আলিপুর আদালতের বাইরে কুণাল। ছবি: স্বাতী চক্রবর্তী।
গায়ের জোরে ঠিক হচ্ছে না। এ বার তাই গলার জোরেই কুণাল ঘোষের ‘কণ্ঠরোধ’-এর পথ নিল পুলিশ। গলা মেলালেন এক দল আইনজীবীও।
শুক্রবার বেলা দু’টো নাগাদ কুণাল ঘোষকে নিয়ে বিচার ভবন চত্বরে ঢোকে সিবিআইয়ের গাড়ি। দেখেই হঠাৎ একসঙ্গে চেঁচিয়ে উঠলেন আদালত চত্বরে হাজির কলকাতা পুলিশের সব কর্মী-অফিসারেরা। ‘হা রে রে রে’ শব্দে তখন গোটা চত্বর গমগম করছে! কুণালের উদ্দেশে সাংবাদিকদের প্রশ্ন চাপা পড়ে গেল তাতে। শোনা গেল না কুণালের কথাও। কুণালকে কোর্ট লক-আপে ঢুকিয়ে তবে চুপ করল পুলিশ।
একা পুলিশে রক্ষা নেই, দোসর আইনজীবী! এর পর ভরা এজলাসে কুণাল আত্মপক্ষ সমর্থনে মুখ খোলার চেষ্টা করতেই চেঁচামেচি জুড়ে দিলেন এক দল আইনজীবী। এক মহিলা আইনজীবী এগিয়ে গিয়ে সরাসরি আপত্তিও জানালেন। সিবিআই সূত্রের খবর, ওই আইনজীবীরা তাদের কেউ নন। বরং ব্যাঙ্কশাল আদালতে তৃণমূল ঘনিষ্ঠ বলেই পরিচিতি রয়েছে তাঁদের।
কুণাল এ দিন অর্থলগ্নি সংস্থাগুলির থেকে শিক্ষামন্ত্রী পার্থ চট্টোপাধ্যায়ের নামে ক্লাবের জন্য পুজোর চাঁদা নেওয়ার অভিযোগ আনতেই ফের চেঁচিয়ে উঠলেন ওই মহিলা। বললেন, “একদম মন্ত্রীদের নাম করবেন না।” সিবিআইয়ের আইনজীবী আপত্তি জানালে তাঁকেও ধমক দেন তিনি। শেষমেশ সিবিআই আদালতের বিচারক অরবিন্দ মিশ্রের নির্দেশে চুপ করেন ওই মহিলা আইনজীবী।
আদালত ও আদালতের বাইরে যে ভাবে কুণাল শাসক দলের নেতা-মন্ত্রীদের বিরুদ্ধে তোপ দাগছেন, তাতে যারপরনাই অস্বস্তিতে পড়েছেন প্রশাসন ও তৃণমূলের কর্তাব্যক্তিরা। তাই এ দিন গোড়া থেকেই কুণালের মুখ বন্ধ করতে ছক কষা হয়েছিল বলে পুলিশ সূত্রের খবর। গত শনিবার কুণাল মুখ্যমন্ত্রীর নাম করে বোমা ফাটানোর পর থেকেই পুলিশ ক্রমাগত তাঁর মুখ আটকানোর চেষ্টা করে চলেছে। এর মধ্যে বিধাননগর পুলিশের ধাক্কায় সিবিআই দফতরে ঢোকার মুখে পড়ে গিয়ে চোট পেয়েছিলেন কুণাল। সে সমালোচনাও সইতে হয়েছে পুলিশকে। লালবাজারের একাংশই বলছেন, এ বার যাতে বিতর্ক এড়িয়েই কুণালের মুখ আটকানো যায়, তার জন্য তারস্বরে চেঁচানোর পরিকল্পনা করা হয়েছিল। কুণাল আদালতে বলেন, “স্যার, ছোটবেলায় শুনেছিলাম, বর্গিরা ‘হা রে রে’ করে চেঁচায়। আজ দেখলাম পুলিশও তেমনটাই করে।”
গত শনিবার মুখ্যমন্ত্রীকে তাঁর মুখোমুখি বসিয়ে জেরা করার আর্জি জানিয়েছিলেন কুণাল। আদালত থেকে ফিরে সল্টলেকে সিবিআই দফতরে ঢোকার মুখে বলেছিলেন, সারদা থেকে সব থেকে বেশি সুবিধা পেয়েছেন মুখ্যমন্ত্রীই। বৃহস্পতিবার আলিপুর আদালতে সুকৌশলে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এবং তৃণমূলের সর্বভারতীয় সম্পাদক মুকুল রায়ের নাম বলেছেন সারদা কেলেঙ্কারিতে ধৃত রাজ্য পুলিশের প্রাক্তন ডিজি রজত মজুমদারও। তার পরে এ দিন কুণালের মুখ আটকাতে কলকাতা পুলিশের অ্যাসিস্ট্যান্ট কমিশনার প্রদীপ দাম, হেয়ার স্ট্রিট থানার ওসি শান্তনু সিংহবিশ্বাস ও বৌবাজার থানার ওসি শান্তনু চট্টোপাধ্যায়ের নেতৃত্বে বিশাল পুলিশবাহিনী মোতায়েন করা হয়।
তবে এত কিছুর পরেও কুণালকে পুরোপুরি আটকাতে পারেনি পুলিশ। এ দিন আদালতে হঠাৎই একটি কাগজ বের করেন তৃণমূলের এই সাসপেন্ড হওয়া সাংসদ। বিচারক প্রশ্ন তোলেন, ওটা কী? কুণাল আদালতে জানান, এটি একটি তথ্য। সারদা তদন্তকারীদের তিনি এটি দিতে চান। কোর্ট লক-আপ থেকে এজলাসে আসার পথেই তিনি এটি হাতে পেয়েছেন।
কুণাল এ কথা বলার পরেই গুঞ্জন শুরু হয়ে যায় এজলাসে। কলকাতা পুলিশের কর্তারা বিচারককে বলেন, এটি আগে থেকেই কুণালের কাছে ছিল। কুণাল পাল্টা প্রশ্ন তোলেন, কোর্ট লক-আপে ঢোকানোর আগে তাঁকে আপাদমস্তক তল্লাশি করা হয়েছিল। তা হলে তখন এটি বাজেয়াপ্ত করা হয়নি কেন? কোর্ট লক-আপে বা এজলাসে আসার পথে তাঁর কোনও আত্মীয় বা পরিচিত দেখা করেননি। কোর্ট লক-আপ থেকে তাঁকে এজলাসে নিয়েও এসেছে পুলিশই। তা হলে ওই কাগজ এল কোথা থেকে?
সিবিআইয়ের একাংশ মনে করছেন, পুলিশেরই কেউ ওই কাগজ (যা আসলে পার্থ চট্টোপাধ্যায়ের ক্লাব নাকতলা উদয়ন সঙ্ঘের ২০১২ সালের পুজোর পাস) কুণালের হাতে পৌঁছে দিয়েছে। কুণাল আদালতে জানিয়েছেন, কলকাতা পুলিশে তাঁর দু’-চার জন বন্ধু-পরিচিত রয়েছেন। তাঁদের কাছ থেকেই কাগজটি পেয়েছেন তিনি। ভরা আদালতে অপদস্থ হয়ে এজলাসেই রীতিমতো ফুঁসতে থাকে পুলিশ।
শুনানি শেষে কুণাল এজলাস ছাড়ার সময় হঠাৎ একটি কাগজের দলা আবার উড়ে আসে সাংবাদিকদের দিকে। এক সাংবাদিক কৌতূহলবশত সেটি কুড়িয়ে নেওয়ার পরেই এক দল পুলিশ ও আইনজীবী ঘিরে ধরেন তাঁকে। রীতিমতো কলার ধরে টানতে টানতে আদালত লক-আপের দিকে নিয়ে যাওয়া হয়। পুলিশ সূত্রের খবর, লক-আপে তিন দফায় তাঁকে জেরা করেন কলকাতা পুলিশ, রাজ্য পুলিশের গোয়েন্দারা। পক্ষান্তরে তিনি-ই যে কুণাল ঘোষকে পুজোর পাসের নথিটি দিয়েছিলেন, তা-ও বলানোর চেষ্টা করা হয়। কিন্তু সফল না হয়ে শেষে ছেড়ে দেওয়া হয় ওই সাংবাদিককে।
বিকেল সাড়ে পাঁচটা নাগাদ আদালত থেকে প্রেসিডেন্সি জেলে নিয়ে যাওয়া হয় কুণালকে। পুলিশের ভ্যান একেবারে সাঁটিয়ে দেওয়া হয় লক-আপের গেটে। কুণালকে যাতে কেউ প্রশ্ন করতে না পারেন, তা-ই ভিড় জমিয়ে গাড়িটি ঘিরে ধরে পুলিশ। লক-আপের গেট থেকে কুণাল বেরোতেই ফের শুরু করা হল চিৎকার। তালে তালে পুলিশ ভ্যানের গায়ে চাপড় মারতে লাগলেন এসি প্রদীপ দাম এবং আরও কয়েক জন অফিসার। তার পর প্রায় ধাক্কা মেরে গাড়িতে তুলে কুণালকে নিয়ে জেলের দিকে রওনা দিল পুলিশ। কলকাতার নগর দায়রা আদালতের প্রবীণ আইনজীবীদের অনেকেই এ দিন মুখ টিপে হেসেছেন। কেউ কেউ বলেছেন, “অনেক বড় বড় মামলা দেখেছি। কিন্তু বন্দির মুখ আটকাতে এমন শিয়ালের মতো সমস্বরে চেঁচাতে হয়নি পুলিশকে।”
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy