ভারতের সীমান্ত বরাবর হঠাৎ সমরসজ্জা বাড়াতে শুরু করল চিন। প্রত্যেকটি সেনা চৌকিতে সম্প্রতি সৈন্যসংখ্যা বাড়ানো শুরু হয়েছে। বিষয়টি নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করল আমেরিকাও। পেন্টাগনের তরফে এক বিবৃতিতে জানানো হল, ভারতের সীমান্তে চিন যে ভাবে সৈন্যসংখ্যা এবং শক্তি বাড়াচ্ছে, তার দিকে আমেরিকা নজর রাখছে।
চিন অবশ্য শুধু সৈন্যসংখ্যা বাড়িয়েই থামছে না। তিব্বতের দায়িত্বে থাকা প্রাদেশিক বাহিনী টিবেট মিলিটারি কম্যান্ডকে জাতীয় বাহিনীর মর্যাদা দিয়ে তাকে সরাসরি পিপলস লিবারেশন আর্মির অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। গোটা বাহিনীর প্রশিক্ষণ, অস্ত্রশস্ত্র এবং পরিকাঠামোও উন্নত করা হচ্ছে। চিনের সরকারি সংবাদমাধ্যম জানাল, ভবিষ্যতে কোনও যুদ্ধে অংশ নিতে হতে পারে বলেই তিবেট মিলিটারি কম্যান্ডের এই শক্তিবৃদ্ধি করা হল।
সীমান্তে ঠিক কী ভাবে শক্তি বাড়াচ্ছে চিন? গত এক মাসে ভারতের সীমান্ত সংলগ্ন এলাকায় চিন সৈন্যসংখ্যা অনেকটা বাড়িয়েছে। বাড়ানো হয়েছে অস্ত্রশস্ত্র এবং সামরিক পরিকাঠামোও। ভারতের সীমান্ত সংলগ্ন এলাকার দায়িত্বে রয়েছে যে বাহিনী, সেই টিবেট মিলিটারি কম্যান্ডের শক্তি এবং সক্ষমতা দ্রুত বাড়াতে তার মর্যাদা বৃদ্ধি করা হয়েছে। এত দিন টিবেট মিলিটারি কম্যান্ড ছিল একটি প্রাদেশিক মিলিটারি কম্যান্ড, যার দায়িত্বে থাকতেন এক জন লেফটেন্যান্ট জেনারেল। এই প্রাদেশিক কম্যান্ডগুলিকে চিনের পিপলস লিবারেশন আর্মির অংশ হিসেবে ধরা হয় না। ফলে পিপলস লিবারেশন আর্মির অন্তর্গত কম্যান্ডগুলির মতো উন্নত প্রশিক্ষণ, অত্যাধুনিক অস্ত্রশস্ত্র এবং বিপুল সমর পরিকাঠামো এই প্রাদেশিক কম্যান্ডগুলির থাকে না। চিনা প্রেসিডেন্ট শি চিনফিং-এর নেতৃত্বাধীন সেন্ট্রাল মিলিটারি কমিশন এ বার সিদ্ধান্ত নিয়েছে, টিবেট মিলিটারি কম্যান্ড আর প্রাদেশিক বাহিনী হিসেবে কাজ করবে না। এই বাহিনীকে পিপলস লিবারেশন আর্মির স্থলবাহিনীর অন্তর্ভুক্ত করা হচ্ছে। এর ফলে বাহিনীর মর্যাদা বাড়ছে। লেফটেন্যান্ট জেনারেলের বদলে এক জন ফোর স্টার পর্যায়ের জেনারেল এ বার থেকে টিবেট মিলিটারি কম্যান্ডের দায়িত্বে থাকবেন। বাহিনীর প্রশিক্ষণ, অস্ত্রশস্ত্র ও পরিকাঠামো বদলানো হবে। আগের চেয়ে অনেক উন্নত হয়ে উঠবে টিবেট মিলিটারি কম্যান্ড।
চিনের সরকার নিয়ন্ত্রিত সংবাদপত্র গ্লোবাল টাইমসে এই খবর প্রকাশিত হয়েছে। প্রতিবেদনটিতে লেখা হয়েছে, ভবিষ্যতে কোনও যুদ্ধে অংশ নিতে হতে পারে টিবেট মিলিটারি কম্যান্ডকে। সেই কারণেই শক্তি বাড়ানো হচ্ছে।
আমেরিকা চিনের এই আচরণকে মোটেই ভাল চোখে দেখছে না। মার্কিন প্রতিরক্ষা দফতরের ডেপুটি অ্যাসিস্ট্যান্ট সেক্রেটারি তথা দক্ষিণ এশিয়ার দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্তা আব্রাহাম এম ডেনমার্ক স্পষ্ট বলেছেন, ভারতীয় সীমান্তে চিনের সামরিক বাহিনীর সব গতিবিধির উপর আমেরিকা তীক্ষ্ণ নজর রাখছে। যে কোনও আপৎকালীন পরিস্থিতিতে যে ভারতের পাশে দাঁড়াতে আমেরিকা তৈরি, তাও স্পষ্ট করে বলে দেওয়া হয়েছে পেন্টাগনের তরফে।
দেখুন গ্যালারি:
ভারতের সেরা ১২ ক্ষেপণাস্ত্র যা কাঁপিয়ে দেয় প্রতিপক্ষের বুক
তিব্বত চিরকালই চিনের জন্য স্পর্শকাতর এলাকা। তিব্বতকে ঘিরে ভারত-চিন সম্পর্কেও নানা টানাপড়েন এসেছে একাধিক বার। নির্বাসিত তিব্বত সরকারকে হিমাচল প্রদেশের ধর্মশালায় রাজনৈতিক আশ্রয় দিয়েছে ভারত। তিব্বতিদের স্বাধীনতার লড়াইয়ের প্রতিও ভারতের প্রচ্ছন্ন সমর্থন রয়েছ। অন্য দিকে চিন তিব্বতকে বার বার নিজেদের এলাকা বলে দাবি করেছে। সঙ্গে ভারতের অরুণাচল প্রদেশকেও দক্ষিণ তিব্বত নাম দিয়ে নিজেদের এলাকা বলে দাবি করেছে। লাদাখেও সীমান্ত চিহ্নিতকরণ নিয়ে সমস্যা রয়েছে ভারত-চিনের মধ্যে। কখনও চিনের টিবেট মিলিটারি কম্যান্ডের বিরুদ্ধে লাদাখে সীমান্ত লঙ্ঘনের অভিযোগ তুলেছে ভারতের ইন্দো-টিবেটান বর্ডার পুলিশ (আইটিবিপি)। কখনও টিবেটান মিলিটারি কম্যান্ড দাবি করেছে ভারতের আইটিবিপি চিনা এলাকায় অনুপ্রবেশ করেছে।
তিব্বতের সীমান্তে এই সব সমস্যা এবং বিক্ষিপ্ত উত্তেজনা থাকলেও কখনওই সেখানে চিন-ভারত প্রকাশ্য সংঘর্ষে জড়ায়নি। বরং ভারতের অন্য অনেক সীমান্তের চেয়ে তিব্বত সীমান্ত শান্তিপূর্ণ। সেই তিব্বতের মিলিটারি কম্যান্ডকে ভবিষ্যতে যুদ্ধে অংশ নেওয়ার জন্য চিন হঠাৎ প্রস্তুত করছে কেন? তিব্বতের সীমান্তে যুদ্ধ মানে ভারত আর চিনের মধ্যেই যুদ্ধ। কারণ তিব্বত লাগোয়া দেশ বলতে ভারত, নেপাল ও ভুটান। নেপাল, ভুটানের মতো দেশ চিনের সঙ্গে যুদ্ধে জড়াবে, তেমন প্রশ্নই ওঠে না। অতএব তিব্বত সীমান্তে চিনের সঙ্গে সঙ্ঘাতে জড়াতে পারে এক মাত্র ভারত। তাই চিনের টিবেট মিলিটারি কম্যান্ড যখন ভবিষ্যতে যুদ্ধে অংশ নেওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছে, তখন যে প্রস্তুতি যে অবশ্যই ভারতের কথা মাথায় রেখে নেওয়া হচ্ছে, সে ব্যাপারে প্রতিরক্ষা বিশেষজ্ঞরা একমত।
আরও পড়ুন:
পাকিস্তানকে প্রতারক এবং বিপজ্জনক বলে বেনজির আক্রমণে মার্কিন মিডিয়া
প্রশ্ন হল, চিন কেন যুদ্ধের প্রস্তুতি নিচ্ছে? চিন কী ভারত আক্রমণের প্রস্তুতি নিচ্ছে? নাকি ভারত অদূর ভবিষ্যতে আক্রমণ করতে পারে বলে ধরে নিয়ে পাল্টা প্রস্তুতি নিচ্ছে? প্রতিরক্ষা বিশেষজ্ঞদের একাংশের মতে, ভারত যে ভাবে মাউন্টেন স্ট্রাইক কোর তৈরি করে ক্ষিপ্র আক্রমণের জন্য বাহিনী প্রস্তুত করছে, তা চিনকে ভাবাচ্ছে। হিমালয়, কারাকোরাম, হিন্দুকুশ বা পামিরের যে কোনও দুর্গম পার্বত্য এলাকায় আচমকা হামলা চালিয়ে প্রতিপক্ষকে নাস্তানাবুদ করার জন্যই এই মাউন্টেন স্ট্রাইক কোর তৈরির পরিকল্পনা করেছে ভারত। তার সঙ্গে উত্তর-পূর্ব ভারতে রাজ্যগুলিতেও দ্রুত পরিকাঠামোর উন্নতি ঘটাচ্ছে ভারত সরকার। ভারতের তরফে এই প্রস্তুতিকে চিন অশনিসঙ্কেত হিসেবে দেখছে বলে মনে করছেন সমর বিশারদদের একাংশ। সেই কারণেই নাকি চিন টিবেট মিলিটারি কম্যান্ডের শক্তি এবং সক্ষমতা অবিলম্বে বাড়ানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে।
প্রতিরক্ষা বিশেষজ্ঞ তথা ভারতীয় সেনাবাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত অফিসার কর্নেল সৌমিত্র রায় বললেন, ‘‘চিন ভারতকে আক্রমণের প্রস্তুতি নিচ্ছে এমনটা ভাবা ঠিক নয়। চিন সব সময়ই চায় প্রতিবেশী দেশগুলির চেয়ে সামরিক ভাবে অনেক বেশি শক্তিশালী হতে। ক্ষমতা দেখিয়ে প্রতিবেশীদের বশে রাখতে চায় বেজিং। কিন্তু আগ বাড়িয়ে কোনও দেশকে আক্রমণ করার প্রবণতা চিন অনেক আগেই ছেড়ে দিয়েছে। ভারত শক্তি বাড়াচ্ছে দেখলে চিন চুপচাপ বসে থাকবে না। ভারত মাউন্টেন স্ট্রাইক কোর-এর মতো আক্রমণাত্মক বাহিনী তৈরি করলে চিনও যে পাল্টা প্রস্তুতি নেবে, তা স্বাভাবিক। তবে তা মূলত রক্ষণাত্মক ব্যবস্থা। একে চিনের আক্রমণাত্মক পদক্ষেপ হিসেবে দেখা উচিত নয়।’’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy