Advertisement
০২ নভেম্বর ২০২৪
Research Scholar

পরিবেশ-রক্ষায় দিশা দুই বাঙালির

এই গবেষণার জন্য রেইসনার সম্প্রতি ইওরোপিয়ান রিসার্চ কাউন্সিল থেকে অনুদান পেয়েছেন। মতিয়ার রহমান এবং শুভজিৎ ভট্টাচার্যের লক্ষ্য, আগামী পাঁচ বছরে এই প্রযুক্তিকে আরও উন্নত করা।

মতিয়ার রহমান এবং শুভজিৎ ভট্টাচার্য।

মতিয়ার রহমান এবং শুভজিৎ ভট্টাচার্য। ফাইল ছবি।

সুজিষ্ণু মাহাতো
শেষ আপডেট: ১২ জানুয়ারি ২০২৩ ০৮:০৭
Share: Save:

কার্বন-ডাই-অক্সাইড ও প্লাস্টিক। বিশ্বের অন্যতম প্রধান দুই বিপদ, উষ্ণায়ন ও দূষণের মূল কারণ এই দু’টিই। এ বার কেবলমাত্র সৌরশক্তির সাহায্যে একযোগে কার্বন-ডাই-অক্সাইড ও প্লাস্টিক থেকে পুনর্ব্যবহারযোগ্য দুই উপাদান তৈরির পথ দেখাল কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষণা। সেই গবেষণায় শামিলদুই বাঙালি, মতিয়ার রহমান ও শুভজিৎ ভট্টাচার্য।

৯ জানুয়ারি ‘নেচার’ পত্রিকার সাব জার্নাল ‘নেচার সিন্থেসিস’-এ প্রকাশিত হয়েছে এই গবেষণা। বর্ধমানের কালনার কদম্বা গ্রামের বাসিন্দা, যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তনী মতিয়ার জানাচ্ছেন, কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক এবং সেন্ট জনস কলেজের ফেলো এরউইন রেইসনারের নেতৃত্বে ‘রেইসনার ল্যাব’-এ তাঁরা এই গবেষণা করেছেন। রেইসনার এই গবেষণাপত্রের মুখ্য প্রণেতা (সিনিয়র অথর) এবং মতিয়ার ও শুভজিৎ যুগ্ম প্রথম প্রণেতা (জয়েন্ট ফার্স্ট-অথর)।

মতিয়ার জানাচ্ছেন, গবেষণার মাধ্যমে তাঁরা একটি রিঅ্যাক্টর তৈরি করেছেন, যাতে সৌরশক্তির মাধ্যমে কার্বন-ডাই-অক্সাইড থেকে তৈরি হবে সিনগ্যাস, যা তরল জ্বালানি তৈরিতে কাজে লাগে। প্লাস্টিকের বোতল থেকে তৈরি হবে গ্লাইকোলিক অ্যাসিড, যা প্রসাধন শিল্পে ব্যবহৃত হয়। সৌরশক্তির সাহায্যে এর আগে প্লাস্টিক ও কার্বন-ডাই-অক্সাইডের পুনর্ব্যবহার নিয়ে গবেষণা হয়েছে। তবে একযোগে দুই ক্ষতিকারক উপাদানের পুনর্ব্যবহারের প্রযুক্তি তৈরি আগে হয়নি বলে জানাচ্ছেন গবেষকেরা। কেমব্রিজ থেকে প্রকাশিত বিবৃতিতে রেইসনার বলেছেন, ‘‘সৌরশক্তি ব্যবহার করে বর্জ্যকে কীভাবে আবার ব্যবহারযোগ্য করা যায় সেটাই ছিল আমাদের গবেষণার প্রধান উদ্দেশ্য। কারণ প্লাস্টিক দূষণ গোটা বিশ্বের সমস্যা। আমরা যে প্লাস্টিক ডাস্টবিনে ফেলি তা আসলে পৃথিবীর বুকে জমতেই থাকে।’’

এই জমে থাকা প্লাস্টিক পাহাড়ই স্কুলজীবন থেকেই দাগ কেটেছিল যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের রসায়ন বিভাগের প্রাক্তনী মতিয়ারের মনে। তিনি বলছেন, ‘‘দৈনন্দিন যে সমস্যাগুলো অনুভব করতাম তা থেকেই এনভায়রনমেন্টাল কেমিস্ট্রি নিয়ে গবেষণার কথা ভাবি। মনে হত প্রতি বছরই যেন গরম আরও বেড়ে যাচ্ছে, নানা জায়গায় দেখতাম প্লাস্টিক ডাঁই হয়ে আছে। ভাবতাম, বিজ্ঞানের মাধ্যমেই এর সমাধান খোঁজা প্রয়োজন।’’

কালনার মহারাজা উচ্চ-বিদ্যালয়ের পর যাদবপুর থেকে রসায়নে স্নাতক। তারপর মাদ্রাজ আইআইটি থেকে এমএসসি করেন মতিয়ার। সুইৎজ়ারল্যান্ডের ইউনিভার্সিটি অফ বার্নে পিএইচডি করার পর কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ে পোস্ট-ডক্টরেট গবেষণায় যোগ দেন ‘মারি কুরি ফেলো’ হয়ে। এখন সেখানেই সিনিয়র সায়েন্টিস্ট হয়ে কর্মরত মতিয়ার। তিনি বলছেন, ‘‘উষ্ণায়নের জন্য অন্যতম দায়ী যে কার্বন-ডাই-অক্সাইড, তাকে অন্য কোনও উপাদানে রূপান্তরিত করতে প্রচুর শক্তির দরকার হয়। কিন্তু এ ক্ষেত্রে কেবল সৌরশক্তির সাহায্যেই তা করা যাবে।’’

গবেষণায় মতিয়ারের সঙ্গী, শুভজিৎ ভট্টাচার্যের স্কুলে পড়াশোনা মেঘালয়ের শিলংয়ে। কলকাতার ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অফ সায়েন্স এডুকেশন অ্যান্ড রিসার্চ থেকে ইন্টিগ্রেটেড স্নাতক-স্নাতকোত্তর পাঠের পর শুভজিৎ কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ে পিএইডি করতে যান। তাঁর কথায়, ‘‘এই প্রযুক্তির সবচেয়ে আকর্ষণীয় দিক হল একে বদলানোর সুযোগ। প্রয়োজন অনুযায়ী অনুঘটকের বদল ঘটিয়ে এর মাধ্যমে অন্য নানা উপাদান তৈরি করা সম্ভব।’’

এই গবেষণার জন্য রেইসনার সম্প্রতি ইওরোপিয়ান রিসার্চ কাউন্সিল থেকে অনুদান পেয়েছেন। তাঁদের লক্ষ্য, আগামী পাঁচ বছরে এই প্রযুক্তিকে আরও উন্নত করা। গবেষকদের আশা, এই প্রযুক্তির আরও বিকাশ ঘটিয়ে সৌরশক্তিচালিত রিসাইক্লিং প্ল্যান্ট তৈরি করা সম্ভব। রেইসনার বিবৃতিতে বলেছেন, ‘‘প্রকৃতিকে রক্ষা করতে ও জলবায়ু বিপদকে ঠেকাতে প্রয়োজন পৌনঃপুনিক অর্থনীতি (সার্কুলার ইকোনমি), যেখানে বর্জ্য দিয়ে পৃথিবী ভরিয়ে না দিয়ে তার থেকে প্রয়োজনীয় উপাদান তৈরি করতে হবে। আর সৌরশক্তির মাধ্যমে তা করা মানে পুরো পদ্ধতিই হবে পরিবেশবান্ধব।’’

গ্রামবাংলার স্কুল থেকে পড়াশোনা করে, বিশ্বের প্রেক্ষিতে গুরুত্বপূর্ণ এমন এক গবেষণায় শামিল হতে পেরে তৃপ্ত মতিয়ারও। তাঁর কথায়, ‘‘স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়, গবেষণা— প্রতিটি ধাপেই নিজেকে ভাল ভাবে তৈরি করতে হবে। ধাপে ধাপে এগিয়ে গেলে কোনও কিছুই অসম্ভব নয়।’’

সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE