Advertisement
১৬ জানুয়ারি ২০২৫
New York

জনশূন্য চেরি ব্লসমের সাম্রাজ্যে...

দিন দুই আগে, কুয়াশামাখা এক সকালে দেখি শার্সিআঁটা জানলার ওপারে দাঁড়িয়ে থাকা মেপলগাছ জুড়ে ছোট্ট ছোট্ট গোলাপী কুঁড়ি। যাকে বলে চেরি।

ছবি: এপি।

ছবি: এপি।

নবনীতা সেন
শেষ আপডেট: ২৯ মার্চ ২০২০ ০২:৩০
Share: Save:

সপ্তাহ চারেক বাড়িবন্দি, কার্ফু চলল আরও দিন দশ, এখন সম্পূর্ণ লকডাউন। মাসখানেক ধরেই ক্রমশ দুষ্প্রাপ্য হয়ে উঠেছিল মাস্ক, স্যানিটাইজার, ঘর পরিষ্কারের সরঞ্জাম, শুকনো খাবার, পানীয় জল। এখন সীমিত পরিমাণে পাওয়া যাচ্ছে দৈনিক অপরিহার্য কিছু সামগ্রী। ঢিলছোঁড়া দূরত্বে নিউ ইয়র্ক। আমাদের আবাসনের ৯৫% চাকুরিজীবী রোজ সেখানে যান। এই নিউ ইয়র্কই ক্রমে আমেরিকায় করোনাভাইরাসের আঁতুড়ঘর হয়ে উঠেছে। নিউ ইয়র্কে প্রথম সংক্রমণ ঘোষণা হল, মার্চের ১ তারিখ।মার্চ ১৪ তে আক্রান্তের সংখ্যা বেড়ে দাঁড়াল ৭২৯। মার্চ ২৬শে কেবল নিউইয়র্কে সংক্রমিত ৩৩০০৬ জন। আমেরিকা জুড়ে সংখ্যাটা ৬৮৫৭২, মৃত ১০৪১।

আমার বাড়ির পাশের রাস্তা মেশে হাইওয়ে ইউএস ওয়ানে। তাতে গাড়ি এখন হাতেগোনা, কেবল লাল-নীল আলোওয়ালা পুলিশের গাড়ি আর অ্যাম্বুলেন্সের বিদীর্ণ শব্দ। মাইলখানেক দূরত্বে ব্যস্ততম জন এফ কেনেডি হাসপাতাল।

তার মধ্যেই চলছিল জগিং, পোষ্যদের নিয়ে প্রাত্যহিক ভ্রমণ, জানলা দিয়ে কুশল বিনিময়, বন্দিদশায় খাদ্য সঞ্চয়ের পরিকল্পনা। দিন ছয় আগে আমাদের আবাসনের বাঁদিকের উইংসে উপরে, নীচে দুটো পরিবারের দরজায় কাউন্টির হেল্থ ডিপার্টমেন্ট থেকে কোয়রান্টিন নোটিশ আটকে দিয়ে গেল। তাদের মধ্যে সত্তরোর্ধ্ব আমেরিকান দম্পতি, অপর পরিবারটি ভারতীয়। তার ঠিক একদিন পর আমার সামনের ফ্ল্যাটের পরিবারটি সাত বছরের মেয়ের স্কুলফেরত সংক্রমণের আশঙ্কায় স্বেচ্ছাবন্দি হলেন। ক্রমাগত চলছে সিডিসি (সেন্টার ফর ড্রাগ কন্ট্রোল অ্যান্ড প্রিভেনশন) থেকে পর্যবেক্ষণ। তার পর থেকেই আকস্মিক স্তব্ধতা। দমবন্ধ, অনিশ্চিত প্রহর যাপন। বন্ধ দরজার পাড়ে নিস্তব্ধ সকাল, অপরাহ্নের ছায়া গড়িয়ে নামে রাত।

দিন দুই আগে, কুয়াশামাখা এক সকালে দেখি শার্সিআঁটা জানলার ওপারে দাঁড়িয়ে থাকা মেপলগাছ জুড়ে ছোট্ট ছোট্ট গোলাপী কুঁড়ি। যাকে বলে চেরি। পাতাবিহীন ডালে কুঁড়ির সাম্রাজ্য। দিন দুয়েকেই কুঁড়ি থেকে ফুটবে মিঠে, কোমল ফুল, তার থেকে চিকণ সবুজপাতা। এই জন্মলগ্নই ‘চেরি ব্লসম’। মার্চের শেষ থেকে এপ্রিলের প্রথম সপ্তাহ জুড়ে আমেরিকার বিভিন্ন প্রান্তে চলে গান-বাজনা, খাদ্য, পানীয়সমেত ‘চেরি ফেস্টিভ্যাল’। কতকটা আমাদের দেশের পলাশরঙা বসন্তোৎসবের মতো। অগুণতি মানুষের সমারোহ। এ বছর সারিবদ্ধ প্রস্ফুটিত গাছের বীথি জনশূন্য।

তবে রিক্ততার চিহ্ন নেই মন্যুষেতর জীবজগতে। পর্দার ফাঁকে দেখি ঝাউগাছ থেকে বেরিয়ে পড়েছে হলুদ গোল্ডফিঞ্চ। গত কাল বৃষ্টিতে একপশলা জল জমেছিল সামনের নিচু ঘাসজমিতে। তাতে দেখলাম দুটো হাঁস দিব্য সংসার পেতেছে। মনে পড়ল, কলকাতার বাড়ির সামনের পুকুরে চঞ্চল পানকৌড়ির ডুবসাঁতার। মনকেমন বাড়ে, ছুঁয়ে থাকে দেশে থাকা বাবা মায়ের উদ্বিগ্ন মুখ, মুঠোফোনে খুঁজি দেশের উর্ধ্বগামী আক্রান্তের সংখ্যা। আর্দ্র শিশিরমাখা ঘাসে তখন নির্ভয়ে লম্বা কানওয়ালা
বাদামি দুই খরগোশ হুটোপাটি করছে। মানুষের এই বিপন্ন সময়ে নির্জনবাস অস্থির হয়ে উঠছে যখন, ব্লু জে পাখির মিষ্টি শিস শব্দহীনতাকে মুখর করে তুলছে খানিক। কাচের ওপারে গাছের ছায়ায় বিষণ্ণতা মেদুর হয়ে উঠছে ক্রমশ। নির্মল রোদ্দুরে চেরিফুলের গুচ্ছে ভারাক্রান্ত পৃথিবীর দ্রুত আরোগ্যের আশা আরও একটু সোনালি হয়ে উঠছে।

(লেখিকা যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তনী)

অন্য বিষয়গুলি:

New York Coronavirus
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy