কাশির দমকে কথা আটকে যায় কাপাসডাঙার বাবুলাল মুর্মুর। কোনও মতে বলতে পারেন, ‘‘গরিব লোকের অসুখ তো! তাই এমন হেলাফেলা।’’
শুভ মার্ডি। নিজস্ব চিত্র
কাজ করার ক্ষমতা হারিয়েছেন শুভ মার্ডি। আজ নয়, ১৪ বছর আগেই। তখন তাঁর বয়স ৪০। পাথর ভাঙার কারখানায় দিনে দু’টন পাথর ভাঙতেন। আর এখন গরু চড়ানো ছাড়া আর কোনও কাজই পারেন না। অথচ সংসারে খাওয়ার মুখ অনেকগুলো। বীরভূমের মহম্মদবাজার ব্লকের হাবরাপাহাড়ি গ্রামের এই বাসিন্দার প্রশ্ন, ‘‘কোনও দোষ তো করিনি। খেটে খেতে চেয়েছিলাম। তা হলে আমার এই পরিণতি কেন?’’
২০০৮ সালে একটি বেসরকারি সংস্থার ক্যাম্পে সিলিকোসিস লক্ষণ যুক্ত বলে চিহ্নিত হওয়ার পর আদিবাসী গাঁওতার নেতাদের কাছে শুভ-সহ আরও ১০০ জন সম্ভাব্য সিলিকোসিস আক্রান্তের নথি দেওয়া হয়। সরকারি হাসপাতাল থেকে কফ পরীক্ষা করানোর দায়িত্ব ছিল গাঁওতার। কোনও অজ্ঞাতকারণে সেই কাজ আর এগোয়নি। চিকিৎসার অপেক্ষা করতে করতে মৃত্যু হয়েছে অনেকেরই। যেমন চুড়কি মুর্মু। ২০১৭ সালে তিনি যখন মারা যান, তখন বয়স হয়েছিল ৫২ বছর। পাথর ভাঙার কারখানায় কাজ করতেন চুড়কি। রোগ নির্ণয় হয়নি। তাই তাঁরা কেউই ক্ষতিপূরণ পাননি। যেমন, ২০১৯ সালে উত্তর ২৪ পরগণায় ৭৭ জন এবং দক্ষিণ ২৪ পরগণায় ১৬৭ জনের পরীক্ষা হয়। সকলেরই উপসর্গ ছিল। কিন্তু তাঁদের কারও রিপোর্টই এখনও সামনে আসেনি।
সরকারি নীতির কথা সামনে আসার পরে সামান্য আশার আলো দেখেছিল একাধিক পরিবার। কিন্তু তার পর? আবেদনের ফর্ম কোথায়, কী ভাবে আবেদন করা যাবে, সেই হদিস কেউ দিতে পারেননি। ফলে অন্ধকারে হাতড়ে বেড়ানোটাই নিজেদের ভবিতব্য বলে মেনে নিচ্ছেন অনেকেই।
গাফিলতির এই ছবি সর্বত্র। কখনও পরীক্ষাই হয় না। কখনও পরীক্ষা হলেও যক্ষ্মা বলে চালিয়ে দেওয়া হয়। আবার কখনও ডাক্তার মৌখিক ভাবে সিলিকোসিস-এর উপসর্গের কথা বললেও তা লিখে দিতে রাজি হন না, সরকারি নানা প্রশ্নের সম্মুখীন হওয়ার ভয়ে। নিয়ম অনুযায়ী, যে কোনও রেজিস্টার্ড চিকিৎসকই প্রয়োজনীয় পরীক্ষানিরীক্ষার পর সিলিকোসিস হয়েছে কি না সেই শংসাপত্র দেওয়ার অধিকারী। তাঁর দায়িত্ব রোগ নির্ণয়ের পরে সেই তথ্য মেডিক্যাল ইনস্পেক্টর অব ফ্যাক্টরিজ়-কে জানানো। কিন্তু বাস্তবে তা হয় কোথায়! জনস্বাস্থ্য আন্দোলনের কর্মী, চিকিৎসক পুণ্যব্রত গুণের আক্ষেপ, ‘‘সদিচ্ছার অভাব তো রয়েইছে। পাশাপাশি, মেডিক্যাল পাঠ্যক্রমে পেশাগত রোগ এত কম গুরুত্ব পেয়ে এসেছে বরাবর, যে ডাক্তাররা অনেকেই এ সম্পর্কে বিশদে জানেন না। পেশাগত রোগ সম্পর্কে
আরও চর্চা না বাড়ালে সমাজের বড় অংশের মানুষ বরাবর চিকিৎসার ন্যূনতম সুযোগ এবং ক্ষতিপূরণ থেকে বঞ্চিতই থেকে যাবেন।’’
প্রশ্ন হল, রোগ নির্ণয়, ক্ষতিপূরণ—সবটাই তো রোগ হওয়ার পরের পর্ব। রোগ ঠেকানোর প্রক্রিয়া নিয়ে কেন এমন নীরবতা? কেন কারখানায় ধুলো ঠেকানোর কোনও ব্যবস্থা না করেও দিব্যি পার পেয়ে যায় মালিকপক্ষ? যেমন, ধুলো আটকানোর জন্য ‘ফগার’ ব্যবহারের কথা সামনে আনছেন অনেকেই। অতি সূক্ষ্ম ধূলিকণাকে ফুসফুসে পৌঁছনো থেকে আটকাতে তার থেকেও ছোট জলকণা ছড়ানো জরুরি। এ ক্ষেত্রে ‘ফগার’ কার্যকর হতে পারে বলে অনেকের অভিমত। কিন্তু ক’টা কারখানায় এর ব্যবস্থা রয়েছে? ইন্ডিয়ান অ্যাসোয়িয়েশন অব অকুপেশনাল হেলথ-এর রাজ্য শাখার প্রাক্তন সভাপতি বরুণ শিকদার বলেন, ‘‘কারখানা মালিকরা অনেকেই কোনও নিয়ম মানতে চান না। তাঁরা মনে করেন, মারা তো যাচ্ছে শ্রমিকরা। আর ক্ষতিপূরণ তো দিচ্ছে সরকার। তা হলে আমরা কেন খরচ করে নিয়মকানুন মানতে যাব?’’ অভিযোগ, নিয়ম মানা হচ্ছে কি না তা দেখার জন্য সদিচ্ছার যেমন অভাব, তেমনই অভাব লোকবলের। রাজ্যে মেডিক্যাল ইনস্পেক্টর অব ফ্যাক্টরিজ-এর পদ ন’টি। আপাতত সেখানে কাজ করছেন মাত্র এক জন!
রাজ্যের চিফ ইনস্পেক্টর অব ফ্যাক্টরিজ আশিস সিট বলেন, ‘‘আমরা চেষ্টা করছি। কিন্তু এই লোকবল নিয়ে চাইলেও নিয়মিত নজরদারি সম্ভব হয় না। শ্রমিকদের মধ্যেও সচেতনতা বাড়াতে উদ্যোগী হচ্ছি, যাতে তাঁরা এই বিপদ সম্পর্কে সচেতন হন।’’ বরুণবাবুরও বক্তব্য, ‘‘নিয়ম মানার ক্ষেত্রে মালিক পক্ষকে চাপে রাখা যেমন জরুরি, তেমন শ্রমিকদের মধ্যেও সচেতনতা কর্মসূচি চালিয়ে যেতে হবে। শুধু পাথর ভাঙা কারখানাই তো নয়, কয়লা খনি, তাপ বিদ্যুৎ প্রকল্প, ইস্পাত শিল্প, সিমেন্ট কারখানাতেও সিলিকোসিস হয়।’’
কী ধরনের সচেতনতা? আশিসবাবু বলেন, ‘‘মাস্ক পরা কতটা জরুরি, তা শ্রমিকদের বোঝাতে হবে। অনেক সময়ে মাস্ক দেওয়া হলেও তা তাঁরা পরতে চান না।’’ উন্নত মানের মাস্কের কথা বলেছেন একাধিক বক্ষরোগ বিশেষজ্ঞও। তাঁদের মতে, মাস্ক যদি সূক্ষ্ম ধুলো আটকাতে পারে, তা হলে সিলিকোসিসের সঙ্গে লড়াইয়ে সেটা অন্যতম হাতিয়ার হয়ে উঠতে পারে। কিন্তু সেই সব মাস্কের ক্ষেত্রেও নিয়মিত ফিল্টার বদলানো জরুরি। যা খরচসাপেক্ষ। শ্রমিক পিছু এই খরচ করতে এগিয়ে আসেন না অধিকাংশ কারখানা মালিকই।
রাইজিং অকুপেশনাল সেফটি অ্যান্ড হেলথ নেটওয়ার্ক অব ইন্ডিয়ার জাতীয় আহ্বায়ক, পেশাগত রোগ বিশেষজ্ঞ কুণাল দত্ত অবশ্য বলছেন, ‘‘অত সূক্ষ্ম ধূলিকণা কোনও মাস্কই আটকাতে পারবে না। মাস্কের ব্যবহার নিয়ে এই ধরনের প্রচার আসলে সরকার এবং মালিক পক্ষের নিজেদের দায়িত্ব শ্রমিকদের উপরে চাপিয়ে দেওয়ার কায়দা। আগে মালিকদের নিয়ম মানতে বাধ্য করা হোক। তার পর তো শ্রমিকের ভূমিকা নিয়ে কথা।’’ সমস্যা হল, নিয়ম মানানোর জন্য পর্যাপ্ত আইন থাকলেও স্রেফ প্রয়োগের অভাবে তা কাজেই আসে না। ফ্যাক্টরিজ় অ্যাক্ট এবং ওয়েস্ট বেঙ্গল ফ্যাক্টরিজ় রুল-এও নিয়ন্ত্রণের কথা কিছু কম বলা ছিল না। ২০২০ সালে অকুপেশনাল সেফটি অ্যান্ড হেলথ কোড-এও সরকারের হাতে পর্যাপ্ত ক্ষমতা দেওয়া রয়েছে। গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে কাজের পরিবেশের উপরে। কোন পরিবেশে কাজ করলে এক জন শ্রমিক পেশাগত রোগ থেকে বাঁচতে পারবেন, তার ব্যাখ্যাও রয়েছে। কিন্তু বিড়ালের গলায়
ঘণ্টা বাঁধার কাজটা করতে কেউই এগিয়ে আসেনি।
কুণালবাবুর মতে, গলদটা গোড়াতেই! বহু কারখানায় কর্মীর তালিকাই নেই। তাই সেখানে কেউ পেশাগত রোগে আক্রান্ত হলে মালিকের কোনও দায়িত্বই বর্তায় না। শ্রম আইন অনুযায়ী, শ্রমিকেরা যে সব জিনিস নিয়ে কাজ করেন, তার মধ্যে ঝুঁকিপূর্ণ উপাদান থাকলে সংশ্লিষ্ট সংশ্লিষ্ট কারখানায় সেই বিজ্ঞপ্তিও থাকার কথা। সেটাও হয় না। তিনি বলেন, ‘‘এই যেখানে পরিস্থিতি, সেখানে কারখানায় কাজ করার সময়ে শ্রমিকের ঝুঁকি ন্যূনতম করার জন্য ব্যবস্থা নেবে মালিক, সেটা ধরে নেওয়াই তো হাস্যকর। সিলিকোসিসের মতো অসুখের কথা বেশি সামনে এলে প্রশাসনের অস্বস্তি বাড়ে, তাই তা চেপে রাখার এমন নির্লজ্জ চেষ্টা।’’
কাশির দমকে কথা আটকে যায় কাপাসডাঙার বাবুলাল মুর্মুর। কোনও মতে বলতে পারেন, ‘‘গরিব লোকের অসুখ তো! তাই এমন হেলাফেলা।’’
(শেষ)
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy