বিচরণক্ষেত্র পেতে চলেছে ভারতীয় ধূসর নেকড়েরা। — ফাইল চিত্র।
কয়েক দশক আগেও রাঢ়বঙ্গের বিস্তীর্ণ এলাকা জুড়ে ছিল ওদের বসবাস। কিন্তু মানুষের সঙ্গে সঙ্ঘাত আর বসতি ধ্বংসের কারণে ধীরে ধীরে কোণঠাসা হয়ে পড়েছে ওরা। বিচরণক্ষেত্র সীমাবদ্ধ হয়ে গিয়েছে বাংলার দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের ছোট ছোট কয়েকটি অঞ্চলে। আন্তর্জাতিক সংস্থা আইইউসিএন-এর লাল তালিকায় থাকা সেই ভারতীয় ধূসর নেকড়েদের এমনই একটি আবাসভূমির কথা কয়েক বছর আগে জানা গিয়েছিল। পশ্চিম বর্ধমান জেলার শিল্পনগরী দুর্গাপুরের অদূরে সেই অঞ্চলে সম্প্রতি শুরু হয়েছে তাদের সংখ্যা, বিচরণক্ষেত্র, খাদ্যাভ্যাস-সহ বাস্তুতন্ত্র বিষয়ক পূর্ণাঙ্গ সমীক্ষার কাজ। সেই সঙ্গে খোঁজা হচ্ছে, ভারতের অরণ্যে ক্রমশ কমে আসা এই মাংসাশী প্রাণীগুলির সরক্ষণের দিশানির্দেশও। সৌজন্যে, দেশের প্রথম সারির বন্যপ্রাণ সংরক্ষণ সংস্থা ‘ওয়াইল্ডলাই ট্রাস্ট অফ ইন্ডিয়া’ (ডব্লিউটিআই) এবং দুর্গাপুরের বন্যপ্রাণপ্রেমী সংগঠন ‘উইংস’।
‘উইংস’-এর নেকড়ে সমীক্ষক দলের কর্ণধার, অর্কজ্যোতি মুখোপাধ্যায় জানান, পশ্চিম বর্ধমান-সহ রাঢ়বঙ্গের বিভিন্ন এলাকায় বসতি ও কৃষিজমি লাগোয়া জঙ্গলে বহু বছর ধরেই নেকড়ের বাস। সাম্প্রতিক কালে জুলজিক্যাল সার্ভে অফ ইন্ডিয়া (জেডএসআই)-এর একটি সমীক্ষাতেও পশ্চিম মেদিনীপুর, ঝাড়গ্রাম, বাঁকুড়া, পুরুলিয়া, বীরভূম, পশ্চিম বর্ধমানের মতো জেলায় নেকড়ের অস্তিত্ব প্রমাণিত হয়েছে।
বন্যপ্রাণ গবেষণায় পিএইচডি ডিগ্রিধারী অর্ক বলেন, ‘‘পশ্চিম বর্ধমান-সহ রাঢ়বঙ্গের বিস্তীর্ণ অঞ্চলে নেকড়ে খাদ্যশৃঙ্খলের শীর্ষে থাকা শিকারি প্রাণী। বাস্তুতন্ত্রের ভারসাম্য বজায় রাখতে এই প্রজাতিটির বড় ভূমিকা রয়েছে। প্রাথমিক সমীক্ষায় আমরা দেখেছি, প্রাকৃতিক শিকারের ঘাটতির জন্যই এরা গৃহপালিত ছাগল, মুরগি শিকার করে। এই পরিস্থিতিতে ‘হিউম্যান-অ্যানিম্যাল কনফ্লিক্ট’ (মানুষ ও নেকড়ের সংঘাত) প্রশমন করা এবং নেকড়েদের দীর্ঘমেয়াদি সংরক্ষণের দিশানির্দেশ খোঁজা এই সমীক্ষার মূল লক্ষ্য।’’
জমজমাট দুর্গাপুর শহরের অদূরে ২০১৬ সালে প্রথম নেকড়ের উপস্থিতি ক্যামেরাবন্দি করেছিলেন পশ্চিম বর্ধমানের তৎকালীন ডিএফও (বিভাগীয় বনাধিকারিক) মিলন মণ্ডল। তিনি বলেন, ‘‘দুর্গাপুর শহর লাগোয়া দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের আমলের একটি পরিত্যক্ত বিমানঘাঁটিতে প্রথম একটি নেকড়কে দেখে তার ছবি তুলেছিলাম। পরে আরও এক বার নেকড়ে দেখতে পাই অদূরের এতটি জঙ্গল লাগোয়া কৃষিজমিতে।’’ পরবর্তী সময় মাধাইগঞ্জ, লাউদোহা, কাঁটাবেড়িয়া এলাকায় বিচরণকারী গোটা সাতেক নেকড়ের একটি দলকে চিহ্নিত করেন দুর্গাপুরে কর্মরত সরকারি ইঞ্জিনিয়ার অর্ণিশ বসু। তিনি বলেন, “স্থানীয় কয়েকটি গ্রাম থেকে প্রায়শই ছাগল এবং ভেড়া তুলে নিয়ে যায় নেকড়েরা। বস্তুত, জঙ্গলের খরগোশ, মেঠো ইঁদুর বা অন্য ছোট প্রাণীর তুলনায় গৃহপালিত জীবের উপরে বেশি নির্ভরশীল তারা। তবে এখানে গ্রামবাসীরা নেকড়ের সঙ্গে এই সহাবস্থান মেনে নিয়েছেন। ছাগল-ভেড়া মারার প্রতিশোধ নিতে নেকড়ে মারার কোনও খবর আমাদের জানা নেই।’’ কাজের চাপ সামলে, নিয়মিত ভাবে নেকড়ে সমীক্ষায় অংশও নিচ্ছেন অর্নিশ।
একই কথা জানিয়ছেন সমীক্ষক দলের অন্যতম সদস্য দেবায়ন গায়েন এবং শুভদীপ সাহা। রাঢ়বঙ্গের বিভিন্ন জেলায় আর এক বন্যপ্রাণী ‘ইন্ডিয়ান প্যাঙ্গোলিন’ (বনরুই) সংক্রান্ত সমীক্ষার কাজে যুক্ত দেবায়ন জানান, ঝাড়গ্রাম, পশ্চিম মেদিনীপুরের মতো জেলায় গ্রামবাসীদের হামলায় নেকড়ে এবং হামলার মৃত্যুর ঘটনা তাঁদের নজরে এসেছে। কিন্তু লাউদোহা-মাধাইগঞ্জ-ঝাঝরা লাগোয়া গ্রামগুলি এ ক্ষেত্রে ব্যতিক্রম। ছ’মাসের সময়সীমার এই র্যাপিড অ্যাকশন প্রজেক্ট (র্যাপ)-এর কাজ কী ভাবে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে ‘উইংস’? তিনি বলেন, ‘‘ট্র্যাপ ক্যামেরার সাহায্য আমরা এই এলাকার নেকড়ের সংখ্যার একটা আপেক্ষিক চিত্র তুলে ধরার চেষ্টা করছি। এ ছাড়াও গ্রামের মানুষ এবং স্কুল পড়ুয়াদের মধ্যে ধারাবাহিক প্রচারের মাধ্যমে সচেতনতা বৃদ্ধির কাজ চলছে। আশা করছি, আমরা এই সমীক্ষার মাধ্যমে পাওয়া তথ্যের ভিত্তিতে একটি ‘সুস্থিত সংরক্ষণ পরিকল্পনা’র রূপরেখা তৈরি করতে সক্ষম হব।’’
নেক়ড়ের সন্ধানে বসানো ট্র্যাপ ক্যামেরায় ওই এলাকায় আরও কিছু বন্যপ্রাণও নজরে এসেছে অর্কদের। সমীক্ষক দলের সদস্য মণীশ চট্টোপাধ্যায় জানিয়েছেন, বুনো শুয়োর, বনবিড়াল (জাঙ্গল ক্যাট), খেঁকশিয়াল (বেঙ্গল ফক্স)-এর মতো প্রাণী ক্যামেরাবন্দি করেছেন তাঁরা। শিল্পাঞ্চলের খণ্ডিত বনাঞ্চলে বিভিন্ন প্রজাতির বন্যপ্রাণের উপস্থিতিতে উৎসাহী রাজ্য বন দফতরও। দুর্গাপুরের বিভাগীয় বনাধিকারিক বুদ্ধদেব মণ্ডল বলেন, ‘‘১৯৭২ সালের ভারতীয় বন্যপ্রাণ সংরক্ষণ আইন অনুযায়ী ধূসর নেকড়ে ১ নম্বর তফসিল অর্থাৎ সর্বোচ্চ গুরুত্বে সংরক্ষিত প্রজাতি। আমাদের এলাকায় এর উপস্থিতি নিঃসন্দেহে তাৎপর্যপূর্ণ। আশা করি, সমীক্ষার পূর্ণাঙ্গ রিপোর্ট হাতে এলে গঢ়জঙ্গল এবং সন্নিহিত বনাঞ্চলে নেকড়ে সংরক্ষণের ক্ষেত্রে কার্যকরী পদক্ষেপ করা সম্ভব হবে।’’
ডব্লিউটিআই-এর সর্বভারতীয় প্রধান তথা বিশিষ্ট বন্যপ্রাণ বিজ্ঞানী বিবেক মেনন আনন্দবাজার অনলাইনকে বলেন, ‘‘নেকড়ের মতো মাংসাশী প্রাণী বাস্তুতন্ত্রের ছোট স্তন্যপায়ীদের জনসংখ্যাকে নিয়ন্ত্রণে রাখতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। কিন্তু ভারতে সংরক্ষিত বনাঞ্চলের বাইরে বসবাসকারী নেকড়েরা আজ ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যার চাপে ক্রমশ কোণঠাসা হচ্ছে। শহর বাড়তে থাকায় সংকুচিত হচ্ছে তাদের আবাসভূমি। এই পরিস্থিতিতে অর্ক এবং তাঁর সহকারীদের সাহায্যে ট্র্যাপ ক্যামেরার মাধ্যমে লাউদোহা-মাধাইগঞ্জ অঞ্চলের নেক়়ড়ের সম্পর্কে তথ্য সংগ্রহ এবং গ্রামবাসীদের হামলায় তাদের মৃত্যুর সম্ভাবনা এড়াতে জনসচেতনতা প্রচার এই ‘র্যাপ’-এর মূল উদ্দেশ্য।’’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy