Advertisement
২২ নভেম্বর ২০২৪
Ahmed Massoud

Ahmad Massoud: ‘সে দিন দেখেছিলাম, বছর বারোর কিশোর আহমদ মাসুদ বাবার সমাধির সামনে বসে আছে চোখ ঢেকে’

ষাট, সত্তরের দশকে যখন ভারতীয়রাও আফগানিস্তান বেড়াতে যেতেন, হিন্দি সিনেমার শুটিং হত, তখন এই পানশের বা পঞ্জশির ছিল ‘ক্রাউড পুলার’।

আহমেদ শাহ মাসুদের সমাধির সামনে তাঁর কিশোর পুত্র।

আহমেদ শাহ মাসুদের সমাধির সামনে তাঁর কিশোর পুত্র। ফাইল চিত্র।

দেশকল্যাণ চৌধুরী
কলকাতা শেষ আপডেট: ০৭ সেপ্টেম্বর ২০২১ ০৫:৫১
Share: Save:

আরিয়ানা এয়ারলাইন্সের বিমানে আমার পাশের সিটে আফগান পরিবারের সঙ্গে কথা বলতে গিয়ে প্রথম শুনি, ‘পানশের’ শব্দটা। এমন সুন্দর জায়গা আমার অবশ্যই দেখা উচিত বলে জানলাম। সাংবাদিক জানতে পেরে আরও অনেক কথা বললেন।

কাবুলের মাটি ছোঁয়ার পর থেকেই টের পেয়েছিলাম শহরের প্রতিটি মানুষ যেন আমার বন্ধু, কারণ, আমি ভারতীয়। আফগান ইমিগ্রেশন অফিসারের হাসিমুখ, টুক করে হাতে তুলে দেওয়া লজেন্স দিয়ে সেই ধারণার শুরু। ষাট, সত্তরের দশকে যখন ভারতীয়রাও আফগানিস্তান বেড়াতে যেতেন, হিন্দি সিনেমার শুটিং হত, তখন এই পানশের বা পঞ্জশির ছিল ‘ক্রাউড পুলার’। চট্টগ্রাম যেমন স্থানীয় ভাবে চাটগাঁ, তেমনই পঞ্জশির এখানে ‘পানশের’। কাবুল শহরের উত্তরে, ঘণ্টা তিনেকের ড্রাইভ। পাহাড়ে ঘেরা উপত্যকা, অদ্ভুত এক নিসর্গ। কাবুলে পৌঁছনোর পর পঞ্জশিরের গল্প শুনতাম সবার মুখে মুখে। একটা বীরগাথার সঙ্গে জড়িয়ে নামটা আসত। তালিবান বিরোধী যুদ্ধের মুখ, নর্দার্ন অ্যালায়ান্সের নেতা আহমদ শাহ মাসুদ, আর তাঁর এলাকা পানশির। তখন ঠিক এক বছর আগে আল-কায়দা জঙ্গিগোষ্ঠীর আত্মঘাতী হামলায় নিহত হয়েছেন মাসুদ। শহরের সর্বত্র মাসুদের ছবি, ওয়াল কার্পেট।

বেশি দিন অপেক্ষা করতে হল না। ৭ সেপ্টেম্বর, ২০০২। আহমেদ শাহ মাসুদের প্রথম মৃত্যু বার্ষিকী। স্মরণ অনুষ্ঠান। প্রেসিডেন্ট হামিদ কারজ়াই বিকেলের দিকে পানশের যাবেন মাসুদের সমাধিতে মালা দিতে। সকাল সকাল বেরিয়ে পড়েছিলাম। আফগানিস্তানে আমি তখন দেড় মাসের পুরনো বাসিন্দা, অল্প কয়েকটা শব্দ বলতে শিখেছি। তার মধ্যে ‘তুশুক্কুর’ প্রধান শব্দ, যার অর্থ ধন্যবাদ। বেশ কাজে দিচ্ছে কথাটা।

দুপুরের দিকে পৌঁছে গেলাম অপূর্ব সেই উপত্যকায়, যেখানে এখন রাতদিন মরিয়া লড়াই চলছে। হাজার হাজার সাধারণ আফগান কালো পতাকা, পোস্টার আর মাসুদের ছবি নিয়ে পাহাড়ের পাড় বেয়ে এগিয়ে চলছেন সমাধি সৌধের দিকে। আমিও চলেছি পাশে পাশে। গাড়ি ছেড়ে দিতে হয়েছে শহরের মুখে। মানুষের ভিড়ে গাড়ি এগোবে না। পাহাড়ের পাথুরে ঢাল বেয়ে এগোতে কষ্ট হচ্ছে, পা হড়কাচ্ছে টুক টাক। সৌধের চারি পাশে নর্দার্ন অ্যালায়ান্সের প্রাক্তন যোদ্ধারা মানব শৃঙ্খল করেছেন। খুব সাধারণ কিন্তু আকর্ষণীয়, গোলাকার স্মৃতিসৌধের ভিতরে তখন বছর বারোর কিশোর আহমদ মাসুদ বাবার সমাধির সামনে বসে আছে চোখ ঢেকে। সেই কিশোর কি ১৯ বছর পর কোন লড়াইয়ের সামনে দাঁড়াতে হবে জানত? হয়তো জানত। সেই কিশোরকে দু’দিন পর কাবুল শহরে দেখলাম, হাজার হাজার মানুষের সামনে চেয়ারে বসে বক্তৃতা দিতে। বক্তৃতার ভাষা আমি বুঝিনি, কিন্তু উপস্থিত বন্দুক কাঁধে আফগান যোদ্ধাদের চোখেও জল দেখেছিলাম সে দিন। খানিকটা অবাক হয়েছিলাম। এখন যখন সেই আহমদ মাসুদকে তালিবানের বিরুদ্ধে যুদ্ধের লড়াইয়ের নেতৃত্ব দিতে দেখছি, তখন একটা অধ্যায়ের সাক্ষী মনে হয় নিজেকে।

যাক, স্মৃতিতে ফিরে যাই, বিকেলের পড়ন্ত বেলায় সপার্ষদ এলেন প্রেসিডেন্ট হামিদ কারজ়াই।

প্রেসিডেন্টকেও বেশ খানিকটা রাস্তা হেঁটেই উঠতে হল। সেই পাহাড়ি পথে ঘটে গেল এক বিপত্তি। হঠাৎই এক ধাক্কায় গড়িয়ে পড়ে গেলাম খানিকটা নীচে। সঙ্গে আমার গাড়ির ড্রাইভার ছিল, ধরে ফেললেন। যিনি ইচ্ছে করে ধাক্কাটা মারলেন, তিনি এক জন সাধারণ আফগান। খুব অবাক হয়ে গেলাম। আমার সব হিসেব গুলিয়ে যাচ্ছে। একটু সময় পর বুঝলাম, পা না ভাঙলেও চোট পেয়েছি। আরও ছবি তোলা মাথায় উঠল। কোনও মতে গাড়ি পর্যন্ত হেঁটে এসে সবে ল্যাপটপ খুলেছি, ছবি পাঠাব বলে, ড্রাইভার সেলিমদা বললেন, একটা ভুল বোঝাবুঝির ধাক্কা খেয়েছি আমি। আমাকে ওই সাধারণ পোশাকে থাকা নিরাপত্তারক্ষী পাকিস্তানের মানুষ ভেবেছিলেন। আমি প্রেসিডেন্টের খুব বেশি কাছে পৌঁছে যাচ্ছিলাম। তাই সামান্য শিক্ষা দিয়েছেন। পরে ক্রমশ দেখেছি, পাকিস্থানের প্রতি সাধারণ আফগানদের নিদারুণ ঘৃণা। মানুষ নিজের অভিজ্ঞতায় খুব সহজ সমীকরণ করে নিতে জানে। সেই সমীকরণ ছিল তালিবান=পাকিস্তান।

সেই মুহূর্তে অবশ্য সমীকরণ নিয়ে এত ভাবিনি। পায়ে ব্যথা যতই থাক, পানশের রাতের অন্ধকারে যে আরও মোহময়। গাড়ি চলছিল। সেলিমদার কাছে পানশেরের লড়াইয়ের ইতিহাস শুনতে শুনতে ফিরলাম কাবুল।

সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy