সস্ত্রীক, সপুত্র আবদুল রশিদ শিরজাদ। আমেরিকা যাওয়ার বিমানে। ছবি- টুইটারের সৌজন্যে।
যাদের প্রয়োজনে নিজের প্রাণেরও তোয়াক্কা করেননি কোনও দিন, বিপদে তারাই প্রথম মুখ ঘুরিয়ে নিয়েছিল। মাথা গোঁজার এক টুকরো আশ্রয় দিতে অস্বীকার করেছিল। তালিবদের হাতে প্রাণ যাওয়াটা এক রকম অনিবার্যই হয়ে উঠেছিল আবদুল রশিদ শিরজাদ, তাঁর স্ত্রী ও তিন শিশুপুত্রের। দিন দশেক আগে। তার পর কোনও মতে আমেরিকা পৌঁছন তিনি। কিন্তু কী ভাবে?
মেরে ফেলবে তালিবরা, এই ভয়ে যে ভাবেই হোক কাবুল ছেড়ে আমেরিকায় পালাতে চেয়েছিলেন শিরজাদ। তার জন্য ধর্নাও দিয়েছেন দোরে দোরে। কাবুলে মোতায়েন আমেরিকার সেনাকর্তাদের কাছে। বিশেষ অভিবাসন ভিসা পাওয়ার জন্য। ইমেলের পর ইমেল পাঠিয়েছেন আমেরিকার বিদেশ মন্ত্রকের সংশ্লিষ্ট দফতরে। আমেরিকার এ প্রান্ত থেকে ও প্রান্তে টেলিফোন করে গিয়েছেন মুক্তি পাওয়ার জন্য। ইমেলের জবাব আসেনি। টেলিফোন ধরেননি কেউই। কাবুলে থাকা আমেরিকার সেনাকর্তাদেরও অনেকেই মুখ ঘুরিয়ে নিয়েছিলেন। শিরজাদের পরিত্রাতা হয়েছে শেষমেশ আমেরিকার একটি সংবাদমাধ্যম। সিএনএন।
শিরজাদ যদিও আর পাঁচটা সাধারণ আফগান শরণার্থী ছিলেন না। টানা ৫ বছর তিনি আফগানিস্তানে মোতায়েন আমেরিকার সেনাবাহিনীর প্রধান অনুবাদকের দায়িত্বে ছিলেন।
আফগান সেনাদের সঙ্গে প্রতি মুহূর্তেই যোগাযোগ রেখে চলতে হত আমেরিকার সেনাবাহিনীকে, ন্যাটো জোটের জওয়ানদের। ভাষার সমস্যা হত প্রতি মুহূর্তেই। আর তখনই আমেরিকার সেনাবাহিনীর পরিত্রাতা হয়ে উঠতেন শিরজাদ। বিভিন্ন প্রদেশে ছোটাছুটি করতে হত তাঁকে। আমেরিকার সেনাবাহিনীর সঙ্গে। কখনও কখনও আফগান জঙ্গি সংগঠনগুলির সঙ্গে আমেরিকার জওয়ানদের আলোচনার সময় শিরজাদকেই নিতে হয়েছে বড় ভূমিকা। শিরজাদকে ওই সময় বিভিন্ন পশ্চিমি সংবাদমাধ্যমের সঙ্গেও যোগাযোগ রাখতে হত তাদের খবরাখবর দেওয়ার জন্য।
তাই গত ১৫ অগস্ট কাবুল তালিবদের হাতে চলে যাওয়ার পর থেকেই আফগানিস্তান ছাড়তে মরিয়া হয়ে উঠেছিলেন শিরজাদ। কারণ, বুঝে গিয়েছিলেন দেশে থাকলে মরতে হবে। শিরজাদের কথায়, “ওরা আমাকে তো মারতই। মারত আমার স্ত্রী আর তিনটি শিশুপুত্রকেও।”
স্ত্রী আর শিশুদের নিয়ে গত ২০ অগস্ট কাবুল বিমানবন্দরের কাছাকাছি পৌঁছে গিয়েছিলেন শিরজাদ। কিন্তু ভিড়ের চাপে আর বেশি দূর এগোতে পারেননি। বাড়ি ফিরে আসতে বাধ্য হয়েছিলেন। বিমানবন্দরে ঢুকতে গিয়ে সে দিন পা মচকেছিল শিরজাদের। ভিড়ে প্রায় চাপাই পড়ে যাচ্ছিল তাঁর ৮ বছর বয়সি ছেলে। আর ২ বছরের কনিষ্ঠতম পুত্রটি ওই অসহ্য ভিড়ে রীতিমতো অসুস্থ হয়ে পড়েছিল। সে দিন শিরজাদ আমেরিকার সংবাদমাধ্যম সিএনএন-কে বলেছিলেন, “এখন কেন আমেরিকা মুখ ঘুরিয়ে নিচ্ছে। এখানে থাকলে তো আমাদের মুণ্ডচ্ছেদ করবে তালিবরা। তাই পালাতে চাইছি। অথচ কেউই আমার কথা কানে তুলছেন না।”
২০০৭-এ কাবুলে মোতায়েন আমেরিকার সেনাবাহিনীর ইন্টারপ্রেটার পদে কাজে যোগ দেন শিরজাদ। চুক্তিভিত্তিক চাকরি। পাঁচ বছরের। খুবই দক্ষতার সঙ্গে যে তিনি কাজ করেছিলেন, তার স্বীকৃতি মিলেছে আমেরিকারই কয়েকজন সেনাকর্তার কাছে। কিন্তু পলিগ্রাফ টেস্টের ফলাফল নেগেটিভ হওয়ায় ২০১৩-য় চাকরি যায় শিরজাদের। তার পরেও আমেরিকার সেনাবাহিনীর সঙ্গে ছিল তাঁর নিয়মিত যোগাযোগ।
সেই সূত্রেই ১৫ অগস্টের পর তাঁদের দোরে দোরে ঘুরতে শুরু করেন শিরজাদ। যাতে সেনাবাহিনীতে পাঁচ বছর কাজ করেছিলেন বলে আমেরিকায় বিশেষ অভিবাসন ভিসা পাওয়ার জন্য তাঁর হয়ে সুপারিশ করেন কোনও সেনাকর্তা। কিন্তু তাতেও কোনও কাজ হয়নি।
“তখন অনেক পরিচিত সেনাকর্তাই কিন্তু মুখ ঘুরিয়ে নিয়েছিলেন। পাশে দাঁড়ান অবশ্য কয়েক জন। তাঁরা আমার হয়ে সুপারিশ করেন আমেরিকার বিদেশ মন্ত্রকে। সেই সময় সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দেন কাবুলে কর্মরত সিএনএন-এর সাংবাদিক এবং ওয়াশিংটনে তাঁদের সদর দফতরের কর্তারা। ওঁদের জন্যই শেষমেশ পৌঁছতে পারি ওয়াশিংটনে, গত ২৬ অগস্ট।”
২০ অগস্ট ভিড়ের চাপে বিমানবন্দর থেকে বাড়ি ফিরতে বাধ্য হওয়ার পরেই শিরজাদ সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেন আর দেরি করা যাবে না। যোগাযোগ করেন সিএনএন-এর সাংবাদিকদের সঙ্গে। যাতে যে ভাবেই হোক ৩১ অগস্টের আগে কাবুল ছাড়া যায়। তখন কাবুলে কর্মরত সিএনএন-এর সাংবাদিকদেরও দেশে ফিরিয়ে নিয়ে যাওয়ার তোড়জোড় চলছে। তাঁদেরই সঙ্গে গত ২২ অগস্ট স্ত্রী, শিশুপুত্রদের নিয়ে ভোরের আলো ফোটার আগেই শিরজাদ একটি বড় গাড়ি চেপে পৌঁছে যান কাবুল বিমানবন্দরের দক্ষিণ দিকে ‘ব্যারন’ হোটেলে। সেখানে একটা দিন কাটিয়ে তাঁরা পৌঁছন বিমানবন্দরে। কিন্তু আমেরিকার নৌসেনা জওয়ানরা তাঁদের বিমানে উঠতে বাধা দেন সঙ্গে ভিসা নেই বলে। তার পরেই তার জন্য ঝাঁপিয়ে পড়ে আমেরিকার সংবাদমাধ্যম। ওয়াশিংটন থেকে টেলিফোনের পর টেলিফোন যায় কাবুলে। সাত ঘণ্টা পর শিরজাদ তাঁর পরিবারকে নিয়ে আমেরিকার সেনাবাহিনীর উদ্ধারকারী বিমানে ওঠার অনুমতি পান। ২৪ অগস্ট বাহরিনে আমেরিকার সেনাঘাঁটিতে পৌঁছে একটু স্নান করার সুযোগ পান তিনি আর তাঁর পরিবার। সুযোগ পান একটু ঘুমানোরও। তার পর সেখান থেকে ওয়াশিংটনে পৌঁছন ২৬ অগস্ট।
শিরজাদ ও তাঁর পরিবারকে এখন নিয়ে যাওয়া হয়েছে ভার্জিনিয়ায়। রাখা হয়েছে ফোর্ট লি-তে আমেরিকার সেনাঘাঁটিতে।
শিরজাদ বলেছেন, “আমার কপাল ভাল। শেষমেশ আমেরিকায় পৌঁছতে পেরেছি। তবে এখনও ভিসার বন্দোবস্ত হয়নি। তাই রয়েছি তীব্র অনিশ্চয়তায়। কবে হবে তা-ও জানি না। ক্যালিফোর্নিয়া, টেক্সাসে আমার বন্ধুদের সঙ্গে যোগাযোগ করেছি। ঠিক করেছি ট্রাক চালিয়ে উপার্জন করব। বন্ধুরাও ট্রাকই চালান। তবে মা, বাবার জন্য খুব উদ্বেগে রয়েছি। ওঁদের যে কবে কাবুল থেকে আনতে পারব জানি না।”
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy