Advertisement
২৬ নভেম্বর ২০২৪
আমার পড়শি

পুজোর অনুষ্ঠানে আমার পড়শিরাই শিল্পী

এখন যেখানে আছি, সেটা সোনাতোড় পাড়া। সিউড়ি বাসস্ট্যান্ডে এ বাড়ির পিছনেই বাবা আমাকে একটা বাড়ি দিয়ে গিয়েছিলেন। পরে, আমরা সামনে এই নতুন বাড়ি করলাম। সেই পাঁচ বছর বয়স থেকে গান-বাজনার সঙ্গে জড়িয়ে আছি। কবেকার সব কথা। পড়শির কথা লিখতে বসে, কেবল সাবেক সিউড়ির কথা মনে পড়ছে। তখন খুব ছোট আমি। সিউড়ি তখন অন্যরকম।

স্বপ্না চক্রবর্তী
শেষ আপডেট: ০৮ নভেম্বর ২০১৫ ০১:৪৯
Share: Save:

এখন যেখানে আছি, সেটা সোনাতোড় পাড়া।

সিউড়ি বাসস্ট্যান্ডে এ বাড়ির পিছনেই বাবা আমাকে একটা বাড়ি দিয়ে গিয়েছিলেন। পরে, আমরা সামনে এই নতুন বাড়ি করলাম।

সেই পাঁচ বছর বয়স থেকে গান-বাজনার সঙ্গে জড়িয়ে আছি। কবেকার সব কথা। পড়শির কথা লিখতে বসে, কেবল সাবেক সিউড়ির কথা মনে পড়ছে। তখন খুব ছোট আমি। সিউড়ি তখন অন্যরকম। ষাট-সত্তর দশকে এক শিল্পী অন্য শিল্পীকে সমীহ করতেন। জেলার শিল্পীদের মধ্যে একসঙ্গে বসে গান-বাজনার রেওয়াজ ছিল। পরস্পরের মধ্যে কোনও হিংসা ছিল না। সকলে সকলের খবর রাখতেন। খানিকটা হলেও কমে আসছে সে আদত!

পড়শি তো শুধু পাশের বাড়ির মানুষ নন, পাশাপাশি বসত করতে করতে স্বজনও। বড় হওয়া, গান শেখা, রেকর্ড করা, সবের সঙ্গে জড়িয়ে আছেন তাঁরা। আমার প্রথম শিক্ষক জেলার বিখ্যাত রবীন্দ্রসঙ্গীত শিক্ষক স্বর্গীয় সন্ন্যাসীচরণ ভাণ্ডারী। পরে বড় হয়ে বিশ্বভারতীর সঙ্গীতভবন থেকে রবীন্দ্রসঙ্গীতের পাঁচ বছরের কোর্স করি। তখন সেখানে ছিলেন মোহরদি। কলকাতায় যাতায়াত বাড়ে। সেখানে পেলাম জর্জদা, চিন্ময়দাকে। পেয়েছি আমার দাদা, সিউড়ির রবীন্দ্রসঙ্গীত শিল্পী অশোকতরু বন্দ্যোপাধ্যায়কে। সিউড়ি তখন জেলার সংস্কৃতি চর্চার ক্ষেত্রে কোনও অংশে বোলপুর-শান্তিনিকেতনের থেকে পিছিয়ে নেই।

এ পাড়া, মুসলিম প্রধান পাড়া, তাই আমার পড়শিরাও বেশির ভাগ মুসলমান। তাঁদের সঙ্গেই বড় হয়েছি। তাঁরা সকলেই আমার বাড়ি আসেন। আমরা যাই, উৎসব-অনুষ্ঠানে মিলিত হই পরস্পরের মধ্যে আত্মীয়তার বন্ধনেই। পড়শিরা সকলেই আত্মীয়। সকলের সঙ্গে রক্তের সম্পর্ক হয়তো নেই, তবু অদ্ভুত এক আত্মীয়তা সকলের সঙ্গে জড়িয়ে সেই কবে থেকে।

দুর্গাপুজো বা ইদে সেই ছবি দেখা যায়।

বত্রিশ বছর হয়ে গেল, দুর্গাপুজোর। হিন্দু-মুসলমান সকলে মাতেন। আগে পুজোয় থাকতে পারতাম না। অনুষ্ঠানের জন্য বাইরে যেতে হত। এখন সকলকে নিয়ে পুজোয় একটা দিন অনুষ্ঠান করি। সেই অনুষ্ঠানে পড়শিরাই শিল্পী। কোনও ভেদাভেদ নেই, সকলে গান-বাজনা করেন। পড়শিদের সহযোগিতা না পেলে, সেটা সম্ভব হত না।

আবার বাড়ির কাছেই একটি মুসলমান ক্লাব রয়েছে। সেখানে ইদে বিরাট অনুষ্ঠান হয়। প্রতিবার সেখানে আমরা থাকবই। আমার ছেলে দেবজ্যোতিও থেকেছে অনেকবার।

যে-সিউড়িতে বড় হয়েছি, সে সিউড়ি ছিল অনেক বেশি নির্মল, পরিষ্কার। দূষণমুক্ত। এখন অসম্ভব নোংরা, রাস্তা-ঘাটে হাঁটা যায় না। নিকাশি নেই। সামান্য বৃষ্টিতেই জল দাঁড়িয়ে পড়ছে। পথে যানজট। আকাশ ঢেকে যাচ্ছে হোর্ডিং-এ। পুরসভা নামেমাত্র রয়েছে। আর পানীয় জল? আমার বাড়িতেই পুরসভার জল নেই এক যুগ!

কবে থেকে যেন সেই ফাঁকা ফাঁকা পাড়া, শহর হারিয়ে যেতে শুরু করল।

একটা সময় থেকে অংশুমান রায়, প্রবীর মজুমদারদের প্রভাবে আধুনিক গানের প্রতি আমার ঝোঁক বাড়ল। তখন ছিল আকাশবাণীর অনুষ্ঠান জেলা বেতার অনুষ্ঠান। যার সঙ্গে ছিলেন মলয় পাহাড়ি ও আর্য চৌধুরী। সেই অনুষ্ঠানেও গান করি। সিউড়ির এই ঘরে বসেই রেকর্ড হয় গানের। এর পর পর দিল্লিতে ওঁদের রেকর্ড করা গানই সর্বভারতীয় ক্ষেত্রে জনপ্রিয় হয়ে উঠল। সে গানটি ছিল, ‘বলি ও ননদি আর দু’মুঠো চাল ফেলে দে’।

আকাশবাণীতে ঢোকার পর হেমন্ত মুখোপাধ্যায়, ভি বালসারা, ভূপেন হাজরিকার কাছ থেকে শিখলাম অনেক নতুন গান। তখনও আমার রেকর্ড বের হয়নি। জেলার নানা উৎসব-অনুষ্ঠানে, আর বাইরে কোথাও কোথাও গান করছি। লোকসুরে যেন অন্য এক মাটি ঘেঁষা জীবনকে পেলাম। আমার স্বামী জেলার বিভিন্ন গ্রামে যেতেন। উনি স্বাস্থ্যবিভাগে কাজ করতেন। সেই সব গ্রাম থেকে লোকগান সংগ্রহ করে আনতেন।

’৭৮-এ আমার প্রথম রেকর্ড বের হল। দুটি গান। ‘বলি ও ননদি’ আর ‘বড় লোকের বিটি লো’। প্রথম গানটি জেলার কবি আশানন্দন চট্টরাজের লেখা। দ্বিতীয়টি প্রচলিত। পরে বাজারে এল, ‘বর এল মাদল বাজিয়ে’। জনপ্রিয় হল, ‘জয় জয় মা মনসা’। আশি সালে এইচএমভি বের করল প্রথম রেকর্ড। আশি থেকে ছিয়ানব্বই সাল। ষোলো বছর অসংখ্য গান করেছি এইচএমভি’তে। পরে আরও কিছু গান রেকর্ড হয়। শেষ রেকর্ড ২০১৩ সালে। ‘ছেলে ধরো গো খোকার বাবা’।

গেয়েছি সিনেমাতেও। মান্নাদা গাইয়েছেন। কিন্তু রেকর্ড প্রকাশ হওয়ার পর বা সিনেমায় গান করার পর জেলার মানুষ, সিউড়ির শিল্পীরা, পড়শিদের কাছে আমি রাতারাতি ‘সেলিব্রিটি’ হয়ে যাইনি! দূরত্ব বাড়েনি। সকলে বাড়িতে এসে হুল্লোড় করল। সকলে মিলে সে এক উৎসবের মেজাজ। এখন কিন্তু সেই পরিবেশ নেই সিউড়ি শহরে।

সিউড়ি তো দ্রুত বদলাচ্ছে।

একটা সময় মনে আছে, এ বাড়িতেই পর পর গানের ক্লাস হয়েছে। সিউড়ির শুধু নয়, জেলার নানা জায়গা থেকে মানুষ এসেছেন গান শিখতে। পরে দেখেছি নিজের ছেলেমেয়ের রেডিও-দূরদর্শনে গান গাইবার ব্যবস্থা করে দিতে অভিভাবকরা অনুরোধও করেছেন। আমি তাঁদের অনুরোধ রাখতে পারিনি। বিনীত হয়ে বলেছি, ‘দেখুন আমি গান শিখেছি। সাধনা করেছি সুর নিয়ে দীর্ঘ সময়। সুযোগ করে দেব— এই কনট্রাক্ট নিয়ে শেখাতে পারব না।’ পরে সিউড়িতে গানের ক্লাস বন্ধ করে দিই! তবে এখন ভাল ছাত্রছাত্রী পেলে শিল্পী-জীবনের তাগিদ থেকে গান শেখাই।

মনে পড়ছে, বাড়ির পিছনে এক মুসলমান মেয়ের বিপদে আমার স্বামী গিয়ে দাঁড়িয়েছিল। থানা-পুলিশ সব নিজে সামলেছিল। নতুন প্রজন্মের মধ্যে এই বোধ নেই বলব না, তবে ক্রমশ বদলে যাচ্ছে চিন্তা-ভাবনাও।

রাস্তা-বাড়ি, পরিবেশ সব কিছু খুব দ্রুত চোখের সামনে বদলে যাচ্ছে। আগে সিউড়িতে দু’ কিলোমিটার দূরেও কারও বাড়িতে কিছু হলে, তার বাড়ি গিয়ে খবর নিতাম। নিজেদের বিপদে-আপদে দেখেছি পাড়া ছাড়িয়ে অন্য পাড়ার লোক এসে ভিড় করেছে উঠোনে। এখন আর সেটা দেখি না। মানুষ বড় ব্যস্ত হয়ে পড়েছে।

কলকাতার ফ্ল্যাট কালচার ঢুকে পড়েছে এ শহরে। এখন বেশির ভাগ মানুষ নিজেকে নিয়ে থাকতে চায়।

আমরা বদলাতে পারিনি!

আমি, আমার স্বামী মানস এখনও পুরনো মূল্যবোধ আঁকড়ে আছি। যতটুকু জানি, এ পাড়া, আমার পড়শি স্বজন এখনও সেই মূল্যবোধ নিয়েই বেঁচে আছে।

সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy