প্যানেলের মেয়াদ ফুরোলেও নিয়োগ শেষ করেনি স্কুল সার্ভিস কমিশন। তবে নিয়োগ শেষ হওয়ার আগেই উত্তরপত্র (ওএমআর) নষ্ট করতে নেমে পড়েছিল তারা। শুধু তাই নয়, নিয়মে শুধু শিক্ষক নিয়োগের ওএমআর নষ্ট করার কথা বলা হলেও শিক্ষাকর্মীদের নিয়োগ প্রক্রিয়ার উত্তরপত্রও নষ্ট করে ফেলা হয়েছিল। স্কুল সার্ভিস কমিশনের (এসএসসি) এই ‘কীর্তির’ কথা উঠে এসেছে সুপ্রিম কোর্টের রায়ে। এই প্রসঙ্গেই দেশের প্রধান বিচারপতি সঞ্জীব খন্না এবং বিচারপতি সঞ্জয় কুমারের ডিভিশন বেঞ্চের পর্যবেক্ষণ, ‘‘ডিজিটাল প্রতিলিপি না রেখেই ওএমআর নষ্ট করে ফেলা খুবই তাৎপর্যপূর্ণ। হাই কোর্ট (কলকাতা) এই বিষয়টিকে যথার্থ ভাবেই বিবেচনা করেছে। আমরাও তাতে সহমত।’’
আইনজীবী মহলের পর্যবেক্ষণ, ডিজিটাল প্রতিলিপি না রেখে ‘অতি উদ্যোগী’ হয়ে ওএমআর শিট নষ্ট করে ফেলার ফলেই যোগ্য এবং অযোগ্য প্রার্থীদের বাছাই করা কার্যত অসম্ভব হয়ে পড়েছে। এসএসসি-র এই ভূমিকা দুর্নীতির পক্ষে যে সহায়ক, এ কথাও দাবি করেছেন আইনজীবীদের অনেকে। তবে কেউ কেউ প্রশ্ন করেছেন, ডিজিটাল প্রতিলিপি কি একেবারেই রাখা হয়নি? নাকি পরবর্তী সময়ে তা উধাও হয়ে গিয়েছে? প্রসঙ্গত, সুপ্রিম কোর্টের রায়ে উল্লেখ করা হয়েছে যে এই মামলার গোড়ায় কলকাতা হাই কোর্টে জমা দেওয়া হলফনামা এবং চাকরিপ্রার্থীদের নম্বর সংক্রান্ত রিপোর্টে কোথাও ওএমআর না-থাকার কথা এসএসসি জানায়নি।
রাজ্যে পালাবদলের পরে সরকারি পদে নিয়োগের পরীক্ষার উত্তরপত্র সংরক্ষণের নিয়ম বদল করা হয়েছে বলে খবর। প্রশাসনের একাংশ জানান, কেন্দ্রীয় নিয়মে নিয়োগ পরীক্ষার ১০ বছর পর্যন্ত উত্তরপত্র সংরক্ষণ করা হয়। বাম জমানায় সরকারি পরীক্ষার উত্তরপত্র প্যানেল প্রকাশের তিন বছর পর্যন্ত সংরক্ষিত থাকত। এই আমলে সেই সময় কমিয়ে এক বছর করা হয়েছে। তবে সেই নিয়মে এ-ও বলা হয়েছে যে উত্তরপত্র নষ্ট করা হলেও তার ডিজিটাল প্রতিলিপি রাখতে হবে।
প্রশাসনের এক কর্তা জানান, পাবলিক সার্ভিস কমিশনের পরীক্ষায় উত্তরপত্র প্যানেল প্রকাশের এক বছর পর্যন্ত সংরক্ষণ করা হয়। নিয়োগ নিয়ে মামলা হলে সেই সময়সীমা আরও বাড়ানো হয়। ওই কর্তার দাবি, ‘‘উত্তরপত্রের ডিজিটাল প্রতিলিপিও স্টেট ডেটা সেন্টারে সংরক্ষিত থাকে।” যদিও শিক্ষা দফতরের এক কর্তা বলেন, ‘‘এসএসসি-র নিয়ম অনুযায়ী, ওএমআর শিট এক বছর রাখার কথা। ডিজিটাল উত্তরপত্র কতদিন রাখার কথা তা নির্দিষ্ট করে কিছু বলা নেই।’’ তবে অনেকেরই বক্তব্য, যে কোনও নিয়োগেই অল্পবিস্তর মামলা হয়। তাই কাঁটায়-কাঁটায় এক বছরের মধ্যে ওএমআর নষ্ট করা হয় না। এ ক্ষেত্রে এসএসসি কি আগেভাগে কিছু আঁচ করেই ডিজিটাল তথ্য না-রেখে ওএমআর নষ্ট করেছিল?
রাজ্যে শিক্ষক নিয়োগের মতো গুরুত্বপূর্ণ কাজের দায়িত্বপ্রাপ্ত এসএসসি-র মতো প্রতিষ্ঠানের কাজ নিয়ে প্রশ্ন আগেই উঠেছিল। প্রশাসন সূত্রের দাবি, দেশের কন্ট্রোলার অ্যান্ড অডিটর জেনারেলের রিপোর্টেও এসএসসি-র সমালোচনা ছিল। আধিকারিকদের একাংশ জানান, ২০১৮ সালে সিএজি-র রিপোর্টে বলা হয়েছিল, সরকার এসএসসি-র বেআইনি কাজে নজর না দেওয়ায় বহু পরীক্ষার্থী স্বচ্ছ ভাবে পরীক্ষা দিয়েও চাকরি পেতে ব্যর্থ। উল্লেখ্য, ২০১৮ সালে বর্তমানে বাতিল হওয়া নিয়োগ প্রক্রিয়া চলছিল। যদিও প্রশাসনিক সূত্রের দাবি, শুধু এসএসসি নয়, সামগ্রিক ভাবে নিয়োগ পরীক্ষা ব্যবস্থা যাচাই করেছিল সিএজি। ২০০৯ সালে ‘ইন্টিগ্রেটেড অনলাইন এগজ়ামিনেশন সিস্টেম’-চালুর পর থেকে ২০১৬ সাল পর্যন্ত ১২টি পরীক্ষা হয়েছিল। তার মধ্যে যে ন’টির অনলাইন তথ্য সিএজি যাচাই করেছিল, সেই ন’টি পরীক্ষার পাঁচটিই ছিল বাম জমানায় এবং বাকি চারটি তৃণমূল জমানার।
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)