Advertisement
১৮ নভেম্বর ২০২৪
taliban

Afghanistan: একা মেয়ে দৌড়োচ্ছেন ঊর্ধ্বশ্বাসে! কাবুলের রাস্তা প্রায় মহিলাশূন্য, ক্রমে বিক্রি বাড়ছে বোরখার

অভিযোগ, ২০ লক্ষ মেয়েকে ইতিমধ্যেই স্কুল ছাড়িয়েছে তালিবান। ব্যাঙ্ক থেকে মহিলা কর্মীদের তাড়িয়েছে। বিয়ের বাজারে নিলাম হচ্ছে একরত্তিরা।

তালিবানের হাত থেকে বাঁচতে শহর ছাড়ছেন দলে দলে।

তালিবানের হাত থেকে বাঁচতে শহর ছাড়ছেন দলে দলে।

নিজস্ব প্রতিবেদন
শেষ আপডেট: ১৬ অগস্ট ২০২১ ২২:৩৯
Share: Save:

রান সাহারা রান! দৌড়ও। দৌড়ও। হ্যাঁ, কাবুলের রাস্তা দিয়ে দৌড়চ্ছেন চলচ্চিত্র পরিচালক।

একটু আগেই তিনি ব্যাঙ্কে ছুটেছিলেন। ক্ষমতার পালাবদল হতে চলেছে, খবর পাওয়ামাত্রই বিপদ মাথায় নিয়ে ছুটেছিলেন। যাতে জরুরি পরিস্থিতিতে কিছু টাকা অন্তত হাতে থাকে। কিন্তু ব্যাঙ্কে যখন পৌঁছলেন সাহারা করিমি, তত ক্ষণে কাবুল দখল হয়ে গিয়েছে। জলপাই রঙের জিপে চেপে মেশিনগান উঁচিয়ে শহরে দাপিয়ে বেড়াচ্ছেন তালিবান যোদ্ধারা। বাইরের দৃশ্য দেখেই তড়িঘড়ি শাটার নামিয়ে দেন ব্যাঙ্ককর্মীরা। কোনও রকমে হাতের ব্যাগ টেনে পিছনের রাস্তা দিয়ে বেরিয়ে পড়তে লাগলেন একে একে। ‘‘কিন্তু আমার যে টাকা লাগবে,’’ — মরিয়া হয়ে এক জনকে শুধোলেন পেশায় চলচ্চিত্র নির্মাতা সাহারা। জবাব এল, ‘‘আগে প্রাণে বাঁচুন। তার পর টাকা।’’

উপায় না দেখে অগত্যা বেরিয়ে এলেন সাহারা। কিন্তু বাইরে তখন অন্য দৃশ্য। দুরন্ত গতিতে ছুটে আসা তালিবানের জিপ দেখে যে দিকে দু’চোখ যায়, ছুটছে মানুষ। তখনই ঠাহর হল, রাস্তাঘাটে মহিলা বলতে একা তিনি। সিনেমার লোক বলে এলাকার মানুষ মান্যিগন্যি করেন, কিন্তু শিল্প-সচেতন মানুষ হিসেবে তালিবানের নজরে তিনি ঘোর শত্রু। তাই আগুপিছু না ভেবে প্রাণপণে দৌড় লাগালেন নিজেও। অভ্যাসবশত মোবাইলের ক্যামেরায় কয়েক সেকেন্ডের সেই দৃশ্য বন্দি করে নিয়েছিলেন সাহারা। সেই ভিডিয়োই তালিবানি আফগানিস্তানে মহিলাদের অবস্থার প্রতিচ্ছবি হিসেবে ছড়িয়ে পড়েছে নেট দুনিয়ায়।

শুধু তাই নয়, কাবুলের দখল নেওয়ার ঢের আগেই কন্দহরের আজিজি ব্যাঙ্কে তালিবান-তাণ্ডব চলে বলে অভিযোগ। স্থানীয় সংবাদমাধ্যম সূত্রে খবর, ওই ব্যাঙ্কে কর্মরত ৯ জন মহিলাকে কার্যত ঘাড় দিয়ে ব্যাঙ্ক থেকে বার করে বাড়িতে ঢুকিয়ে দিয়ে আসে তালিবান। ভবিষ্যতে কোনও দিন যাতে কাজে ফেরার ‘দুঃসাহস’ না দেখান, এই বলে তাঁদের হুমকিও দেওয়া হয় বলে অভিযোগ। ব্যাঙ্কের অ্যাকাউন্টস বিভাগে কর্মরত ৪৩ বছরের নুর খতেরা সংবাদ সংস্থা রয়টার্সকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে বলেন, ‘‘কাজ করতে না পারাটা সত্যিই অদ্ভুত লাগছে। কিন্তু এখন এমনই পরিস্থিতি। কিচ্ছু করার নেই।’’ শুধু তাই নয়, কর্মক্ষেত্রে শুধু পুরুষদেরই নিয়োগ করতে হবে বলে ব্যাঙ্ক কর্তৃপক্ষকে তালিবানের তরফ থেকে সাফ নির্দেশ দেওয়া হয়েছে বলেও জানান নুর।

রাস্তা দাপিয়ে বেড়াচ্ছে তালিবান।

রাস্তা দাপিয়ে বেড়াচ্ছে তালিবান। ছবি: রয়টার্স।

রবিবার তালিবানের হাতে কাবুল এসে যাওয়ার পর থেকে নেটমাধ্যমে বিশ্বের তাবড় রাষ্ট্রনেতাদের কাছে একাধিক আর্জি জানিয়েছেন আফগানিস্তানের মানবাধিকার কর্মী-সহ অনেকেই। বিশেষ করে তালিবান রাজত্বে মহিলাদের অবস্থা নিয়ে আন্তর্জাতিক সাহায্যের আর্জি জানিয়েছেন তাঁরা। কিন্তু দেশ-বিদেশের সংবাদমাধ্যমে গত ৪৮ ঘণ্টায় যত ছবি সামনে এসেছে কাবুলের, তাতে রাস্তাঘাটে মহিলাদের অনুপস্থিতি চোখে পড়ার মতো। একমাত্র ব্যতিক্রম অলিগলির বোরখার দোকানগুলি। তাদের রাজত্বে মহিলাদের কী কী শিষ্ঠাচার মেনে চলতে হবে, আগেই তার লিখিত বিজ্ঞপ্তি জারি করে দিয়েছে তালিবান। মাথার চুল থেকে পায়ের নখ পর্যন্ত আবৃত রাখতে বলা হয়েছে সকলকে। তাই খোলা বাতাস ছেড়ে ঘরের কোণে ঢুকে গেলেও, বোরখার প্রয়োজনীয়তা বুঝতে পারছেন আফগান মহিলারা।

কাবুল ইউনিভার্সিটিতে পাঠরত নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক তরুণী সংবাদমাধ্যম ‘দ্য গার্ডিয়ান’-কে বলেছেন, ‘‘রবিবার সকালে ইউনিভার্সিটি যাচ্ছিলাম। গেটের কাছে পৌঁছতেই দেখলাম ডর্মিটরি থেকে ছুটে বেরিয়ে আসছে আমার সহপাঠীরা। জিজ্ঞেস করে জানলাম,, পুলিশ কলেজ খালি করে দিচ্ছে। তালিবান এসে গিয়েছে। বোরখা না পরে থাকলে মহিলাদের মারধর করবে বলে হুমকি দিয়েছে। কিন্তু পালাব কোথায়? রিকশাচালকরাও মেয়েদের দায়িত্ব নিতে রাজি হচ্ছিল না। কাবুলের বাইরে থেকে যারা পড়তে এসেছিল, তারা তো আতঙ্কে সিঁটিয়ে ছিল। কোনও রকমে হস্টেলে পৌঁছই সকলে। এত বছর ধরে অর্জিত স্কুল-কলেজের সমস্ত নথি পুড়িয়ে ফেলতে হবে ভেবেই হাত-পা ঠান্ডা হয়ে আসছে।’’

দেওয়াল টপকে বিমানবন্দরে ঢোকার চেষ্টা।

দেওয়াল টপকে বিমানবন্দরে ঢোকার চেষ্টা। ছবি: রয়টার্স।

২০ বছর আগের তালিবানের সঙ্গে আজকের তালিবানের ফারাক রয়েছে বলে যদিও ইতিমধ্যেই নিজেদের জাহির করতে দেখা গিয়েছে সংগঠনের নেতৃত্বকে। কিন্তু তার পরেও তালিবান পুনরুত্থান-পর্বে মহিলাদের নিয়ে যে সব বিধিনিষেধ সামনে এসেছে, তাতে অশনিসঙ্কেত দেখছেন তথাকথিত তৃতীয় বিশ্বের নাগরিকরাও।

তবে ফতোয়া জারি করেই থেমে নেই তালিবান। সদ্য প্রাক্তন প্রেসিডেন্ট আশরফ গনির বৈধ সরকার থাকাকালীনই গায়ে সেঁটে থাকা পোশাক পরার জন্য বালখ প্রদেশে এক মহিলাকে তালিবান গুলি করে খুন করে বলে অভিযোগ। ২০ বছর আগের তালিবান সরকার নারীশিক্ষা নিষিদ্ধ করেছিল। তার পর আমেরিকার পদার্পণের পর আফগানিস্তানের স্কুলগুলিতে মেয়েদের সংখ্যা বেড়ে ৯০ লক্ষে পৌঁছেছিল। কাবুলের দখল নেওয়ার আগেই তাদের মধ্যে ২০ লক্ষ মেয়েকে স্কুল থেকে নাম কাটিয়ে নিতে তালিবান বাধ্য করেছে বলে অভিযোগ করেছেন সাহারা। বিয়ের বাজারে একরত্তি মেয়েদের নিলামে তোলা হচ্ছে বলেও অভিযোগ।

গ্রাফিক: সনৎ সিংহ।

গ্রাফিক: সনৎ সিংহ।

এমন পরিস্থিতিতে তালিবান মসনদের দখল নেওয়ার পর কাবুলের রাস্তাঘাট প্রায় নারীশূন্য। এ দিক ও দিক গুটিকয়েক বোরখায় ঢাকা অবয়ব যা-ও বা চোখে পড়ছে, শেষ সম্বলটুকু নিয়ে সীমান্ত পেরোতে স্বামীর পিছু নিয়েছেন তাঁরা। এক হাতে ব্যাগপত্র, অন্য হাতে শক্ত করে ধরা ছেলেমেয়ের হাত। অর্থনৈতিক দিক থেকে একটু সম্পন্ন পরিবারের মহিলারা স্বামী-সন্তানের সঙ্গে রওনা দিচ্ছেন হামিদ কারজাই বিমানবন্দরের দিকে। বাকিরা দৌড়চ্ছেন চমন সীমান্তের দিকে। কারণ পেশোয়ার যাওয়ার একমাত্র সড়ক পথটির দখল নিয়েছে তালিবান। তাই পাকিস্তানে ঢোকার একমাত্র রাস্তা এই চমন সীমান্ত।

তবে সেখানেও দুর্ভোগের শেষ নেই। হাজার হাজার লোকের প্রবেশ আটকাতে দরজা বন্ধ করে দিয়েছেন বিমানবন্দর কর্তৃপক্ষ। উপায় না দেখে অযত্নে বসানো কংক্রিটের দেওয়াল এবং তার উপর বসানো পাকানো লোহার কাঁটাতার পেরিয়ে বিমানবন্দরে ঢোকার চেষ্টা করছেন স্থানীয় মানুষ। একই দৃশ্য চমন সীমান্তেও। সেখানে কাঁটাতারের বেড়া পেরিয়ে প্রথমে উঠছেন পুরুষরা। তার পর কোলের সন্তানকে তাঁদের হাতে তুলে দিচ্ছেন মহিলারা। এর পর বাকিদের সাহায্যে, বোরখা সামলে দেওয়ালে ওঠার পালা আসছে তাঁদের। এত ঝক্কি সামলে সীমান্তে পেরতে পারলে তবেই দম ফেলার ফুরসত মিলছে সাময়িক। শুক্রবার পর্যন্ত পাওয়া হিসেব অনুযায়ী, আমেরিকা সেনা সরানোর ঘোষণা করতে মে মাস থেকে কমপক্ষে আড়াই লক্ষ আফগান নাগরিক দেশ ছেড়েছেন। এর মধ্যে ৮০ শতাংশই মহিলা এবং শিশু বলে জানিয়েছেন রাষ্ট্রপুঞ্জের শরণার্থী দফতরের মুখপাত্র শাবিয়া মান্টু।

চমন সীমান্ত সীমান্ত পেরিয়ে পাকিস্তানে আফগানরা।

চমন সীমান্ত সীমান্ত পেরিয়ে পাকিস্তানে আফগানরা। ছবি: পিটিআই।

সীমান্ত পেরিয়ে পালানোর সাহস দেখাচ্ছেন যাঁরা, অর্থনৈতিক ভাবে সুবিধাজনক জায়গায় রয়েছেন বলেই তাঁরা এই পদক্ষেপ করতে পারছেন বলে মত মানবাধিকার কর্মীদের। কাবুল দখলের আগেই মহিলা এবং শিশুদের নিরাপদে সরিয়ে নিয়ে যাওয়ার নির্দেশ দিয়েছিল তালিবান। যাঁরা যেতে পারেননি, আমেরিকার সেনার সাহায্যে কাবুলের একটি পার্কে তাঁদের জন্য অস্থায়ী শিবির খোলা হয়েছে। সেখানে দুধের শিশুকে নিয়ে আশ্রয় নিয়েছেন অনেক মহিলা। খাবারের জোগান নেই বললেই চলে।

সামনে শুধুই অনিশ্চয়তা।

সামনে শুধুই অনিশ্চয়তা। —ফাইল চিত্র।

ইউনিসেফ-এর ফিল্ড অপারেশনের দায়িত্বে থাকা মুস্তাফা বেন মেসাউদের কথায়, ‘‘আফগানিস্তানে এমনিতেই পাঁচ বছরের কম বয়সি প্রতি দু’জন শিশুর মধ্যে এক জন অপুষ্টিতে ভোগে। এখন যা পরিস্থিতি, তাতে এক বেলাও মুখে অন্ন উঠছে না কারও। কোভিডে প্রতি দিন ১০০-র বেশি মানুষ মারা যাচ্ছে। কিন্তু ওই শিবিরগুলির দশা বেশ খারাপ। কোভিড বিধির তো বালাই নেই একেবারেই।’’

সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy