বড় শিল্পের দেখা নেই। ক্রমশ কমছে ছোট এবং মাঝারি শিল্পও। যত দিন যাচ্ছে ভাটার টান ততই প্রবল হচ্ছে রাজ্যের শিল্প চিত্রে।
বিবর্ণ ভাবমূর্তি আর নতুন সরকারের জমি নীতির কারণে বড় লগ্নি রাজ্য থেকে মুখ ফিরিয়েছে। এই পরিস্থিতিতে ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পের উপরে জোর দেওয়ার কথা বলেছে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সরকার। খোদ মুখ্যমন্ত্রীর হাতে থাকা ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প দফতর ঢাকঢোল পিটিয়ে আলাদা নীতি ঘোষণা করেছে। আয়োজন করেছে শিল্প সম্মেলনের। কিন্তু সংশ্লিষ্ট মহল বলছে, এই ক্ষেত্রের নাড়ির গতি মোটেই ভাল নয়।
কোনও রাজ্যে ছোট ও মাঝারি শিল্পের হাল কেমন তা বোঝার একটা উপায় কারখানায় যন্ত্রপাতির গতি নিয়ন্ত্রণে ব্যবহৃত বিশেষ বৈদ্যুতিন পরিচালন ব্যবস্থা প্রোগ্রামেবল্ লজিক কনসোলের (পিএলসি) চাহিদা কেমন, তার উপরে নজর রাখা। হস্তচালিত তাঁতের মতো সামান্য কিছু মান্ধাতার আমলের ব্যতিক্রম ছাড়া বাকি প্রায় সব যন্ত্র চালাতে এই পিএলসি ব্যবহৃত হয়। দেখা যাচ্ছে, এ রাজ্যে তার বাজার কমছে হুহু করে। শিল্প মহল বলছে, বড় শিল্প না-থাকাটা এই যন্ত্রের চাহিদা কমার একটা কারণ। ছোট ও মাঝারি শিল্পের বাড়বাড়ন্ত সেই ক্ষতিটা পূরণ করতে পারত। কিন্তু খরা সে দিকেও।
ছোট ও মাঝারি শিল্পের বেহাল দশার দ্বিতীয় ইঙ্গিত, ইস্পাত তৈরির কাঁচামাল ঢালাই লোহার চাহিদা কমছে দিনকে দিন। সে ভাবে বিকোচ্ছে না রাস্তা ও ইস্পাত তৈরিতে ব্যবহৃত রাসায়নিকও। শিল্প ও বণিক মহল বলছে, এটাই স্বাভাবিক। বড় শিল্প ছাড়া ছোট ও মাঝারি শিল্পকে বাঁচিয়ে রাখা যায় না। বড় লগ্নি এলে তার সহায়ক এবং পরিপূরক হিসেবেই গড়ে ওঠে এই ধরনের শিল্প। এক মাঝারি শিল্প কর্তার মন্তব্য, “পশ্চিমবঙ্গে ইদানীং যা হচ্ছে তা গোড়া কেটে আগায় জল দেওয়ার সামিল।” বড় শিল্প না থাকায় ছোট ও মাঝারি শিল্প বরাত পাচ্ছে না। তাদের হয় তাকিয়ে থাকতে হচ্ছে অন্য রাজ্যের বরাতের দিকে। না হয় কর্মী ছাঁটাই করে ক্রমশ গুটিয়ে আনতে হচ্ছে ব্যবসা। আর যাদের সামর্থ্য আছে, তারা পাড়ি দিচ্ছে ভিন্ রাজ্যে।
এ রাজ্যে পিএলসি তৈরি করে বেশ কিছু ছোট-মাঝারি সংস্থা। তেমনই একটি সংস্থার হিসেব বলছে, ২০১০-’১১ সালে তাদের মোট বরাতের ৭০ শতাংশই আসত এ রাজ্য থেকে। কিন্তু এখন উৎপাদনের ৮২ শতাংশই ভিন্ রাজ্যে বিক্রি করতে হচ্ছে তাদের। ২০১৩-’১৪ সালে তারা উৎপাদনের ৬৫% এ রাজ্যে বিক্রি করেছিল ঠিকই। কিন্তু সেটা হয়েছিল কয়েকটি সংস্থার দীর্ঘদিন থমকে থাকা সম্প্রসারণ প্রকল্প চালু হওয়ার দৌলতে। এই ছবি শুধু কোনও নির্দিষ্ট সংস্থার নয়, রাজ্যের প্রায় সব পিএলসি নির্মাতারই।
একই দশা ফাউন্ড্রি শিল্পেরও। ইস্পাত সংস্থায় কাঁচামাল সরবরাহকারী যে সংস্থা ২০১০-’১১ সালে ৮,৭০০ টন ঢালাই লোহা তৈরি করত, ২০১৩-’১৪ সালে তারা তা কমিয়ে করছে ৭,৫০০ টন। নতুন শিল্প তো দূরস্থান, রাজ্যের চালু ইস্পাত কারখানাগুলিতেও চাহিদা কমাই এর কারণ বলে সংস্থাটির দাবি।
ইস্পাত ও রাস্তা তৈরির কাজে ব্যবহৃত বিশেষ রাসায়নিক তৈরি করে কলকাতার এক সংস্থা। তাদেরওঅভিযোগ, রাজ্যে ইস্পাত শিল্পের দশা এমনিতেই করুণ। তার উপর জমি-জট আর সিন্ডিকেটের দাপটে বিভিন্ন রাস্তা ও উড়ালপুল নির্মাণের কাজ বছরের পর বছর থমকে থাকায় তাদের রাসায়নিকের চাহিদা তলানিতে। অবস্থা এমনই যে, সংস্থাটির বছরে যা আয়, এখন ধারই তার অর্ধেকের বেশি। ভিন্ রাজ্যে কারখানা সরিয়ে নিয়ে যাওয়ার সংস্থান না-থাকায় অগত্যা কর্মী ছাঁটাইয়ের কথা ভাবতে হচ্ছে তাদের।
রাজ্যের নিজস্ব চাহিদা অদূর ভবিষ্যতে না-বাড়লে অন্যান্য কারখানাকেও হয় কর্মী সঙ্কোচন, না হয় ভিন্ রাজ্যে চলে যাওয়ার কথা ভাবতে হবে বলে শিল্প মহলের মত। কারণ, শুধু বাইরের বাজারের উপর নির্ভর করে দীর্ঘ মেয়াদে এ ধরনের ব্যবসা লাভজনক রাখা শক্ত। ভিন্ রাজ্যে পণ্য বেচতে পণ্য পরিবহণের বাড়তি খরচ গুনতে হয়। সেই ট্যাঁকের জোর অনেকেরই নেই। তা ছাড়া, বরাত দেওয়ার ক্ষেত্রেও অনেক সময়ই স্থানীয় সংস্থাকে অগ্রাধিকার দেয় বড় শিল্প। কারণ, তাতে পরে রক্ষণাবেক্ষণ সংক্রান্ত পরিষেবা পেতে সুবিধা হয়। এই সব বাধাবিপত্তি কাটিয়ে লাভজনক দরে ভিন্ রাজ্যের বড় শিল্পের কাছে পণ্য সরবরাহ করা বেশ কঠিন। টিকে থাকার তাগিদে ইতিমধ্যেই গুজরাতের দিকে পা বাড়িয়েছে কিছু বৈদ্যুতিন যন্ত্রাংশ নির্মাণকারী সংস্থা। আর যাদের সেই সঙ্গতি নেই, তারা ভাবছে কর্মী ছাঁটাইয়ের কথা।
কিছু দিন আগেও রাজ্যে ফেরার কথা ভাবছিল এক সময় কলকাতা থেকে দক্ষিণ ভারতে কারখানা সরিয়ে নেওয়া একটি খাদ্য প্রক্রিয়াকরণ সংস্থা। কিন্তু কলকাতার অদূরে জমি থাকা সত্ত্বেও প্রশাসনিক সমস্যা আর রাজনৈতিক চাপের মুখে সেই ভাবনা আপাতত মুলতুবি রেখেছে তারা। আর একটি কৃষি যন্ত্রাংশ নির্মাণ সংস্থার কর্তা জানাচ্ছেন, গত তিন-চার বছরে তাঁদের ব্যবসার মূল বাজার পশ্চিমবঙ্গ থেকে সরে গিয়েছে অসম, ওড়িশার মতো রাজ্যে। তার উপর কলকাতার কারখানায় নিজেদের লোক নেওয়ার পাশাপাশি পার্টি অফিস গড়ে দেওয়ার জন্যও চাপ দিচ্ছে শাসক দলের কর্মীরা। ফলে ভিন্ রাজ্যে কারখানা সরানোর কথা ভাবছেন তাঁরা।
রাজ্য সরকার বারবার ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পে জোয়ার আসার দাবি করলেও ছবিটা এমন কেন, সেই প্রশ্নের জবাব মেলেনি। ফোন ধরেননি শিল্পমন্ত্রী অমিত মিত্র। জবাব দেননি এসএমএসেরও।
অন্য দিকে, রাজরোষে পড়ার ভয়ে নাম বলতে না-চাইলেও, অনেক শিল্পকর্তাই মনে করেন, সার্বিক ভাবেই শিল্পের পরিবেশ নেই রাজ্যে। সিঙ্গুরকে কেন্দ্র করে যে অরাজক অবস্থা তৈরি হয়েছিল, সেই ধারা এখনও চলছে। তার সঙ্গে যোগ হয়েছে তোলাবাজি আর অবাঞ্ছিত রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ। শিল্পমহলের মতে, এই সমস্যা যে আগেও ছিল না, তা নয়। কিন্তু ক্রমশ যেন তা মহামারীর আকার নিচ্ছে। তাদের আরও অভিযোগ, নিচুতলার কর্মীদের উপর শাসক দলের নিয়ন্ত্রণ প্রায় নেই। তার উপর রয়েছে জমি-জট। মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা হয়ে দাঁড়িয়েছে প্রবেশ কর চাপানো কিংবা যুক্তমূল্য কর (ভ্যাট) বৃদ্ধির মতো সিদ্ধান্ত। সব মিলিয়ে, খোলনলচে না-পাল্টালে বড় শিল্পের মতো ছোট ও মাঝারি শিল্পও ক্রমশ বিদায় নেবে এ রাজ্য থেকে। তাদের জন্য ঘটা করে আলাদা নীতি তৈরি করে দেখনদারি ছাড়া কাজের কাজ কিছুই হবে না।
যে প্রদীপে তেলই নেই, তার সলতে পাকিয়ে লাভ কী!
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy