পিএইচডি-র মৌখিক পরীক্ষা দিতে ঢুকছেন শিক্ষামন্ত্রী পার্থ চট্টোপাধ্যায়। ছবি: বিশ্বরূপ বসাক
পরীক্ষাটা কার কে জানে!
‘ওরে বাবা, আমি ছাত্র’ বলে-বলে যতই তিনি গলা শুকিয়ে ফেলুন, কেউ না কেউ ‘স্যার’ বলে ফেলছেই।
সাতসকালেই হুড়ুমদুড়ুম করে উত্তরবঙ্গ বিশ্ববিদ্যালয়ে ঢুকে পড়েছিল পুলিশ। মিনিস্টারের সিকিউরিটি বলে একটা ব্যাপার আছে তো, না কি? কিন্তু তার পরেই শিলিগুড়ির পুলিশ কমিশনারের কাছে বার্তা ‘দয়া করে পুলিশ পাঠাবেন না। আমি ওখানে ছাত্র হিসেবে যাচ্ছি।’
আচ্ছা গেরো! মন্ত্রী যাবেন, অথচ পাহারাও দেওয়া যাবে না? হঠাৎ কিছু ঘটে গেলে চাকরিটা থাকবে? কপাল ঠুকে ছেলেছোকরা কর্মীদের সাদা পোশাকে শাল-সেগুনের আড়ালে দাঁড় করিয়ে দেন পুলিশকর্তারা। যাদের দেখে খুব জোর ত্যাঁদোড় ছাত্র বলে মনে হতে পারে, পুলিশ কখনই নয়।
আরও করুণ দশা পরীক্ষকদের। ছাত্র পরিচয়ে যিনি পিএইচডি-র শেষ মৌখিক পরীক্ষা দিতে এসেছেন, তিনি তো যে সে লোক নন, রাজ্যের খোদ শিক্ষামন্ত্রী পার্থ চট্টোপাধ্যায়। বয়স ষাটের উপরে। তাঁকে কী বলে ডাকা হবে? ‘পার্থবাবু’? ভাল শোনাবে? না কি ‘স্যার’? ছাত্রকে ‘স্যার’ বলছেন স্যারেরাই, সেটাই বা কেমন? না কি, কিছুই না? কোনও সম্বোধন ছাড়া খালি ‘আপনি-উনি’ করে যাওয়া?
সোমবার সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত এই দোনামোনা নিয়েই কাটাল গোটা বিশ্ববিদ্যালয়। এত দিন, প্রায় পাঁচ বছর এই পিএইচডি-প্রস্তাব নিয়ে নানা টানাপড়েন চলেছে। বাণিজ্যে স্নাতক, পরে এমবিএ পার্থবাবু যখন ২০০৯-এ যখন গবেষণার প্রস্তাব জমা দেন, তখন তিনি বিধানসভার বিরোধী দলনেতা তথা উত্তরবঙ্গে তৃণমূলের দায়িত্বে। নিয়মের অলিগলি ঘুরে তা যখন শেষ লগ্নে পৌঁছল, তিনি রাজ্যের অন্যতম প্রভাবশালী মন্ত্রী।
পার্থবাবুকে পিএইচডি পাইয়ে দেওয়ার জন্য কোনও প্রভাব খাটানো হয়েছে কি না, তা নিয়েও বহু বিতর্ক হয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের খাতা বলছে, পিএইচডি-র ছাত্রকে যে ৭০ শতাংশ ‘ক্লাস ওয়ার্ক’ করতে হয় তা মন্ত্রী করেছেন। কিন্তু অনেকেরই সন্দেহ যায়নি। বিশ্ববিদ্যালয়-পড়ুয়াদের কয়েক জন তথ্য জানার আইনে চিঠিচাপাটিও করেছেন। সে সবই এখন অতীত।
এ দিন বেলা ২টো নাগাদ পার্থবাবু অর্থনীতি বিভাগে ঢোকেন। মার্চের গোড়াতেই তিনি চার শতাধিক পৃষ্ঠার গবেষণাপত্র ‘ট্রান্সফর্মিং ইন্ডিয়ান ইকনমি ইন টু নলেজ ইকনমি: দ্য রোল অব হিউম্যান রিসোর্সেস উইথ রেফারেন্স টু ইন্ডিয়া’ জমা দিয়েছিলেন। ‘গাইড’ ছিলেন উত্তরবঙ্গ বিশ্ববিদ্যালয়ের অনিল ভুঁইমালি ও যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের বিপুল মালাকার। অনিলবাবু জানিয়ে দেন, “ওঁর গবেষণাপত্র আমরা অনুমোদন করেছি। এ বার বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্মসমিতিতে অনুমোদনের অপেক্ষা।”
এ দিন মৌখিক পরীক্ষা নেন কেরলের একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক গঙ্গাধরণ এবং বর্ধমান বিশ্ববিদ্যালয়ের সোমেন্দ্রকিশোর দত্ত। কিন্তু আর পাঁচ জন গবেষকের মৌখিক পরীক্ষায় যেমন কথাবার্তা হয়, তেমনটা কি হওয়ার জো আছে? বরং পরীক্ষক এবং পরীক্ষার্থী, একে অপরকে কী সম্বোধন করবেন তা নিয়েই গোড়ায় একটা ছোটখাটো গবেষণা হয়ে যায়।
বিশ্ববিদ্যালয় সূত্রের খবর, পার্থবাবু বারবারই বলেছেন, ‘আমি স্টুডেন্ট, আমাকে ছাত্র ভেবেই কথা বলুন।’ কিন্তু খোদ উপাচার্য যাঁকে ‘স্যার’ বলছেন, তাঁকে কোন পরীক্ষক পক্ষে নাম ধরে ডাকবেন? আসলে তিনি ‘স্যার’ না ‘স্টুডেন্ট’? এই নিয়ে যখন তুমুল দোনামোনা, কৌতূহলী সংবাদমাধ্যমের উদ্দেশে এক জন অধ্যাপককে বলতে শোনা যায়, ‘স্যার-স্টুডেন্টকে বিরক্ত করবেন না। প্লিজ, ছবি তুলবেন না।”
তার পর শুধুই পরীক্ষা? মন্ত্রীকে কাছে পেয়েও অধ্যাপক-শিক্ষকেরা অন্য কিছুই বললেন না? ছাত্র জানাচ্ছেন, “পরীক্ষার বাইরেও অনেক কথা হয়েছে। তবে তা একেবারেই ছাত্র-শিক্ষকের মত বিনিময়।” আর তৃণমূল প্রভাবিত সংগঠনের যে শিক্ষাকর্মীরা মন্ত্রীর কাছে খানিক সুখ-দুঃখের কথা বলবেন ভেবে লাইন দিয়েছিলেন? তাঁরা ধমক খেলেন ‘আরে বাবা, আমি তো শিক্ষামন্ত্রী হিসেবে আসিনি! এ সব পরে যখন আসব, তখন হবে।”
পরীক্ষা শেষ।
সাদা ফ্রেঞ্চকাটে তৃপ্তির হাসি। চেনা ভঙ্গিমায় চোখ গোল-গোল করে শিক্ষামন্ত্রী বলেন, “সব আমার মায়ের ইচ্ছে। মা চেয়েছেন বলেই নানা জল্পনাকে পাত্তা না দিয়ে দাঁত কামড়ে পড়ে থেকেছি। অবশেষে সব বাধা কাটিয়ে উতরেও গেলাম।”
আর দিদির ইচ্ছে?
প্রাজ্ঞ নেতার জবাব, “দলনেত্রীকে না জানিয়ে আজ অবধি কোনও কাজ করিনি। উনি সব জানেন।”
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy