গ্রাফিক: সনৎ সিংহ।
একটি গুলি। লক্ষ্য ডোনাল্ড ট্রাম্প। আমেরিকার প্রাক্তন প্রেসিডেন্ট ডান কানে হাত দিয়ে বসে পড়লেন মঞ্চেই। নিরাপত্তারক্ষীরা এসে যখন ট্রাম্পকে তুললেন, দেখা গেল তাঁর কানে, মুখে রক্ত! এই রক্তাক্ত ছবিই কি আমেরিকার আসন্ন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের গতিপথ নির্ধারণ করে দিল? ইতিমধ্যেই তা নিয়ে আলোচনা শুরু হয়েছে সে দেশে। নভেম্বর মাসে আরও এক বার প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে লড়ার আগে ট্রাম্পও বুঝিয়ে দিয়েছেন, তিনি অকুতোভয়— লড়াইয়ের ময়দান ছাড়ছেন না। গুলিকাহত হয়ে মঞ্চ ছাড়ার আগে ডান হাতের মুঠি উপরে তুলে ৭৮ বছরের প্রবীণ রিপাবলিকান রাজনীতিক সমর্থকদের উদ্দেশে বলে গেলেন, “ফাইট, ফাইট!”
ট্রাম্পের উপর এই হামলার ঘটনার পর অবশ্য গোটা আমেরিকাই যাবতীয় মতপার্থক্য দূরে সরিয়ে একজোট হয়ে হিংসার বিরুদ্ধে সরব হয়। আমেরিকার প্রেসিডেন্ট তথা ট্রাম্পের প্রধান রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বী জো বাইডেন জানিয়েছেন, আমেরিকায় এই ধরনের হিংসার কোনও জায়গা নেই। যে ট্রাম্পকে কয়েক দিন আগেই প্রকাশ্য বিতর্কসভা থেকে ‘ফ্যাসিবাদী’, ‘মিথ্যুক’ বিশেষণে বিশেষিত করেছিলেন, সেই ট্রাম্পের উপরে হামলা হওয়ার পরেই প্রতিদ্বন্দ্বীকে ফোন করেন বাইডেন। আক্রান্ত ট্রাম্পও আমেরিকাবাসীকে ‘ঐক্যবদ্ধ’ থাকার বার্তা দিয়েছেন। ঐক্যের সুর অবশ্য কাটে অচিরেই। এই হামলার জন্য পরোক্ষে বাইডেন এবং ক্ষমতাসীন ডেমোক্র্যাটদেরই দায়ী করছেন ট্রাম্পের দলের সমর্থকেরা। যা থেকে মনে করা হচ্ছে, অভিবাসন, বাইডেনের বয়স, ইউক্রেনকে অর্থ সাহায্যের মতো বিষয়গুলি ছাড়াও এই হামলার ঘটনাও আসন্ন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে বড় বিষয় হতে চলেছে।
আগামী ৫ নভেম্বর আমেরিকার প্রেসিডেন্ট নির্বাচন। ট্রাম্প রিপাবলিকান দলের প্রেসিডেন্ট পদপ্রার্থী। শনিবার তাঁর প্রচারসভা ছিল পেনসিলভেনিয়ায়। সেখানেই ঘটে বন্দুকবাজের এই হানা। সমাজমাধ্যমে ওই ঘটনার একাধিক ছবি-ভিডিয়ো ছড়িয়ে পড়ে। তাতে দেখা যায়, মঞ্চে দাঁড়িয়ে ভাষণ দিচ্ছেন ট্রাম্প। উপস্থিত সমর্থকদের কারও কারও হাতে ট্রাম্পের সমর্থনে এবং প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের বিরুদ্ধে পোস্টার ধরা। হঠাৎ পর পর তিনটি গুলির শব্দ শোনা যায়। কথা বলতে বলতে আচমকা ডান কানে হাত দেন ট্রাম্প। কিছু যে ঘটেছে, বুঝতে পেরে মুহূর্তে নিচু হয়ে বসে পড়েন পিছনে দাঁড়িয়ে থাকা সমর্থকেরা। সকলের চোখেমুখে তখন আতঙ্কের ছাপ। ট্রাম্প নিজেও কানে হাত দিয়েই বসে পড়েন। বেশ কিছু ক্ষণ বসেছিলেন ট্রাম্প। মঞ্চেই পোডিয়ামের আড়ালে তাঁকে ঘিরে দাঁড়িয়ে ছিলেন নিরাপত্তারক্ষীরা। কিছু ক্ষণ পরে তাঁকে ধরে আস্তে আস্তে তোলা হয়। ট্রাম্প উঠে দাঁড়ান। দেখা যায়, তাঁর ডান কান থেকে রক্ত গড়িয়ে পড়ছে। মুখেও রক্ত লেগে রয়েছে।
হামলার নেপথ্যে কে?
তদন্তকারী সংস্থা এফবিআই জানিয়েছে, হামলাকারী বছর কুড়ির এক যুবক। নাম মাস ম্যাথিউ ক্রুক। পুলিশ ও নিরাপত্তারক্ষীদের গুলিতে নিহত হয়েছেন তিনি। তাঁর ছোড়া গুলিতে আরও এক ট্রাম্প সমর্থকের মৃত্যু হয়। দু’জন গুরুতর জখম হন। এফবিআই এ-ও জানিয়েছে, পেনসিলভেনিয়ার বেথেল পার্কের বাসিন্দা ক্রুক। যেখানে ট্রাম্পের মঞ্চ বাঁধা হয়েছিল, তার থেকে ১৩০ গজ (১১৯ মিটার) দূরে একটি উঁচু ছাদ থেকে ট্রাম্পকে লক্ষ্য করে একাধিক গুলি ছুড়েছিলেন তিনি। সঙ্গে সঙ্গেই সতর্ক হয়ে যান সিক্রেট সার্ভিস কাউন্টার-স্নাইপার দলের সদস্যেরা। তাঁরা ক্রুককে লক্ষ্য করে পাল্টা গুলি ছোড়েন। তাতেই মৃত্যু হয় যুবকের। সাংবাদিক বৈঠকে এফবিআইয়ের আধিকারিকেরা জানিয়েছেন, এই ঘটনাকে খুনের চেষ্টা হিসাবেই দেখা হচ্ছে। সেই মতোই তদন্ত চলবে।
আততায়ী রিপাবলিকান, মেধাবীও
পেনসিলভেনিয়া স্টেটের ভোটার রেকর্ড বলছে, ম্যাথিউ আদতে ট্রাম্পের দলেরই নথিভুক্ত সদস্য। পিটসবার্গ ট্রিবিউন-রিভিউ নামে একটি জার্নালে দাবি করা হয়েছে, আততায়ী মেধাবী পড়ুয়া হিসাবেই পরিচিত। বেথেল পার্ক হাই স্কুল থেকে ২০২২ সালে স্নাতক হন। ন্যাশনাল ম্যাথ অ্যান্ড সায়েন্স ইনিশিয়েটিভের পক্ষ থেকে সাম্মানিক হিসাবে ৫০০ ডলারের ‘স্টার অ্যাওয়ার্ড’-ও পেয়েছিলেন ক্রুক। ‘নিউ ইয়র্ক টাইমস’ প্রকাশিত ২০২২ সালের একটি ভিডিয়োতে দেখা যাচ্ছে, হাই স্কুলের সমাবর্তন অনুষ্ঠানে অনেকের হাততালির মাঝে কর্তৃপক্ষের হাত থেকে শংসাপত্র গ্রহণ করছেন তিনি। পরনে কালো গাউন, হাসি মুখে ছবিও তুলছেন অন্যদের সঙ্গে।
নিরাপত্তায় গলদ?
ট্রাম্পের সভায় উপস্থিত এক প্রত্যক্ষদর্শী ‘দ্য ওয়াশিংটন পোস্ট’কে জানিয়েছেন, ট্রাম্পের সভার নিরাপত্তা ব্যবস্থা আঁটসাঁটই ছিল। ওই সভায় ঢোকার জন্য অন্তত দীর্ঘ তল্লাশি প্রক্রিয়ার মধ্যে দিয়ে যেতে হয়েছিল সমর্থকদের। ব্যাগও সঙ্গে নেওয়া বারণ ছিল। তবে এত কিছুর পরেও গোড়াতেই যে গলদ ছিল, ট্রাম্পের কান ঘেঁষে গুলি চলে যাওয়াই তার প্রমাণ বলে মনে করছেন অনেকে।
অভিযুক্ত বাইডেন!
যুক্তরাষ্ট্রের বিশিষ্টজনেদের একাংশ সমাবেশের নিরাপত্তা ব্যবস্থা নিয়ে প্রশ্ন তুললেও রিপাবলিকানদের নিশানা সরাসরি বাইডেনের দিকেই। ট্রাম্পের দলের সমর্থকদের বক্তব্য, গোটা নির্বাচনী প্রচার জুড়ে ট্রাম্পের নিন্দা করে গিয়েছেন বাইডেন। তিনি বার বার দাবি করেছেন, ট্রাম্প একজন স্বৈরাচারী তথা ফ্যাসিস্ট, তাই তাঁকে যেনতেনপ্রকারেণ ক্ষমতায় আসা থেকে আটকাতে হবে। বাইডেনের এ হেন উস্কানিমূলক কথাই হিংসায় প্ররোচনা জুগিয়েছে বলে দাবি ট্রাম্প সমর্থকদের।
ট্রাম্প নিজে কী বললেন?
ট্রাম্পের ঘনিষ্ঠমহল সূত্রে জানা গিয়েছে, তিনি সুস্থ রয়েছেন। ঘটনার পর নিজের ‘ট্রুথ’ সমাজমাধ্যমে ট্রাম্প লিখেছেন, “পেনসিলভেনিয়ার বাটলারে গুলিচালনার যে ভাবে মোকাবিলা করেছে আমেরিকার সিক্রেট সার্ভিস এবং পুলিশ বিভাগ, তাদের আমি ধন্যবাদ দিতে চাই। সভায় যিনি নিহত হয়েছেন, তাঁর পরিবারকে সমবেদনা জানাই। যিনি গুরুতর আহত হয়েছেন, তাঁর পরিবারকেও সমবেদনা জানাই।’’ তিনি আরও লিখেছেন, ‘‘এটা ভেবে বিস্ময়কর লাগছে যে, এই ধরনের ঘটনা আমাদের দেশে ঘটতে পারে। আততায়ী মারা গিয়েছেন। তাঁর বিষয়ে কিছুই জানা যায়নি। আমার দিকে গুলি ছোড়া হয়, যা আমার কানের উপরের অংশ ভেদ করে চলে গিয়েছে। অনেক রক্তক্ষরণ হতে থাকে। তখনই বুঝতে পারি, কী হয়েছে। আমেরিকাকে রক্ষা করুন ঈশ্বর।’’ ঘটনার বিবরণ দিয়ে তিনি লেখেন, “শোঁ করে গুলির শব্দ, শুনে বুঝতে পারি কিছু একটা হয়েছে। তার পরেই অনুভব করি চামড়া ছিঁড়ে বেরিয়ে গিয়েছে সেটি।’’
বাইডেন-কমলার বার্তা
ট্রাম্পের উপর হামলার নিন্দা করে এক্সে পোস্ট করেন প্রেসিডেন্ট বাইডেন। তিনি লেখেন, ‘‘পেনসিলভেনিয়ায় ডোনাল্ড ট্রাম্পের সভায় হামলার বিষয়ে আমি শুনেছি। উনি সুস্থ এবং নিরাপদ আছেন শুনে আমি কৃতজ্ঞ। আমি ওঁর জন্য, ওঁর পরিবারের জন্য এবং সভায় উপস্থিত সকলের জন্য প্রার্থনা করছি। ঘটনা সম্পর্কে আরও তথ্য জানার জন্য অপেক্ষা করছি। ট্রাম্পকে উদ্ধার করে নিরাপদ স্থানে নিয়ে যাওয়ার জন্য সিক্রেট সার্ভিসের উপর আমি এবং জিল (জিল বাইডেন, আমেরিকার ফার্স্ট লেডি) কৃতজ্ঞ। আমেরিকায় এই ধরনের হিংসার কোনও জায়গা নেই। আমাদের একজোট হয়ে এর বিরোধিতা করা উচিত।’’ আমেরিকার ভাইস প্রেসিডেন্ট কমলা হ্যারিস এক্সে লেখেন, ‘‘ট্রাম্পের উপর হামলার খবর শুনলাম। উনি গুরুতর জখম হননি শুনে আমি আশ্বস্ত হয়েছি। আমরা ওঁর জন্য, ওঁর পরিবারের জন্য এবং সভাস্থলে উপস্থিত যাঁরা এই অর্থহীন হামলার দ্বারা প্রভাবিত হয়েছেন, তাঁদের জন্য প্রার্থনা করছি।
হামলায় উদ্বিগ্ন মোদী
প্রাক্তন প্রেসিডেন্ট তথা প্রেসিডেন্ট পদপ্রার্থী ট্রাম্পের উপর হামলার ঘটনায় উদ্বেগ প্রকাশ করেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী। ‘বন্ধু’ ট্রাম্পের দ্রুত সুস্থতাও কামনা করেন তিনি। রবিবার সকালে এক্স (সাবেক টুইটার) হ্যান্ডলে মোদী লেখেন, ‘‘আমার বন্ধু আমেরিকার প্রাক্তন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের উপর হামলার ঘটনায় আমি গভীর ভাবে উদ্বিগ্ন। এই ঘটনার তীব্র বিরোধিতা করছি। গণতন্ত্র এবং রাজনীতিতে হিংসার কোনও জায়গা নেই। ওঁর দ্রুত আরোগ্য কামনা করছি। যাঁদের মৃত্যু হয়েছে, তাঁদের পরিবারের জন্য, যাঁরা জখম হয়েছেন তাঁদের জন্য এবং সর্বোপরি আমেরিকার মানুষের জন্য আমার সমবেদনা রইল।’’ লোকসভার বিরোধী দলনেতা এক্সে লেখেন, “আমেরিকার প্রাক্তন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের উপর হত্যার চেষ্টায় আমি গভীর ভাবে উদ্বিগ্ন। এই ধরনের আচরণের কড়া দমন প্রয়োজন। ওঁর দ্রুত এবং সম্পূর্ণ সুস্থতা কামনা করছি।’’
ট্রাম্প-পূর্বসুরীরা কী বললেন?
প্রাক্তন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা লেখেন, ‘‘আমাদের গণতন্ত্রে রাজনৈতিক হিংসার কোনও জায়গা নেই। ঠিক কী ঘটেছে, আমরা এখনও স্পষ্ট করে জানি না। তবে প্রাক্তন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প যে গুরুতর ভাবে জখম হননি, তা জেনে আমাদের আশ্বস্ত হওয়া উচিত। নাগরিক হিসাবে আমাদের রাজনীতিকে আরও সম্মান জানানো উচিত।” আর এক প্রাক্তন প্রেসিডেন্ট জর্জ ডব্লিউ বুশ লেখেন, “ট্রাম্পের উপর এই কাপুরুষোচিত হামলার নিন্দা করছি। তিনি সুস্থ আছেন শুনে আমরা আশ্বস্ত। তৎপরতার জন্য সিক্রেট সার্ভিসের সকল আধিকারিকের প্রশংসা প্রাপ্য।’’
অভূতপূর্ব নয়
ট্রাম্প প্রথম নন। আমেরিকায় ভোটের প্রচারে, রাজনীতিকদের জনসংযোগের সময় গুলি চলেছে আগেও। গুলিবিদ্ধ হয়ে প্রাণ হারিয়েছেন সে দেশের চার-চার জন প্রেসিডেন্ট। ১৮৬৫ সালে প্রেসিডেন্ট থাকাকালীন নিহত হন আব্রাহাম লিঙ্কন। আমেরিকার প্রেসিডেন্ট হওয়ার ছ’মাসের মাথায় গুলিবিদ্ধ হন জেমস গারফিল্ড। দীর্ঘ দিন চিকিৎসার পর মৃত্যু হয়েছিল তাঁর। ১৯০১ সালে বুকে গুলি লেগে মৃত্যু আমেরিকার আর এক প্রাক্তন প্রেসিডেন্ট উইলিয়াম ম্যাককিনলের। ১৯৬৩ সালে গুলিতেই মৃত্যু হয় যুক্তরাষ্ট্রের ৩৫ তম প্রেসিডেন্ট জনএফ কেনেডির। অল্পের জন্য বন্দুক হামলা থেকে রক্ষা পেয়েছিলেন আরও পাঁচ প্রাক্তন প্রেসিডেন্ট—ফ্রাঙ্কলিন ডি রুজভেল্ট, হ্যারি এস ট্রুম্যান জেরাল্ড ফোর্ড, রোনাল্ড রেগান, এবং জর্জ ডব্লিউ বুশ। এই তালিকায় এ বার যুক্ত হল ট্রাম্পের নাম।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy