যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের মৃত ছাত্র স্বপ্নদীপ কুণ্ডু। —ফাইল চিত্র।
প্রশ্ন অনেক। উত্তরও অজানা নয়। কিন্তু সমাধানের সাহস কোথায়? কোথায় কর্তৃপক্ষের সেই সক্রিয়তা? যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র স্বপ্নদীপ কুণ্ডুর অস্বাভাবিক মৃত্যু নতুন করে সেই মূল প্রশ্নেই দাঁড় করাচ্ছে। যার সদুত্তর দিতে পারছেন না সংশ্লিষ্ট কেউই।
এই ঘটনার পরে মেন হস্টেলে মানসিক ও শারীরিক অত্যাচারের নানা ঘটনা তুলে ধরছেন বর্তমান ও প্রাক্তনদের অনেকে। সামনে আসছে বিশ্ববিদ্যালয়ের ঢিলেঢালা প্রশাসনিক অবস্থা। এই ঘটনায় প্রথম থেকেই বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিন অব স্টুডেন্টস এবং মেন হস্টেলের সুপারের ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। কিন্তু কেন তাঁরা সক্রিয় হননি, সদুত্তর নেই। ডিন অব স্টুডেন্টস রজত রায়ের দাবি, বুধবার রাতে মেন হস্টেল থেকে স্বপ্নদীপের বিষয়ে এক ছাত্রের ফোন পাওয়ার পরে তিনি সুপারকে বিষয়টি দেখতে বলেছিলেন। কিন্তু কেন তিনি নিজে যাননি? বিষয়টি নিয়ে সহ-উপাচার্য অমিতাভ দত্ত এ দিন বলেন, অভ্যন্তরীণ কমিটির তদন্ত চলছে।
বিশ্ববিদ্যালয়ের পড়ুয়াদের একাংশের প্রশ্ন, হস্টেলের অন্দরে মেস কমিটি কেন এত ক্ষমতাবান তা খতিয়ে দেখা হবে? সুপার বা ডিন অব স্টুডেন্টস কেন সেখানে কিছু বলতে পারেন না? হস্টেলের অন্দরে নানা কার্যকলাপ তো ক্যাম্পাসে অজানা নয়। তা হলে কেনই বা তা বছরের পর বছর চলতে দেওয়া হচ্ছে?
বিভিন্ন হস্টেলের একাধিক আবাসিকের মতে, ছাত্রদের নিয়ে গড়া মেস কমিটি হস্টেলের বিষয়ে বহু সিদ্ধান্তের শেষ কথা। কমিটিতে থাকা সিনিয়ররাই নির্ধারণ করে দেন, প্রাক্তন কোন ছাত্র হস্টেলে থাকবেন। সুপার অথবা ডিন অব স্টুডেন্টস-এর কোনও ভূমিকাই নাকি থাকে না। পুলিশ মেন হস্টেলের আবাসিক যে প্রাক্তন ছাত্র সৌরভ চৌধুরীকে গ্রেফতার করেছে, তিনিও নাকি নিজেই মেন হস্টেলের মেস কমিটির সদস্য ছিলেন। হস্টেলে প্রাক্তনীদের এই ‘সাম্রাজ্য’ কেন? কলা বিভাগের ছাত্র সংসদের বিদায়ী সাধারণ সম্পাদক শুভায়ন আচার্য মজুমদার বলেন, “সুপার হিসেবে যাঁরা কাজ করছেন তাঁদের বদল করা হোক। এক শ্রেণির আবাসিকের চাপে অথবা ভয়ে এঁরা কাজ করতে পারেন না।”
যাদবপুরে কোনও হস্টেলে সিসি-ক্যামেরা নেই। অথচ ইউজিসি র্যাগিং বিরোধী নির্দেশিকায় হস্টেলে তা বসানোর কথা বলেছে। অনেকের বক্তব্য, মেন হস্টেলে সিসি-ক্যামেরা থাকলে স্বপ্নদীপের মৃত্যু রহস্য অনেকটা পরিষ্কার হত। এক অধ্যাপকের কথায়, ‘‘গণতান্ত্রিক খোলামেলা পরিবেশকে বদ্ধ করার সাহস কর্তৃপক্ষের নেই। তা হলেই শুরু হবে আন্দোলন, ঘেরাও।’’ কিন্তু মুক্ত পরিবেশের নামে নতুনদের উপরে অত্যাচার চললে তা সহনীয়? উত্তর নেই। সহ-উপাচার্য জানালেন, এই নিয়েও পর্যালোচনা করা হচ্ছে। তবে এই বিষয়ে কর্তৃপক্ষ কতটা সফল হবেন সে নিয়েও প্রশ্ন দেখা দিয়েছে।
মূল প্রশ্ন, কর্তৃপক্ষ স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে কেন যাদবপুরে কিছু করতে পারেন না? ক্যাম্পাসের অনেকের ব্যাখ্যা, ‘গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে’ হস্টেল-সহ ক্যাম্পাসে একটি ছোট ছাত্রগোষ্ঠী সব সময় সরব। কর্তৃপক্ষের একক সিদ্ধান্ত এখানে খাটে না।
অভিযোগ, স্বপ্নদীপকে গুরুতর আহত অবস্থায় হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার সময়েও এই ছাত্রগোষ্ঠীর একাংশ সভা ডেকে আলোচনা করছিল যে, পরে স্বপ্নদীপের মৃত্যুকে কী ভাবে বর্ণনা করা হবে! এমনকি, তার পর দিন ক্যাম্পাসেও বৈঠক ডেকে ঘটনাকে র্যাগিং বলা হবে নাকি হবে-না, সে নিয়ে প্রকাশ্যেই বিতর্ক তুঙ্গে উঠেছিল। বিষয়টি নিয়ে পড়ুয়া, গবেষকেরা সমাজমাধ্যমে সরব। হাসপাতালেও এই নিয়ে তর্কবিতর্ক চলেছে বলে সমাজমাধ্যমে জানিয়েছেন এক জন।
প্রশ্নে পুলিশের ভূমিকাও। শনিবার এ নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক সমিতির (জুটা) সাধারণ সম্পাদক পার্থপ্রতিম রায় বলেন, ‘‘পুলিশ এখনও এক জনকে গ্রেফতার করেছে। আমরা দাবি জানাচ্ছি, ঘটনার সঙ্গে যুক্ত সকলকে গ্রেফতার করতে হবে।’’ ক্যাম্পাসে প্রশ্ন, প্রাথমিক ভাবে ব্যবস্থা নিতে পুলিশের তরফে কি দ্বিধা ছিল? পরে প্রশাসনের সর্বোচ্চ স্তর থেকে নির্দেশ আসার পরে পুলিশ সক্রিয় হয়? কারণ, ঘটনার রাতে ও পর দিন হস্টেলে-ক্যাম্পাসে যে ছাত্রনেতার দাপট দেখা গিয়েছে, তাঁর সঙ্গে এক রাজনৈতিক নেতার যোগযোগ নিয়ে চর্চা বহু দিনের। যাদবপুরের ক্যাম্পাসে র্যাগিংয়ের অভিযোগ উঠলে অতীতে দেখা গিয়েছে, অভিযুক্তদের বাঁচাতে সক্রিয় হয় পড়ুয়াদের একাংশ। মদ-মাদকের সমস্যা-সহ বহিরাগতের প্রবেশের সমস্যাও দীর্ঘদিনের। কর্তৃপক্ষ সমাধানের চেষ্টা করলেও ব্যর্থ।
পার্থপ্রতিম রায় সহকর্মীদের এ দিন যে চিঠি পাঠিয়েছেন, তাতে লিখেছেন, ‘আগেও বারে বারে দেখেছি যে র্যাগিংয়ের ঘটনায় কেউ দোষী সাব্যস্ত হলে এক শ্রেণির ছাত্র বা অছাত্র তাদের বাঁচানোর জন্য ঘেরাও থেকে শুরু করে সব রকমের পন্থা অবলম্বন করে। আর আমরা শিক্ষকরা সব দেখে-জেনেও চুপ থাকি বা পরোক্ষ সমর্থন করি। তা হলে সাধারণ মানুষ আমাদের শ্রদ্ধা করা দূরে থাকুক, ঘৃণা করবে। এটি প্রিয় বিশ্ববিদ্যালয়ের সম্মান বাঁচানোর লড়াই। আসুন, সবাই মিলে এক বার শেষ চেষ্টা করে দেখি।’
এক কিশোরের মৃত্যুর বিনিময়ে সেই চেষ্টা কি এ বার করবেন কর্তৃপক্ষ? প্রশ্নটা সকলেরই।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy