নন্দীগ্রামে পুলিশের গুলিচালনার পরের দিনের দুপুর। রাজ্যপাল গোপালকৃষ্ণ গাঁধী তমলুকে জেলা হাসপাতালে আসছেন, খবর হয়েছে। তড়িঘড়ি বেরিয়ে পড়ার আগে ব্যাগ খুলে তমলুকের বেসরকারি হোটেল মালিকের হাতে এক তাড়া নোট ধরিয়ে দিলেন তিনি। মুখে বরাভয়ের ভঙ্গিতে একটা বাক্য “এটা রাখো!”
হোটেল মালিক তখন প্রায় পায়ে পড়েছেন! এতগুলো প্রাণহানির মর্মান্তিক ঘটনার পরে তিনি টাকা নিতে নারাজ। সাংসদ বললেন, আগের দিন থেকে তিনি ও তাঁর দলের সহকর্মী এবং সংবাদমাধ্যমের লোকজন যে ওই হোটেলে ঠাঁই নিয়েছিলেন, তারই কৃতজ্ঞতাস্বরূপ কিছু টাকা রাখতেই হবে। তর্কের অবকাশ না রেখে কালো স্করপিও চেপে রওনা দিলেন তিনি।
সে দিনের সাংসদ জানতেও চাননি, হোটেলের বিল কত হয়েছিল! হাতে ধরে কিছু টাকা তুলে দিয়েছিলেন মাত্র। আজ মুখ্যমন্ত্রী হয়েও মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় জানার চেষ্টা করেন না, খরচ কত হতে পারে! শুধু পুজোর সময় এলে তাঁর দেওয়া উপহারের প্যাকেট পৌঁছে যায় তাঁর প্রশাসনের কর্তা থেকে শুরু করে বহু বিদ্বজ্জন-সহ তাঁর ঘনিষ্ঠ জনেদের কাছে। এ বারও যেমন পৌঁছেছে নামী ব্র্যান্ডের কুর্তা-পাজামা, শাড়ি-সালোয়ার বা কোথাও স্যুট লেন্থ।
কালো স্করপিও-র আরোহী সেই সাংসদের টাকা মেটানো নিয়ে কেউ প্রশ্ন তোলেনি। কারণ, তিনি তখন সাংসদ এবং সেই হিসেবেই বেতন পান। সাদা স্করপিও-য় চেপে পুজোর পর পুজো উদ্বোধন করে চলেছেন যে মুখ্যমন্ত্রী, তাঁর উপহার নিয়ে কিন্তু প্রশ্ন তোলার অবকাশ থাকছে! কারণ, তাঁর নিজেরই ঘোষণামাফিক মুখ্যমন্ত্রী হয়ে গত সাড়ে তিন বছরে তিনি না নিয়েছেন বেতন, না তুলেছেন সাংসদ হিসাবে তাঁর পেনশন!
সাংবাদিকদের উপহার বিলিয়ে কেন্দ্রীয় এক মন্ত্রীকে যখন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর তিরস্কারের মুখে পড়তে হয়, এ রাজ্যে তখন আরও জাঁকিয়ে বসে ‘উপহার সংস্কৃতি’! প্রশ্নটা হঠাৎই প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠেছে অবশ্য দক্ষিণী আম্মার সৌজন্যে! সারদা-কাণ্ড নিয়ে যখন এ রাজ্য তোলপাড়, তখন জয়ললিতার জেল-যাত্রা নিয়ে উত্তাল তামিলনাড়ু এবং গোটা দেশও। আয়ের সঙ্গে সঙ্গতিহীন সম্পত্তি রাখার মামলায় তামিলনাড়ুর মুখ্যমন্ত্রীর চার বছরের কারাদণ্ড এবং ১০০ কোটি টাকা জরিমানা হয়েছে! মুখ্যমন্ত্রী হওয়ার সময়ে যে জয়ার সম্পত্তির পরিমাণ ছিল ২ কোটি ১ লক্ষ টাকা, মেয়াদ শেষে ১৯৯৬ সালে সেটাই বেড়ে দাঁড়ায় ৬৭ কোটিতে। অথচ মুখ্যমন্ত্রী হিসাবে তিনি সরকারি কোষাগার থেকে মাসে ১ টাকা প্রতীকী বেতন নিতেন! তার মানে হিসাব করলে পাঁচ বছরে যাঁর আয় হয়েছে সাকুল্যে ৬০ টাকা, ওই সময়ে তাঁর সম্পত্তি হয়েছে ৬৬ কোটি টাকার!
দক্ষিণের আম্মা তবু মাসে ১ টাকা বেতন নিতেন। বঙ্গের দিদি সরকারি কোষাগার থেকে এক পয়সাও নেন না! তা হলে এমন অবৈতনিক মুখ্যমন্ত্রীর ঢালাও উপহারের খরচ কোথা থেকে আসে? কে মেটায়? গুঞ্জন, কৌতূহল উড়ে বেড়াচ্ছে শারদীয়া বাতাসে!
নবান্নের খবর, ২০১১ সালের মে মাসে ক্ষমতায় আসার পরেই মমতা জানিয়েছিলেন, তিনি সরকারের থেকে বেতন নেবেন না। সরকারি নিয়ম মেনে প্রতি মাসে তাঁর নামে বেতনের চেক তৈরি করে কলকাতা ট্রেজারি। কিন্তু মুখ্যমন্ত্রী তা প্রত্যাখ্যান করার পরে সেই চেকটি ট্রেজারি আবার নষ্ট করে দেয়। গত ৪০ মাস ধরে এমনই চলছে। অথচ এই ৪০ মাসেই পাল্লা দিয়ে বেড়ে চলেছে মুখ্যমন্ত্রীর উপহারের বহর! তৃণমূল সূত্রের খবর, মুখ্যমন্ত্রীর ঘনিষ্ঠ কিছু মন্ত্রী-নেতা, সাংসদ-বিধায়ক, টলিউড ব্যক্তিত্ব, ব্যবসায়ী এবং সাংবাদিকেরাও আছেন প্রাপকের তালিকায়। সরকারের বিভিন্ন দফতরের সচিব, জেলাশাসক, পুলিশ-কর্তা, এসপি এবং তাঁদের স্ত্রীরাও আছেন। সঠিক সংখ্যা কেউ না জানাতে পারলেও তালিকা কিন্তু খুব ছোট নয়! ঘনিষ্ঠদের মতে, দু-তিন হাজারও হতে পারে! শুধু ঘনিষ্ঠ জনই নয়, প্রতি বছর পুজোর সময় নিয়ম করে বৃদ্ধাবাসে জামাকাপড় পাঠিয়ে থাকেন মমতা। এ বারও তার অন্যথা হয়নি। সোমবারই একটি বৃদ্ধাবাসে পৌঁছেছে তাঁর উপহার। পুজোর মরসুমে তাঁর গাড়িতে রাখা থাকে বিভিন্ন বয়সের উপযোগী জামাকাপড়। পথচলতি কাউকে দেখে মনে হলেই মমতা কিছু দিতে কার্পণ্য করেন না। শুধু নিকট বৃত্ত নয়, বহু অনাথ-আতুর এই ভাবেই মমতার উপহার পেয়ে থাকেন।
মুখ্যমন্ত্রী বলে নয়, ব্যক্তি মমতা নিজেই বরাবর উপহার দিতে ভালবাসেন। সেই বিরোধী নেত্রী বা রেলমন্ত্রী থাকার সময়েও তাঁর পছন্দের এবং ঘনিষ্ঠ লোকেদের হাতে প্রীতি-উপহার তুলে দিতেন তিনি। শুধু পুজোর মরসুম বলেই নয়, তাঁর ঘনিষ্ঠদের ব্যক্তিগত জীবনের স্মরণীয় দিনেও পৌঁছে গিয়েছে মমতার উপহার। তবে মুখ্যমন্ত্রী হওয়ার পরে তাঁর ঘনিষ্ঠ মহল যত কলেবরে বেড়েছে, উপহারও তত বেড়েছে! বিরোধী নেত্রী থাকার সময়ে মমতা ব্যাখ্যা দিয়েছিলেন, তাঁর নিজের খরচা বলতে বিশেষ কিছু নেই। সাংসদ হিসাবে বেতনের টাকা সঞ্চয় করে যা ব্যাঙ্কে আছে, তা থেকেই সামান্য উপহার দিয়ে থাকেন। কিন্তু এখনকার প্রশ্ন, কলসির জল গড়াতে গড়াতে এক দিন তো ফুরোবে! আয় না থাকলে কুবেরের ধনও ফুরোয়! অন্নপূর্ণা মুখ্যমন্ত্রীর উপহারের স্রোত তা হলে চলতেই থাকছে কী ভাবে?
স্বাভাবিক ভাবেই মমতার প্রশাসন বা দলের কেউ এই নিয়ে মুখ খুলতে নারাজ। প্রতি বছর উপহার প্রদানের এই প্রক্রিয়ায় বড় ভূমিকা থাকে কলকাতার মেয়র শোভন চট্টোপাধ্যায়ের। তিনিও মুখ খোলেননি।
তৃণমূলের এক নেতা অবশ্য বলছেন, “উপহার দিতে দিদি কোনও দিনই কার্পণ্য করেননি। বই লিখে রয়্যালটি বাবদ কিছু টাকা পান। সে সব দিয়ে উনি চালিয়ে নেন।” আর রাজ্য সরকারের এক আধিকারিকের কথায়, “ভেবে দেখতে গেলে, যিনি বেতন নেন না, তাঁর পক্ষে হাওয়াই চটিও কেনা সম্ভব নয়! কিন্তু মুখ্যমন্ত্রী ভালবেসে কিছু উপহার দেন। কোথা থেকে দেন, সে সব নিয়ে ভাবিনি কখনও!”
শাসক দলেরই একটি অংশের বক্তব্য, দলেই তাঁর ঘনিষ্ঠ কয়েক জনকে উপহার কেনার দায়িত্ব দেন মুখ্যমন্ত্রী। এ বারেও তার অন্যথা হয়নি। তবে সেই ঘনিষ্ঠদের টাকার উৎস কী, সেই প্রশ্নের জবাব অজানা!
দান-খয়রাতির জন্য রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী অবশ্য ইতিমধ্যেই নাম কুড়িয়েছেন। ক্ষমতায় আসার পরে তাঁর সরকার রাজ্য জুড়ে নানা নামে উৎসবের মেলা বসিয়ে দিয়েছে। তাঁর সরকারের দাক্ষিণ্য পেয়ে চলছে কয়েক হাজার ক্লাব। প্রতি বছর একাধিক নামে পুরস্কারও চালু করে দিয়েছেন মুখ্যমন্ত্রী। সব মিলিয়ে সরকারের পরিকল্পনা ও পরিকল্পনা বহির্ভূত খাত থেকে ফি-বছর কয়েকশো কোটি টাকা খরচ করা হচ্ছে। একই ভাবে চলছে তাঁর নিজস্ব উপহার সংস্কৃতি। বিরোধী শিবিরের এক নেতার কথায়, “কষ্টের সংসার বলে রোজ আক্ষেপ করেন যিনি, তিনিই ক্লাবকে লক্ষ লক্ষ টাকা অনুদান দেন। যিনি নিজে রোজগারহীন, তিনি দিব্যি উপহার দেন।”
দিল্লিতে তাঁর সরকারের এক মন্ত্রীর উপহার-সংস্কৃতির কথা জানতে পেরে রীতিমতো রুষ্ট হয়েছেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী। দিল্লিতে সম্প্রতি এক সাংবাদিক সম্মেলনে ‘সৌর লন্ঠন’ উপহার দিয়েছিলেন কেন্দ্রীয় বিদ্যুৎ ও কয়লামন্ত্রী পীযূষ গয়াল। জানতে পেরে মন্ত্রিসভার বৈঠকে সকলের সামনেই পীযূষকে সতর্ক করে দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী।
বাংলায় সে সবের প্রশ্ন নেই! স্বয়ং মুখ্যমন্ত্রী বিলোচ্ছেন। কারণ, বিলোতে তিনি ভালবাসেন।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy