একটা রাসায়নিক ফর্মুলা! আর তার পিছনে মরিয়া গোটা বিশ্ব। ল্যাবরেটরিতে কিছু মানুষের দিনরাত এক করা চাপা উত্তেজনা, টেস্টটিউব আর কনিক্যাল ফ্লাস্কের ঠুকঠাক শব্দ, আর গোপন বার্তা... ‘‘উপরমহল থেকে ফোন এসেছিল। কাজ কত দূর এগোল?’’
এ কাহিনির শুরু মাস চারেক আগে। ছোটবড় সব দৈনিকেই খবর হয়েছিল, চিনে এক ‘অজানা জ্বরে’ আক্রান্ত অনেকে। প্রথম মৃত্যু হল ৩১ ডিসেম্বর চিনের উহানে। সেই শুরু। এ পর্যন্ত সেই মারণ জ্বর ‘কোভিড-১৯’-এ গোটা পৃথিবীতে প্রাণ হারিয়েছেন ১১,৯৭২ জন। প্যানডেমিক বা অতিমারি ঘোষণা করেছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা। আতঙ্ক গ্রাস করেছে গোটা বিশ্বকে। একাধিক দেশের সরকার বলছে ‘যুদ্ধ-পরিস্থিতি’। অনেকে এ-ও বলছেন, ‘‘এ হল তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ। এ বারের যুদ্ধটা নোভেল করোনাভাইরাসের বিরুদ্ধে।’’
তবে পাশাপাশি একটা অন্য ‘যুদ্ধও’ চলছে, সকলের অলক্ষ্যে। যে দিন থেকে ভাইরাসটি তার জাল ছড়াতে শুরু করেছে, চিন, ইউরোপ ও আমেরিকা নেমে পড়েছে এক অন্য লড়াইয়ে— ‘কে আগে প্রতিষেধক আনবে বাজারে’। ওষুধ প্রস্তুতকারী সংস্থাগুলোর মধ্যে অন্য সময়ে তীব্র রেষারেষি লেগে থাকে। কিন্তু এই পরিস্থিতিতে তারাও পরস্পরকে সব রকম সহযোগিতায় রাজি। যদিও ক্ষমতার লড়াইয়ে রাষ্ট্রনেতারা ভুলতে পারছেন না ‘প্রথম’ হওয়ার স্বাদ। প্রশ্নগুলো ঘুরছে— ভ্যাকসিনের পেটেন্ট পাবে কোন দেশ, বিপুল মুনাফা লুটবে কে! আমেরিকা, ইউরোপ, চিনে ইতিমধ্যেই ক্লিনিকাল ট্রায়াল (গবেষণাগারে তৈরি ওষুধ মানুষের উপরে পরীক্ষামূলক প্রয়োগ) শুরু হয়ে গিয়েছে। বিশেষজ্ঞদের একাংশ আগে থেকেই ভবিষ্যদ্বাণী করছেন, প্রতিষেধক এলেও বাজারে তার জন্য হাহাকার পড়ে যাবে। কারণ যে দেশ তৈরি করবে, তারা আগে দেশের বাসিন্দাদের জন্য প্রতিষেধক নিশ্চিত করে তবে বাজারে ছাড়বে এবং মুনাফা লুটবে।
চিনে অন্তত হাজার জন বিজ্ঞানী ভ্যাকসিন তৈরির চেষ্টা করে যাচ্ছেন। এবং গোটা বিষয়টি চলছে সেনা নিরাপত্তায়। ‘চাইনিজ় অ্যাকাডেমি অব সায়েন্সেস’-এর অধিকর্তা ওয়াং জুনঝির ইঙ্গিতপূর্ণ বার্তা, ‘‘আমরা কারও থেকে পিছিয়ে নেই।’’ ইতিমধ্যেই একটি ছবি ছড়িয়ে পড়েছে ইন্টারনেটে, চিনের ভাইরোলজিস্ট চেন ওয়েই পরীক্ষামূলক ভাবে একটি ইনঞ্জেকশন নিচ্ছেন। এ ছবির সত্যতা নিয়ে অবশ্য প্রশ্ন তুলেছেন অনেকে।
দেশের ওষুধ প্রস্তুতকারী সংস্থাগুলোর সঙ্গে বৈঠক করছেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পও। তাঁর নির্দেশ, আমেরিকার মাটিতেই ভ্যাকসিন তৈরি করতে হবে। শুধু নির্দেশ দিয়েই ছাড়েননি তিনি। শোনা যাচ্ছে, জার্মানির একটি সংস্থাকে ‘ঘুষ’ দেওয়ার চেষ্টাও করেছিলেন তিনি। ব্যাপারটা এ রকম— সম্প্রতি জার্মানির এক সরকারি আধিকারিক দাবি করেন, তাদের দেশের ‘কিয়োরভ্যাক’ নামে একটি সংস্থা ভ্যাকসিনটি প্রায় তৈরি করেছে ফেলেছে। এ কথা জানতে পেরে ট্রাম্প ওই সংস্থার সঙ্গে যোগাযোগ করেন। এবং কয়েকশো কোটি ডলারের বিনিময়ে রিসার্চ-রিপোর্ট কিনতে চান। সংস্থাটি অবশ্য এই খবর অস্বীকার করেছে। কিন্তু জার্মানির তদন্তকারী দলের দাবি, ট্রাম্প যে এ ধরনের প্রস্তাব নিয়ে যোগাযোগ করেছিলেন, সে প্রমাণ তাদের হাতে রয়েছে। ‘ডিয়েভিনি হপ বায়োটেক’ সংস্থার ৮০ শতাংশ অংশীদারি রয়েছে ডিটমার হপের। একটি জার্মান পত্রিকার কাছে তিনি দাবি করেছেন, তাঁর সঙ্গে ট্রাম্পের সরাসরি কথা না হলেও সংস্থার সঙ্গে যোগাযোগ করেছিলেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট। সংস্থার শীর্ষস্থানীয় আধিকারিকেরা সঙ্গে সঙ্গে তাঁকে খবর দেন। হপ বলেছেন, ‘‘আমরা প্রতিষেধক তৈরি করলে, সেই ফর্মুলা বিক্রির কোনও প্রশ্ন নেই।’’ ওই জার্মান সংস্থার খবর প্রকাশ্যে আসতেই ইউরোপিয়ান কমিশন আবার তাদের ৮ কোটি ৫০ লক্ষ ডলার অর্থসাহায্য দিয়েছে বলে শোনা যাচ্ছে। একটি সূত্রের খবর, চিনের এক সংস্থাও নাকি জার্মানির একটি সংস্থাকে ১৩ কোটি ৩৩ লক্ষ ডলারের বিনিময়ে ভ্যাকসিনের মালিকানার অংশীদারি কেনার প্রস্তাব দিয়েছে।
কূটনৈতিক বিশেষজ্ঞরা বলছেন, যে ভাবে দেশগুলো এখন নিজেরা ড্রোন তৈরি করছে, সাইবার-অস্ত্র তৈরি করছে, ঠিক সে ভাবেই তারা ওষুধের জন্য অন্য দেশের মুখাপেক্ষী হতে চায় না। ২০০৯-এ সোয়াইন ফ্লু মহামারির সময়ে অস্ট্রেলিয়া প্রথম প্রতিষেধক আনে। কিন্তু তারা তাদের দেশের নাগরিকদের জন্য ওষুধ নিশ্চিত করে অনেক পরে আমেরিকাকে পাঠিয়েছিল। তাতে ওয়াশিংটনের ক্ষোভের মুখে পড়তে হয়েছিল সিডনিকে। শোনা যায়, ষড়যন্ত্রও চলেছিল। বেকায়দায় পড়তে হয়েছিল অস্ট্রেলিয়াকে। গবেষণার প্রয়োজনীয় সামগ্রী পাঠানো বন্ধ করে দেয় আমেরিকা।
এক সুইস সংস্থার সিইও সেভেরিন শোয়ানের কথায়, ‘‘বিদেশিদের দেব না, প্রতিষেধক শুধু দেশের মধ্যেই থাকবে... রাষ্ট্রনেতাদের এই প্রলোভনে পা দেওয়া উচিত নয় কখনও। তাতে সমূহ বিপদ। বিদেশি রাষ্ট্রগুলো প্রয়োজনীয় সামগ্রী রফতানি বন্ধ করে দেয়।’’
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তী সময়ে পরমাণু বোমা তৈরি নিয়ে অ্যালবার্ট আইনস্টাইনকে প্রশ্ন করা হয়েছিল, ‘‘এত মাথা খাটিয়ে পরমাণুর গঠন আবিষ্কার হয়ে গেল, কিন্তু সেই পরমাণুকে রাজনৈতিক অস্ত্র হওয়া থেকে আটকানো গেল না কেন?’’ জবাবে তিনি বলেছিলেন, ‘‘পদার্থবিদ্যার থেকে অনেক বেশি জটিল রাজনীতি।’’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy