মাটিতে মিশে যাচ্ছে দিনের পর দিন। দেশের মাটিতে বসে কেউ কি ভেবেছি তাদের কথা? তারা আসলে সবাই নির্বাসিত প্রাণ। একজন লেখিকার মতো সহায়হীন। নিজদেশেও পরবাসী, পরদেশেও তাই।

আরও পড়ুন: ১৪ ঘণ্টা বোট চালিয়ে গোটা শহরের মুখে খাবার তুলে দিচ্ছেন সুপারমার্কেট মালিক

মোদ্দা ব্যাপারটা হল এই, মার্চ মাসের মাঝামাঝি থেকে ভারতে লকডাউনের ফলে আন্তর্জাতিক সফর বন্ধ হয়ে যাওয়ায় সমস্ত ভিসা এবং ওসিআই কার্ডধারীদের ভারতে প্রবেশাধিকার স্থগিত রাখা হয়েছে। ওসিআই কার্ড ব্যাপারটি সহজভাবে বলতে গেলে একটি প্রমাণপত্র, যাতে ইন্ডিয়ান অরিজিনের বিদেশী নাগরিকরা ভিসা ছাড়া ইচ্ছেমতো ভারতে যাতায়াত, দীর্ঘ সময় বসবাস— সবই করতে পারে। তবে তাদের ভোটাধিকার, সরকারী চাকরির অধিকার, চাষের জমি কেনা ইত্যাদির মতো কিছু ব্যাপারে নিষেধাজ্ঞা আছে। প্রসঙ্গত সারা দুনিয়ায় প্রায় ছয় মিলিয়ন ওসিআই কার্ডধারী লোকের বসবাস।

ভারত সরকারের নতুন ‘বন্দে ভারত মিশন’ দাবি করেছে এই ‘রিপার্ট্রিয়েশন’ বিমানগুলিতে ভারতীয় পাসপোর্টধারী ছাড়া আর কারোকেই উঠতে দেওয়া হবে না। যতদিন না আন্তর্জাতিক বিমান পরিষেবা স্বাভাবিক হচ্ছে, তত দিন কি তা হলে শত বিপদ কাঁধে নিয়ে এ ভাবেই বন্দি থাকবে অন্য মানুষগুলো? যারা বিদেশি পাসপোর্টধারী হলেও দেশের সঙ্গে হাজার সম্পর্কে জড়িয়ে রয়েছে নানান ভাবে? নিউ ইয়র্ক ইন্ডিয়ান কনসুলেটের কথা বলতেই হয়। কনসাল জেনারেল সন্দীপ চক্রবর্তী এক দিকে যেমন ভারতীয় সংস্কৃতিকে উদ্দীপ্ত করেন প্রতি মুহূর্তে, অন্য দিকে এই ভয়ার্ত সময়ে সাধ্য মতো পাশে দাঁড়াচ্ছেন এই অসহায় মানুষগুলোর। এই তো সম্প্রতি অনলাইনে বিশ্বজোড়া শিল্পীদের নিয়ে উদযাপন করলেন রবিঠাকুরের জন্মতিথি। তবে তিনি ছাড়াও দূতাবাসের সকলেই সব রকম সম্ভাব্য সাহায্যের পাশাপাশি প্রয়োজন হলে থাকার ব্যবস্থার আশ্বাসও দিয়েছেন অনেককে। কিন্তু তাঁদের তো হাত পা বাঁধা। কারোকে দেশে ফেরানোর ক্ষমতা তাঁদের নেই।

তেত্রিশ মিলিয়ন মানুষের চাকরি চলে গিয়েছে আমেরিকায়। ভারতীয়রা যাঁরা সেই দলে রয়েছেন, তাঁদের তো এখন মৃত্যুসম দশা। সন্তান মার্কিনি বলে দ্বিগুণ দামের টিকিট কেটে এয়ারপোর্ট থেকে ফিরে আসতে হচ্ছে। মা-বাবা ভারতীয় হয়েও ফ্লাইটে উঠতে পারছেন না। তাহলে দাবিটা কী? বাচ্চাকে ফস্টার হোমে রেখে মা-বাবা ফিরে যাবেন নিশ্চিন্তি আশ্রয়ে? নিউ ইয়র্কের কমিউনিটি লিডার প্রেম ভান্ডারী শক্ত হাতে ডুবন্ত মানুষগুলোকে ভাসিয়ে তুলতে সাহায্য করছেন। ভারতীয় সরকারের কানে তুলেছেন এই সমস্যার কথা। সাম্প্রতিক ওয়েবিনার আয়োজন করা থেকে শুরু করে আরও নানা উপায়ে চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন সমাধানের জন্য।

আরও পড়ুন: ‘অপরিচিত’ চিকিৎসকের চেষ্টায় আরব থেকে সন্তানের দেহ নিয়ে ফিরলেন কেরলের দম্পতি

ভারতীয়দের দেশে ফেরার অধিকার সবার প্রথমে। ওসিআই কার্ডধারীরা ভারতীয় নয়। ঠিক যেমন করে আমরা অনেকে পূর্ববঙ্গের নই। এই কাঁটাতার কত অযৌক্তিক নিয়মের জন্ম দেয়! টানাপড়েন, দ্বিধা, ভয়, লড়াই, বিভেদ। অথচ এই বাড়ি ফেরার লাইনের প্রথমে কে দাঁড়াবে, সেটার জন্য তো কিছু ব্যতিক্রমকে মানতে হবে। কিছু বিশেষ ক্ষেত্রে অভারতীয়দের ফেরার দাবিটা ন্যায্য। সেটা তো ভেবে দেখা উচিত সবার। শোনা যাচ্ছে, প্রশাসনের মধ্যে ভাবনা চিন্তা শুরু হয়েছে এই নিয়ে। মানবিক দিকগুলো খতিয়ে দেখা হচ্ছে। সেদিকেই তাকিয়ে এখন আমেরিকার এই দোলাচলের ঘূর্ণিঝড়ে বিধ্বস্ত কিছু মানুষ। চেনা পাড়া ছেড়ে ভিনদেশি হতে হয়েছিল একদিন। সোশ্যাল মিডিয়ায় মারমুখী স্টেটাস-ছবি অনাবাসী ভারতীয়দের বিরুদ্ধে। কেন ফেরানো হবে? বিদেশে গিয়েছিলি, সেখানেই পচে মর। তারা ফিরলেই করোনা বেড়ে যাবে বহুগুণ। যেন তারা সব ‘করোনাবোমা’! দেশে ফিরেই ফেটে পড়বে। একটু মানবিক হই। একটু সহনশীল। বাস্তবটা ভেবে দেখি। পুরো পরিস্থিতিটা অনুধাবন করা যাক এক বার। অন্তত ‘রিটার্ন অব দ্য প্রডিগাল সন’ হিসেবেই যদি ভাবা হয়? তবু তো আশ্রয়ে ফিরুক ওরা। “আমি কি ফিরতে পারব, নাকি যে ফিরবে সে আমার মতো অন্য কেউ?”

অন্য বিষয়গুলি:

USA New Jersey Coronavirus India
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy