অনন্য: কনসার্ট হলের মঞ্চে নোবেল পদক ও ডিপ্লোমা হাতে অভিজিৎ বিনায়ক বন্দ্যোপাধ্যায়। মঙ্গলবার স্টকহলমে। ছবি: শ্রাবণী বসু
চিবুক থেকে ঠিক ছ’ইঞ্চি নীচে কী ভাবে ধরে রাখতে হবে ওয়াইন গ্লাস, এত দিনে রপ্ত করতে পেরেছেন নোবেলজয়ী। অর্থনীতির কঠিন গবেষণার থেকে কম জটিল নয় এই আদবকায়দা মনে রাখার প্রক্রিয়া।
কথা হচ্ছিল অভিজিৎ বিনায়ক বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে। সুইডেনে ভারতের রাষ্ট্রদূত মনিকা মোহতার বাড়িতে বসে। গত কালের নেহাতই একান্ত সেই চা-চক্রে অভিজিৎ জানিয়েছিলেন, নোবেল পুরস্কার প্রদান অনুষ্ঠানের পরে স্টকহলম সিটি হলে নোবেলজয়ীদের জন্য যে-রাজকীয় ব্যাঙ্কোয়েটের আয়োজন করা হয়েছে, তার জন্য রীতিমতো ‘মহড়া’ দিতে হয়েছে তাঁদের। ‘‘বুঝতে পারলাম, খুবই অনুষ্ঠানিক ও রীতিমাফিক
হয় এই ব্যাঙ্কোয়েট,’’ কালই বলেছিলেন অভিজিৎ।
শহরের কেন্দ্রে গ্র্যান্ড হোটেলে রয়েছেন নোবেলজয়ীরা। আজ বিকেলে সেই হোটেলের লবি দেখে মনে হচ্ছিল, এখানে বুঝি বা কোনও ভারতীয় বিয়ের অনুষ্ঠান হচ্ছে। নোবেল পুরস্কার অনুষ্ঠানে পুরুষদের প্রথাগত পোশাক কালো সুট এবং সাদা টাই। কিন্তু অভিজিৎ আজ পরেছেন ঘি-রঙা ধুতি-পাঞ্জাবি এবং কালো গলাবন্ধ কোট। জানা গেল, এই ব্যতিক্রমী পোশাক পরার জন্য নোবেল কমিটির কাছ থেকে বিশেষ অনুমতি নিতে হয়েছে অভিজিৎকে। আর এস্থার দুফলো পরেছেন সবুজ শাড়ি। সঙ্গে কনট্রাস্ট লাল ব্লাউজ। এর আগে মাত্র এক জনই শাড়ি পরে নোবেল মঞ্চে উঠেছিলেন— মাদার টেরিজা। তবে শান্তির নোবেলের সেই অনুষ্ঠান হয়েছিল স্টকহলম নয়, অসলোয়। সে-বছর (১৯৭৯) মাদার টেরিজা অসলোর নোবেল ব্যাঙ্কোয়েটে যোগ দিতে অস্বীকার করেছিলেন। তিনি জানিয়েছিলেন, যে-বিপুল পরিমাণ অর্থ ব্যয় করা হয় এই ধরনের ব্যাঙ্কোয়েটে, তা না-করে বরং দরিদ্রদের সাহায্যে সেটা ব্যবহার করা উচিত। মাদার টেরিজার সেই ইচ্ছেকে সম্মান জানিয়ে সে-বছর অসলোর নোবেল ব্যাঙ্কোয়েট বাতিল করা হয়েছিল।
আরও পড়ুন: রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের নোবেল বক্তৃতা
নোবেল ভোজ
• মূল টেবিলে: ৮৮ জন
• সেই টেবিলে বসছেন এ বছরের নোবেলজয়ীরা
• তাঁদের স্বামী-স্ত্রীরা
• সুইডেনের রাজা-রানি
• তাঁদের ছেলেমেয়েরা
• সুইডেনের মন্ত্রীরা
• নোবেল কমিটির শীর্ষ কর্তারা
• রিক্সব্যাঙ্কের শীর্ষকর্তারা
৭৫ নম্বর আসনে
• অভিজিৎ বন্দ্যোপাধ্যোয়
৬৮ নম্বর আসনে
• এস্থার দুফলো
• রান্না করেছেন: ৪০ জন শেফ এবং তাঁদের সহকারীরা
• পোর্সেলিনের প্লেট-বাটি: ৭ হাজার
• পরিবেশন করেছেন: ৪০০ জন
• বিভিন্ন ধরনের গ্লাস: ৫ হাজার
• টেবিল সাজানো হয়েছে: ফুল ও মোমবাতি দিয়ে
• রুপোর ছুরি-কাঁটা-চামচ: ১০ হাজার
বিকেলে গ্র্যান্ড হোটেলে গিয়ে দেখি, লবিতে বিশাল ‘ক্রিসমাস ট্রি’র চার পাশে ভারতীয় পোশাক পরে ঘোরাঘুরি করছেন অভিজিৎদের আত্মীয়বন্ধুরা। সেখানেই দেখা মিলল অভিজিৎ-এস্থারের সহকর্মী ইকবাল ঢালিওয়ালের সঙ্গে। পভার্টি অ্যাকশন ল্যাবের ইকবালের পরনে ক্রিমরঙা শেরওয়ানি। সঙ্গে স্ত্রী গীতা গোপীনাথ। আইএমএফের অন্যতম শীর্ষ কর্তা গীতা পরেছেন লাল পাড়ের ক্রিম শাড়ি। যুগলে ছবি তোলার সময়ে ইকবাল-গীতার দিকে উড়ে এল রসিকতা— ‘আপনাদেরই তো বিয়ে বলে মনে হচ্ছে!’
স্টকহলমের কনসার্ট হলে নোবেল পুরস্কার প্রদান অনুষ্ঠানের একদম শেষ পর্যায়ে দেওয়া হয় অর্থনীতির পুরস্কার। একে একে পুরস্কার তুলে দেওয়া হল পদার্থবিদ্যা, রসায়ন, চিকিৎসাবিজ্ঞান ও সাহিত্যের নোবেলপ্রাপকদের হাতে। এ পরে পালা অর্থনীতির। তিন পুরস্কারপ্রাপকের নাম ঘোষণার সঙ্গে সঙ্গে মঞ্চে পাশাপাশি দাঁড়ালেন অভিজিৎ, এস্থার এবং মাইকেল ক্রেমার। প্রথমে ঘোষণা করা হল অভিজিতের নাম। সব বিজেতার মতো তাঁর হাতেও পদক ও ডিপ্লোমা তুলে দিলেন সুইডেনের রাজা ষোড়শ কার্ল গুস্তাফ। এর আগে নরওয়ের রাজধানী অসলোয় নোবেল শান্তি পুরস্কার দেওয়া হয়েছে ইথিয়োপিয়ার প্রধানমন্ত্রী আবি আহমেদকে।
আরও পড়ুন: ১৯৯৮: অমর্ত্য সেনের নোবেল বক্তৃতা
স্টকহলমের কনসার্ট হলে পুরস্কার প্রদান অনুষ্ঠান শেষ হলে নোবেলজয়ীদের নিয়ে যাওয়া হল সিটি হলে। সেখানে ‘অ্যাকসেপটেন্স স্পিচ’ দিলেন নোবেলজয়ীরা। তাঁদের সম্মানে সুরাপাত্র তুলে ‘টোস্ট’ করলেন অতিথিরা। সিটি হলের এই ‘গ্র্যান্ড ব্যাঙ্কোয়েট’-এ যোগ দিয়েছেন প্রায় ১৩০০ জন। নোবেলজয়ীরা ছাড়া ছিলেন সুইডেনের রাজা-রানি ও রাজপরিবারের অন্যরা, দেশের সব মন্ত্রী, নোবেল কমিটি ও রিক্সব্যাঙ্কের (১৯৬৯ সাল থেকে যারা আলফ্রেড নোবেলের স্মরণে অর্থনীতিতে নোবেল পুরস্কার দিচ্ছে) শীর্ষ কর্তারা। প্রতি প্রাপককে স্বামী বা স্ত্রী-সহ ১৫ জন অতিথিকে আমন্ত্রণ জানানোর সুযোগ দেওয়া হয়। স্বামী-স্ত্রী হওয়ার সুবাদে দু’জনে মিলে মোট ৩০ জন অতিথিকে আমন্ত্রণ জানিয়েছেন অভিজিৎ ও এস্থার। ব্যাঙ্কোয়েটে থাকছেন অভিজিতের মা নির্মলা ও ভাই অনিরুদ্ধ, এস্থারের পরিবারের কয়েক জন, পভার্টি অ্যাকশন ল্যাবে তাঁদের সহকর্মীরা, তাঁদের প্রকাশক চিকি সরকার। এসেছেন অভিজিতের জেএনইউ-এর দুই বন্ধুও। ‘‘পুরো বাহিনী নিয়ে চলে এসেছি আমরা,’’ হেসে বললেন অভিজিৎ।
প্রথা অনুযায়ী, কনসার্ট হল, সিটি হল-সহ শহরের সব নোবেল সৌধ ও ভবন সাজানো হয় ইটালির সান রেমো শহরের পাঠানো ফুল দিয়ে। এই শহরেই মারা গিয়েছিলেন আলফ্রেড নোবেল। জানা গিয়েছে, এ বছর পাঠানো হয়েছে ২৩ হাজার ফুল। রয়েছে গোলাপ, কার্নেশন, লিলি ও টিউলিপের মতো বিভিন্ন ধরনের বাহারি ফুল। শুধু ব্যাঙ্কোয়েট হল ও সেখানকার টেবিল-চেয়ার সাজাতেই ব্যবহার করা হয়েছে ১০ হাজার ফুল এবং ছ’হাজার পাতা।
নোবেল পর্ব চুকলে কী করবেন? ‘‘লম্বা ছুটিতে যাব,’’ মৃদু হেসে বললেন বাঙালি নোবেলজয়ী।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy