চারমূর্তি: বাঁ দিক থেকে, নীতিন সিংহ, অনুভব বসুমল্লিক, তুহিন কর্মকার ও নরেশ সিংহ। নিজস্ব চিত্র
সিগন্যাল সবুজ। যে কোনও সময়ে ট্রেন চলে আসতে পারে। রেলপথ ধরে ছুটছেন যুবতী।
বিপদ কিছু ঘটতে চলেছে এ কথা আঁচ করে পিছু নিল চার কিশোর। মহিলাকে কাকিমা বলে সম্বোধন করে বুঝিয়ে সরিয়ে আনার চেষ্টা করতেই উল্টো বিপদ। চার কিশোরকে লক্ষ করে পাথর ছুড়তে থাকেন ওই যুবতী। কিন্তু তাতে বিন্দুমাত্র দমে না গিয়ে চার কিশোর টেনে হিঁচড়ে লাইন থেকে বাইরে নিয়ে আসে। শনিবার সন্ধ্যায় এমনই নাটকীয় পরিস্থিতি তৈরি হয়েছিল ঝাড়গ্রাম শহরের কদমকানন এলাকায়। প্রাণরক্ষা পেল যুবতীর। রবিবার তিনি বললেন, ‘‘স্বামী মারা গিয়েছে। ছোট দু’টি ছেলেকে নিয়ে অনেক কষ্টে সংসার চালাচ্ছি। পাঁচটা বাড়িতে গৃহপরিচারিকার কাজ করি। শ্বশুরবাড়ির কেউ আমার খোঁজও রাখেননি।’’ সঙ্গে তিনি যোগ করেন, ‘‘ছেলে দুটোকে কী ভাবে মানুষ করব এসব ভেবে মাথার ঠিক ছিল না। তাই নিজেকে শেষ করে দিতে চেয়েছিলাম। ওই ছেলেগুলো বাঁচিয়ে দিল।’’
ওই যুবতীর প্রাণরক্ষায় এগিয়ে এসেছিল তারা হল, ঝাড়গ্রাম শহরের নরেশ সিংহ, অনুভব বসুমল্লিক, তুহিন কর্মকার ও নীতিন সিংহ। নীতিন ও নরেশ দুই সহোদর ভাই। শহরের বাছুরডোবা স্টেশন পাড়ার বাসিন্দা। নীতিন কুমুদকুমারী ইনস্টিটিউশনের বাণিজ্যশাখার দ্বাদশ শ্রেণির ছাত্র। নরেশ শহরের নেতাজি আদর্শ বিদ্যালয়ের দশম শ্রেণির ছাত্র। অনুভব শহরের ওয়েস্ট এন্ড হাইস্কুলের একাদশ শ্রেণির বাণিজ্য শাখার ছাত্র। আর তুহিন ঝাড়খণ্ডের একটি আবাসিক স্কুলে বাণিজ্য শাখায় একাদশ শ্রেণিতে পড়ছে। অনুভব আর তুহিন শহরের ঘোড়াধরায় থাকে। চারজনের জমাটি বন্ধুত্ব। শনিবার টিউশন শেষে চারজনে চিড়িয়াখানার দিকে সাইকেলে বেড়াতে গিয়েছিল।
চিড়িয়াখানা থেকে ফেরার পথে ঠিক করে কদমকাননের কাছে একসঙ্গে হবে তারা। বন্ধুদের মধ্যে এগিয়ে গিয়েছিল নীতিন। কদমকাননের কাছাকাছি যেতে সে দেখতে পায়, বছর আটেকের একটি ছেলে অবিরাম কাঁদছে। কখনও যে যাচ্ছে রেললাইনের ধারে। কখনও ফিরে আসছে পিচ রাস্তার কাছে। নীতিনের কাছে ওই বালক জানায়, ‘‘আমার মা মরে যাবে। বাঁচাও।’’ নীতিন দেখে, লাইনের মাঝ বরাবর হাঁটছেন ওই মহিলা। সিগন্যাল তখন সবুজ। তুহিনকে ফোন করে সকলকে তাড়াতাড়ি চলে আসতে বলে নীতিন। এরপর চারজনে ওই মহিলার কাছে গিয়ে রেল লাইন থেকে সরে আসার অনুরোধ করতে থাকে। অনুভব বলে, ‘‘আমরা ওই কাকিমাকে বলি আত্মহত্যা মহাপাপ। উনি রেগে গিয়ে আমাদের দিকে পাথরের টুকরো ছুড়ে আমাদের সরে যেতে বলেন। ওই মহিলার ছেলে মায়ের পা ধরে কান্না কাটি করছিল কিন্তু উনি ধাক্কা মেরে তাঁর ছেলেকে সরিয়ে দিয়ে দ্রুত পায়ে রেললাইন ধরে হাঁটতে থাকেন।’’
নীতিন-তুহিনরা জানায়, ওই মহিলা বলছিলেন, ‘‘আর যন্ত্রণা সহ্য করতে পারছি না। নিজেকে শেষ করে দেব।’’ এরপর চারজনে ওই মহিলার হাত চেপে ধরে লাইন থেকে সরিয়ে রাস্তায় নিয়ে আসে। মহিলা তখন কান্নায় ভেঙে পড়েছিলেন। এরপর মহিলার কাছ থেকে এক পরিচিত ব্যক্তির মোবাইল নম্বর জোগাড় করে অনুভবেরা। রবি মাঝি নামে ওই ব্যক্তি চলে আসেন। রবির সাহায্য নিয়ে মহিলাকে বাড়িতে পৌঁছে দেয় চার কিশোর। সন্তানদের এমন কাজে গর্ববোধ করছেন অভিভাবকেরাও। নীতিন ও নরেশের বাবা পেশায় ব্যবসায়ী সুজিত সিংহ বলেন, ‘‘ওদের জন্য খুবই গর্ব হচ্ছে।’’
চারজন স্কুল পড়ুয়া এক মহিলাকে বাঁচাল। বিষয়টি জেনে জেলাশাসক আয়েষা রানি বলেন, ‘‘সাহসিকতা পুরস্কারের জন্য ওই চার কিশোরের নাম প্রস্তাব করে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের কাছে জানাব। ওই মহিলাকে পুনর্বাসন দেওয়ার ব্যবস্থা করা হবে।’’
নিজেকে নিয়ে ব্যস্ত। মোবাইলে বুঁদ। পরিজনের থেকে মুখ ফিরিয়ে নেওয়া— বর্তমান প্রজন্মের বিরুদ্ধে এমনই অভিযোগ ওঠে অহরহ। এই পরিস্থিতিতে ওই চার কিশোর কি ব্যতিক্রম? মনোবিদ জয়রঞ্জন রামের মতে, ‘‘এই প্রজন্মের সকলে স্বার্থপর, এই ধারণা ভুল। বরং বলা ভাল, নিঃস্বার্থভাবে অন্যদের জন্য ভাবা বা কিছু করার চেষ্টা অল্পবয়সীরাই বেশি করে। কারও কারও মধ্যে স্বার্থপরতা থাকে, সেটা ব্যতিক্রম।’’
এবার শুধু খবর পড়া নয়, খবর দেখাও। সাবস্ক্রাইব করুন আমাদের YouTube Channel - এ।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy