তৃণমূলের যুবনেত্রী সায়নী ঘোষ। ফাইল চিত্র।
যাবেন বলে বুধবার কেন ইডির দফতরে হাজিরা দিলেন না তৃণমূলের যুবনেত্রী সায়নী ঘোষ? তাঁর এবং তাঁর দলের তরফে ‘আনুষ্ঠানিক’ জবাব, পঞ্চায়েতের প্রচারে ব্যস্ত থাকার জন্য। কিন্তু যা প্রকাশ্যে বলা হচ্ছে না— তৃণমূলের শীর্ষ নেতৃত্বের যুগপৎ আশঙ্কা এবং উদ্বেগ ছিল, বুধবার সিজিওতে গেলে সায়নী যদি আর না বেরিয়ে আসেন! অর্থাৎ, যদি তাঁকে গ্রেফতার করে বসে ইডি! সে তদন্তের কারণেই হোক বা পঞ্চায়েত ভোটের তিন দিন আগে ‘রাজনৈতিক কারণে’।
সূত্রের খবর, দলীয় নেতাদের পরামর্শেই সায়নী বুধবার ইডির মুখোমুখি হননি। তাঁদের এবং আইনজীবীর পরামর্শে মঙ্গলবার রাতে তদন্তকারী সংস্থাকে ইমেল করে জানিয়েছিলেন, বুধবার তিনি হাজিরা দিতে পারছেন না। পঞ্চায়েত ভোট এবং ফলপ্রকাশ (১১ জুলাই) হওয়ার পরে যে কোনও দিন ডাকলে তিনি সশরীরে হাজিরা দেবেন। এর মধ্যে প্রয়োজনে তাঁর সঙ্গে ‘ভার্চুয়ালি’ও কথা বলতে পারে কেন্দ্রীয় তদন্তকারী সংস্থা।
সায়নীর সঙ্গে ধৃত এবং অপসারিত তৃণমূল যুবনেতা কুন্তল ঘোষের ‘যোগসাজশ’ নিয়েই প্রাথমিক ভাবে তদন্ত করছে ইডি। সে কারণেই তাঁকে ডেকে পাঠানো। তবে সায়নীর ঘনিষ্ঠদের বক্তব্য, তাঁকে ‘অভিযুক্ত’ হিসেবে ডাকা হয়নি। ডাকা হয়েছিল ‘সাক্ষী’ হিসেবে। তাঁকে টানা প্রায় ১১ ঘণ্টা জেরা করা হলেও তা ছিল মূলত নথিপত্র সংক্রান্ত। ফলে তাঁকে ঝপ করে গ্রেফতার করা হবে না বলেই এই অভিনেত্রী-নেত্রীর হিতৈষীরা মনে করছিলেন।
কিন্তু সায়নীর দলীয় নেতৃত্ব উদ্বেগে ছিলেন। তার কারণ, প্রথমত, সায়নীকে অত ক্ষণ ধরে জেরা করা। এবং দুই, তাঁকে আবার ডেকে পাঠানো। তা-ও পঞ্চায়েত ভোটের একেবারে মুখে! দলের এক প্রথম সারির নেতার কথায়, ‘‘ওকে যদি বিকেলে মধ্যে ছেড়ে দিত সে দিন (৩০ জুন), তা হলে চিন্তার কিছু ছিল না। অত রাত পর্যন্ত কেন প্রশ্ন করা হল? আর সে দিন (গত শুক্রবার) অত রাত পর্যন্ত জেরার করার পর আবার কেন বুধবারেই ডেকে পাঠানো হল? যদি প্রথম দিন ছেড়েই দেওয়া হয়ে থাকে, তা হলে পঞ্চায়েত ভোট হওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করা যেত না?’’
সেই সূত্রেই তৃণমূল নেতৃত্বের একাংশ আশঙ্কা করছিলেন, বুধবার সায়নীকে যদি গ্রেফতার করে নেওয়া হয়! এক নেতার কথায়, ‘‘ওই ঝুঁকি নেওয়াটা অনুচিত হত। যদি কোনও ভাবে ও গ্রেফতার হয়ে যেত, তা হলে তার ভয়ঙ্কর নেতিবাচক প্রভাব পড়ত ভোটের উপর! দলনেত্রী এবং অভিষেক (বন্দ্যোপাধ্যায়) যে পরিশ্রমটা করছেন, সেটা মাঠে মারা যেত!’’
এ সব সাতপাঁচ ভেবেই বুধবার তাঁকে প্রচারে পাঠিয়ে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন দলীয় নেতৃত্ব। তবে তার আগে ইডির তরফে তাঁর কাছে যে নথি চাওয়া হয়েছিল, তা সম্পূর্ণ প্রস্তুত করা হয়েছে। আইনজীবী মারফত তা বুধবার ইডির দফতরে পৌঁছে দেওয়ার ব্যবস্থা করা হয়েছে এবং তার আগে ইডিকে ইমেল মারফত বিষয়টি জানিয়েও রাখা হয়েছে। যদিও বুধবার সায়নীকে আসার জন্য কোনও রকম সরকারি চিঠি বা নোটিস পাঠায়নি ইডি। অর্থাৎ, ইডি ‘আনুষ্ঠানিক’ তলব না-করলেও সায়নীর তরফে ‘আনুষ্ঠানিকতা’ বজায় রাখা হয়েছে। তৃণমূল নেতৃত্বের বক্তব্য, এর ফলে সব দিকই বাঁচানো গিয়েছে। যদিও অনেকে মনে করছেন, সায়নী বুধবার না-যাওয়ায় তিনি নিজের অবস্থান খানিক ‘দুর্বল’ করে ফেললেন। তদন্তকারী সংস্থা মনে করতে পারে, তিনি ‘পালিয়ে’ গেলেন। আসবেন বলেও সশরীরে হাজিরা দিলেন না।
তবে তৃণমূল নেতৃত্ব মনে করছেন, আপাতত পঞ্চায়েত ভোট পর্যন্ত ‘আশঙ্কা’ কাটিয়ে দেওয়া গিয়েছে। সায়নী হাজিরা না-দেওয়ায় বিরোধী বিজেপি যে ‘হতাশ’, তা স্পষ্ট বুধবার বিরোধী দলনেতা শুভেন্দু অধিকারীর মন্তব্যে। বস্তুত, শুভেন্দুর কথায় কার্যত তদন্তকারী সংস্থার ভূমিকা নিয়ে উষ্মাই প্রকাশ পেয়েছে। তিনি বলেন, ‘‘অত প্রমাণ থাকতে ওই দিন (৩০ জুন) রাতে ছাড়তে গেল কেন? কুন্তলের কাছ থেকে তিনটে ফ্ল্যাট কিনে সব ভেঙে একটা বড় ফ্ল্যাট করেছে! ৬০ লাখ টাকার গাড়ি উপহার নিয়েছে! কয়েক কোটি টাকার হিসেব নেই! নিয়োগ দুর্নীতিতে তিনি (সায়নী) এক জন অন্যতম সুবিধাভোগী। যাঁরা ছেড়েছেন, তাঁদের এই সব লোককে ছাড়া উচিত হয়নি।’’ আর সিপিএম নেতা সুজন চক্রবর্তীর কথায়, ‘‘কেন উনি যাব বলেও গেলেন না, তা সবাই বুঝতে পারছে। আসলে গোটা তৃণমূল ভয়ে কাঁটা হয়ে রয়েছে, এই বুঝি কেউ জেলে গেল!’’
প্রসঙ্গত, গত ৩০ জুন শুক্রবার সকাল ১১টা ২২ মিনিটে সিজিও কমপ্লেক্সে পৌঁছেছিলেন যুব তৃণমূলের সভানেত্রী সায়নী। রাত ১০টার পরেও যখন অভিনেত্রী-নেত্রী বার হচ্ছিলেন না, তখন অনেকেই শঙ্কিত হয়েছিলেন। তবে জিজ্ঞাসাবাদ শেষে রাত ১১টা নাগাদ বেরোন সায়নী। সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে এ-ও জানান, ইডি ফের তাঁকে বুধবার তলব করেছে। তিনি আসবেন। তদন্তে ২০০ শতাংশ সহায়তা করবেন। বস্তুত, ইডির জেরার পরেও সায়নীকে ‘আত্মবিশ্বাসী’ই দেখিয়েছিল। জেরার পর দিন, শনিবারেও তিনি জানিয়েছিলেন, ১০০ বার ইডি ডাকলে ১০০ বার যাবেন। যাবেন প্রচারে।
ঘটনাপ্রবাহ বলছে, তার পর থেকে মঙ্গলবার পর্যন্ত সায়নী প্রচারে যাননি। রবি এবং সোমবার দৈনিক ‘তারকা’ প্রচারকের তালিকায় তাঁর নাম রাখেনি তৃণমূল। মঙ্গলবার নাম থাকলেও মায়ের অসুস্থতার কারণে প্রচারে যাননি সায়নী। অনেকে তখনই মনে করেছিলেন, সেই কারণেই তিনি বুধবার সিজিও-তে না যেতে পারেন। কার্যক্ষেত্রে দেখা গেল, সায়নী সিজিও-তে গেলেন না। কিন্তু প্রচারে গেলেন। কারণ, তৃণমূলের তরফে গোটা বিষয়টিকেই ‘রাজনৈতিক প্রতিহিংসা’ বলে ব্যাখ্যা করা হচ্ছে। যে কারণে দলের মুখপাত্র কুণাল ঘোষ প্রথম থেকেই ‘মূল তদন্ত’ নিয়ে কোনও মন্তব্য না-করতে চাইলেও সায়নীকে ডাকার ‘সময়’ নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন। পাশাপাশি, ‘নবজোয়ার’ কর্মসূচি চলাকালীন অভিষেককে ডেকে পাঠানোর বিষয়টিও তার সঙ্গে জুড়ে দেওয়া হয়েছে। যেখানে তিনি স্পষ্টই বলেছিলেন, পঞ্চায়েত ভোটের আগে তাঁর পক্ষে যাওয়া সম্ভব নয়। তার আগে কুন্তলের চিঠি সংক্রান্ত মামলায় অভিষেককে ৯ ঘণ্টা ৪০ মিনিট জিজ্ঞাসাবাদ করেছিল সিবিআই। সেই তলব অবশ্য ছিল পঞ্চায়েত ভোট ঘোষণার আগে। এর মাঝে কয়লা পাচার মামলার তদন্ত সূত্রে রাজ্যের আইনমন্ত্রী মলয় ঘটককে দিল্লিতে তলব করেছিল ইডি। তিনিও ভোট-ব্যস্ততার কথা জানিয়ে হাজিরা দেননি।
সেই কারণে মঙ্গলবারেই ঠিক হয়ে যায়, সায়নী পঞ্চায়েত ভোটের প্রচারে যাবেন। এবং প্রচারের কারণ দেখিয়েই সিজিও-তে যাবেন না। সেই একই কারণে যাবেন না বৃহস্পতিবারেও। তার পরে ভোটপ্রক্রিয়া শেষ হওয়া পর্যন্ত তিনি সেই কাজেই ‘ব্যস্ত’ থাকবেন। যা তৃণমূল নেতৃত্ব বলছেন না, ফলপ্রকাশের পরে সায়নীকে তদন্তকারী সংস্থা যত ক্ষণই জেরা করুক, তার প্রভাব ভোটের ফলে পড়বে না।
মঙ্গলবারেই ঠিক হয়ে যায়, বুধবার সায়নী বর্ধমানের গলসিতে প্রচারে যাবেন। সেই মতো ভোরবেলা তিনি বাড়ি থেকে বেরিয়েও যান। সিজিও-তে যান তাঁর আইনজীবী। সঙ্গে ৫৩০ পাতার নথি। আর গলসিতে পৌঁছে সংবাদমাধ্যমের প্রশ্নের জবাবে সায়নী বলেন, ‘‘ইডিকে নথি পাঠিয়ে দিয়েছি। বলেছি, প্রয়োজনে ভার্চুয়ালি কথা বলতে পারি। কিন্তু ভোটের মাত্র দু’দিন বাকি। দলের যুব সভানেত্রী হিসাবে আমার একটা দায়িত্ব আছে। আপাতত আমি সেই দায়িত্ব পালন করছি। ভোটের ফলাফল প্রকাশের পর যত বার আমায় ডাকা হবে, তত বার যাব।’’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy