যা ঘটার ঘটল কয়েক সেকেন্ডে...। প্রকাণ্ড বিস্ফোরণ। মসজিদের মাথা ছাপিয়ে আকাশ ছুঁল আগুনের গোলা। আর তারও উপরে ছিটকে ছড়িয়ে পড়তে দেখা গেল শিশুদের ছিন্নভিন্ন দেহ।
গাজ়া ভূখণ্ডের এমন অসংখ্য ভিডিয়ো ঘুরপাক খাচ্ছে ইন্টারনেটে। গত মাসে যুদ্ধবিরতি শেষ হওয়ার পর থেকে গাজ়া ভূখণ্ডে একটানা হামলা চালিয়ে যাচ্ছে ইজ়রায়েলি বাহিনী (আইডিএফ)। হাজারের উপর মৃত্যু। রাফা অঞ্চল সম্পূর্ণ ধ্বংস করে দেওয়া হয়েছে। জ্বলছে ভূখণ্ডের বিভিন্ন প্রান্ত। ঘরহারা লক্ষাধিক মানুষ। এর মধ্যেই ইজ়রায়েলের দাবি, গত কাল তাদের নিশানা করে দশটি রকেট ছোড়া হয়েছিল গাজ়া থেকে। অতএব এর ‘যোগ্য জবাব’ দিতে হবে। এমনটাই নির্দেশ দিয়েছেন ইজ়রায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেঞ্জামিন নেতানিয়াহু। আমেরিকা সফরে গিয়েছেন তিনি। ওয়াশিংটন রওনা হওয়ার আগে প্রতিরক্ষামন্ত্রী ইজ়রায়েল কাৎজ়কে তিনি বলে গিয়েছেন, গাজ়ায় ‘মারণ অভিযান’ যেন জারি থাকে।
প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশের কথা জানিয়ে আজ একটি বিবৃতি দেয় ইজ়রায়েলি প্রতিরক্ষা মন্ত্রক। আর তার স্বল্প সময় পরেই ইজ়রায়েলি বাহিনী গাজ়ার দের এল-বালা এলাকায় ঘোষণা করে, ‘‘বাসিন্দাদের বলছি... জরুরি ও চূড়ান্ত সতর্কবার্তা, হামলা শুরু হবে।’’ ইজ়রায়েলের অভিযোগ, এই দের এল-বালা থেকেই গত কাল রকেট হামলা চালানো হয়েছিল। পাঁচটি রকেট নিশানায় পড়ার আগেই ধ্বংস করে দেওয়া হয়। বাকিগুলি ইজ়রায়েলের জমিতে পড়ে। এক জন সামান্য জখম হন। আইডিএফ দাবি করেছে, দের এল-বালা অঞ্চলেই হামাসের জঙ্গিরা লুকিয়ে রয়েছে। অতএব এলাকা সাফ করতে হবে। আইডিএফ-এর আরবি-ভাষার মুখপাত্র অ্যাভিচে অ্যাড্রি এক্স হ্যান্ডলে লিখেছেন, ‘যে সব এলাকা থেকে রকেট ছোড়া হয়েছিল, আমরা সেখানে বিধ্বংসী হামলা চালাব... অবিলম্বে এলাকা ফাঁকা করে দিয়ে দক্ষিণে মাওয়াসি এলাকার আশ্রয় শিবিরগুলোতে চলে যান।’
গত কাল সারা রাত গাজ়ায় হামলা চলেছে। কমপক্ষে ৪৪ জন প্রাণ হারিয়েছেন। এর মধ্যে নারী ও শিশুই বেশি। জাবালিয়ার আশ্রয় শিবিরে গোলাবর্ষণ করে আইডিএফ। তাতে ৪ জন মারা গিয়েছেন। দের এল বালার আল-আকসা হাসপাতালে ৭ জনের মৃতদেহ এসে পৌঁছোয়। তার মধ্যে একটি শিশু ও তিন জন মহিলা। গাজ়া সিটির একটি বেকারিতে বিস্ফোরণ ঘটে ৬ জনের মৃত্যু হয়েছে। এদের মধ্যে তিনটি শিশু। হামাসের দাবি, ‘‘বেছে বেছে শিশুদের হত্যা করা হচ্ছে। যাতে পরবর্তী প্রজন্ম বলে আর কিছু না থাকে। ফ্যাসিবাদী নেতারা বর্বরতম উপায়ে জমি দখল করছে।’’
যুদ্ধবিরতি শেষ হওয়া ইস্তক গাজ়ায় যেমন তীব্র হামলা শুরু হয়েছে, তেমনই ত্রাণ ঢোকা বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। ধ্বংস করে দেওয়া হয়েছে পরিস্রুত পানীয় জলের উৎসগুলো। এ সবের পাশাপাশি ওই মৃত্যু-উপত্যকার খবর যাতে বাইরে না-আসে, সেই চেষ্টাও চালিয়ে যাচ্ছে ইজ়রায়েল। অভিযোগ, একের পর এক সাংবাদিককে হত্যা করা হচ্ছে। গত কাল খান ইউনিসে ইসলাম মেকদাদ নামে এক মহিলা সাংবাদিকের বাড়িতে বোমা ফেলা হয়। ঘুমের মধ্যেই তাঁর স্বামী-পুত্র-সহ পরিবারের পাঁচ জন মারা যান। এর পরে খান ইউনিসেই রাতে এক হাসপাতালের সামনে একটি মিডিয়া টেন্টে বিস্ফোরণ ঘটে। তাতে দু’জনের মৃত্যু হয়েছে। এঁদের এক জন সাংবাদিক হেলমি আল-ফাকাওয়ি। দ্বিতীয় জন সাধারণ বাসিন্দা ইউসেফ আল-খাজিন্দর। অন্তত ৬ জন সাংবাদিক জখম হয়েছেন। বেশির ভাগেরই শরীরে ঢুকেছে শ্র্যাপনেল। এঁদের এক জন ইহাব আল-বারদিনির মাথা দিয়ে শ্র্যাপনেল ঢুকে চোখ দিয়ে বেরিয়েছে। আর এক সাংবাদিক আহমেদ মনসুর মারাত্মক ভাবে পুড়ে গিয়ে গিয়েছেন। বাঁচার আশা নেই বলেই জানিয়েছেন চিকিৎসকেরা।
আমেরিকার ‘ওয়াটসন ইনস্টিটিউট ফর ইন্টারন্যাশনাল অ্যান্ড পাবলিক অ্যাফেয়ার্স’ তাদের একটি রিপোর্টে জানিয়েছে, গাজ়ার যুদ্ধে সবচেয়ে বেশি সাংবাদিকের মৃত্যু হয়েছে। প্রথম ও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ, ভিয়েতনামের যুদ্ধ, যুগোস্লাভিয়ার যুদ্ধ কিংবা আফগানিস্তানে আমেরিকার যুদ্ধের মধ্যে সবচেয়ে বেশি সাংবাদিক-হত্যা ঘটেছে গাজ়ায়। ওই রিপোর্টে দাবি করা হয়েছে, ইজ়রায়েলি হামলায় কমপক্ষে ২৩২ জন সাংবাদিক ও সংবাদকর্মীর মৃত্যু হয়েছে। ২০২৩-এর ৭ অক্টোবর থেকে এ পর্যন্ত, প্রতি সপ্তাহে গড়ে ১৩ জন সাংবাদিক মারা গিয়েছেন বলে জানানো হয়েছে।
আজ হোয়াইট হাউসে আমেরিকান প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের সঙ্গে বৈঠকে বসেছিলেন নেতানিয়াহু। মূলত হামাসের হাতে ইজ়রায়েলি পণবন্দিদের মুক্তি এবং ট্রাম্পের নতুন শুল্ক নীতি নিয়েই আলোচনা হওয়ার কথা দুই রাষ্ট্রনেতার মধ্যে। আলোচনা শেষে দুই রাষ্ট্রনেতার ওভাল অফিসে সাংবাদিক সম্মেলনে যোগ দেওয়ার কথাও ছিল। কিন্তু আমেরিকান সংবাদমাধ্যম জানাচ্ছে, আচমকাই সেই সাংবাদিক বৈঠক বাতিল করে দেওয়া হয়েছে। তার কোনও কারণও দর্শানো হয়নি।
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)